সাত ভাগের এক ভাগ ধান মজুরি দিচ্ছেন শরীয়তপুরের কৃষকরা
তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে শ্রমিক সংকটে মাঠের পাকা ধান ঘরে তুলতে পারছেন না কৃষকরা। দেড়গুণ বেশি পারিশ্রমিক দিয়েও পাওয়া যাচ্ছে না স্থানীয় কোনো শ্রমিক। তীব্র গরমের কারণে ধান কাটা শ্রমিকদের এমন সংকটে সাত ভাগের এক ভাগ ফসলের বিনিময়ে অন্য জেলার শ্রমিক দিয়ে বোরো ধান ঘরে তুলতে হচ্ছে শরীয়তপুরের কৃষকদের।
শনিবার (৪ মে) শরীয়তপুরের গোসাইরহাট, ভেদরগঞ্জসহ বিভিন্ন উপজেলার ফসলি মাঠ ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।
কৃষক ও কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, বৈশাখ মাসের শুরু থেকে দেশের অন্যান্য জেলার মতো শরীয়তপুরেও শুরু হয়েছে তীব্র তাপপ্রবাহ। গত দুই-তিন দিনে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বৃষ্টিপাত হলেও ব্যতিক্রম শরীয়তপুরের চিত্র। অনাবৃষ্টির সঙ্গে তীব্র তাপ প্রবাহের গরমে দিশেহারা হয়ে পড়েছে জেলার কৃষক ও শ্রমিকরা। এর মধ্যে চলছে বোরো ধান ঘরে তোলার মৌসুম। স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় দেড়গুণ বেশি পারিশ্রমিকের প্রস্তাবেও জেলার শ্রমিকরা হিট স্ট্রোকের ভয়ে মাঠে নেমে ধান কাটতে রাজি হচ্ছেন না। মাঠের পর মাঠজুড়ে বোরো ধান পেকে সোনালি রঙের হয়ে থাকলেও শ্রমিক সংকটে এসব ধান ঘরে তুলতে পারছেন না কৃষকরা।
তীব্র গরমের কারণে কৃষকদের স্বাস্থ্য ঠিক রাখার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে কৃষি বিভাগ থেকে কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল সন্ধ্যার পরে টর্চ লাইটের সাহায্যে ধান কাটার জন্য। কিন্তু লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি উৎপাদিত ধান এভাবে কাটা সম্ভব হয়নি কৃষকদের পক্ষে। কৃষি বিভাগের হিসেব মতে- এ বছর জেলায় ২৫ হাজার ৫২৬ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের উৎপাদন হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৪০ ভাগ ধান ঘরে তুলতে পেরেছেন কৃষকরা। বাকি ৬০ ভাগের মধ্যে ২০ ভাগ ধান এখনো কাঁচা। তবে শ্রমিক সংকট চরম আকার ধারণ করায় জেলার কৃষকরা উৎপাদিত ফসলের সাত ভাগের এক ভাগ ধানের বিনিময়ে খুলনা, সাতক্ষীরা, রংপুর, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর ও রাজবাড়ীসহ অন্যান্য জেলার শ্রমিক দিয়ে ধান ঘরে তুলে নিচ্ছেন। জেলায় শ্রমিক সংকট না থাকলে এভাবে ধান কাটতে হতো না কৃষকদের।
ভেদরগঞ্জ উপজেলার কৃষক আজহারুল সরকার। তিনি এ বছর ১২০ শতাংশ জমিতে বোরো ধানের আবাদ করেছেন। কৃষি বিভাগের পরামর্শে চাষাবাদের কারণে ফলনও হয়েছে বেশ ভালো। তার আবাদকৃত জমির ধান পেকেছে এক সপ্তাহের বেশি সময় আগে। এলাকার শ্রমিকদের কাছে বারবার গেলেও তীব্র গরমের কারণে কেউ ধান কাটার কাজ করতে রাজি হননি। এমন শ্রমিক সংকটের কারণে আজহারুল সরকার এখনো ধান ঘরে তুলতে পারেননি।
এমন অবস্থায় কী করবেন জানতে চাইলে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, সাতক্ষীরা ও রাজবাড়ী এলাকার শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা বলেছে দুই দিন পর ধান কেটে দেবে। বিনিময়ে দিতে হবে সাত ভাগের এক ভাগ ধান। তাদের দিয়েই ধান ঘরে তুলব ভাবতেছি।
জাজিরার কাজী কান্দি গ্রামের কৃষক আনছার উদ্দিন কাজী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ধান সোনালি রঙের হয়ে মাঠে পড়ে রয়েছে। কিন্তু কেউ ধান কাটার কাজ করতে রাজি না। বাধ্য হয়ে সন্ধ্যার পরে নিজে ও দুই ছেলেকে নিয়ে টর্চ লাইটের সাহায্যে ধান কেটে কিছুটা ঘরে তুলেছি। কিন্তু এখনো প্রায় ৫০ শতাংশ জমির ধান মাঠে পড়ে রয়েছে। অন্য জেলার শ্রমিক ছাড়া এই ধান এখন ঘরে তোলা সম্ভব না।
গোসাইরহাট উপজেলার ধীপুর গ্রামের কৃষক আব্দুল বাতেন সরদার। এ বছর তিনি ৭৮০ শতাংশ জমিতে বোরো ধানের আবাদ করেছেন। শ্রমিক সংকটের কারণে তিনি রাজবাড়ী জেলার শ্রমিকদের দায়িত্ব দিয়েছেন ধান কাটতে। ধান কাটার পরে মোট ধানের সাত ভাগের এক ভাগ তারা পারিশ্রমিক হিসেবে নিয়ে যাবেন। স্থানীয় শ্রমিকরা টাকার বিনিময়ে ধান কাটতেন। কিন্তু স্থানীয় শ্রমিক না পাওয়ার কারণে অন্য জেলার শ্রমিক দিয়ে ধান ঘরে তুলতে হচ্ছে।
আব্দুল বাতেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, কষ্ট করে ফসল উৎপাদন করেছি। তীব্র গরমে শ্রমিক সংকটে পড়ে রাজবাড়ী জেলার শ্রমিকদের দিয়ে ধান ঘরে তুলতেছি। তারা যদি টাকা নিতো, তাহলে ভালো হতো। কিন্তু তারা সাত ভাগের এক ভাগ ধান নিয়ে যাবেন।
রাজবাড়ীর পাংশা উপজেলা থেকে ধান কাটতে এসেছেন আমান প্রামাণিক। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, তীব্র গরম উপেক্ষা করে ধান কাটতে এসেছি। ধান কেটে কৃষকের ঘরে তুলে দেওয়ার পরে সাত ভাগের এক ভাগ ধান আমি পাব। ধারণা করছি এ বছর আমি ৮০ থেকে ৯০ মণ ধান নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারব।
আরেকজন শ্রমিকের নাম লালন মন্ডল। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রায় ১০ দিন ধরে শরীয়তপুরের বিভিন্ন স্থানে ধান কাটার কাজ করছি। আমার দলে ১২ জন শ্রমিক রয়েছেন। এলাকায় কাজ কম বলে তীব্র গরম উপেক্ষা করে এখানে এসেছি ধান কাটতে। যার ধান কাটতে যাই তিনি আমাদের থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। প্রত্যেক শ্রমিকের লক্ষ্য থাকে ১০০ মণ ধান নিয়ে বাড়ি ফেরা।
শরীয়তপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক (শস্য) মো. রফিকুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে এ বছর বোরো ধানের মৌসুমে শ্রমিক সংকট চলছে। অন্যান্য জেলার অবস্থাও একই রকম। যদিও অন্যান্য বছরেও এমন সংকট দেখা যায়। শরীয়তপুরে বিভিন্ন জেলার শ্রমিক এসে ধান কাটছেন। বোরো ধানের জমির মালিকরা এসব শ্রমিকদের সঙ্গে ধান ও টাকার বিনিময়ে চুক্তি করে থাকেন। কৃষকদের ধান ঘরে তুলে দিয়ে শ্রমিকরা সাধারণত সাত ভাগের এক ভাগ ধান নিয়ে থাকেন। জেলায় শ্রমিক সংকট না থাকলে এমনটা হতো না।
সাইফ রুদাদ/আরএআর