মাছ কেটেই চলে শেফালীদের সংসার
‘বাহে হামার তেমন আয় ইনকাম নাই। মাছ কাটি যা হয় সেটা দিয়্যা কোনোমতে সংসার চলে। যেদিন বেশি মাছ কাটি সেদিন ১০ টাকা হইলেও আয় বেশি হয়। আল্লাহর রহমতে মাছ কাটার কাম করি হামার সংসার জীবন চলোছে।’
এভাবে কথাগুলো বলছিলেন রংপুর নগরীর আমাশু কুকরুল এলাকার বাসিন্দা শেফালী বেগম। প্রায় ১০ বছর ধরে রংপুরের সিটি মাছ বাজারে মাছ কাটার কাজ করছেন তিনি।
তার ভাষায়, ‘হামার গরম আর বর্ষা নাই। হাতে করি, আর পেটে খাই। হামার কাজ না করি আর উপায় নাই বাহে। একদিন কাজ না করলে পেটে ভাত যায় না। এটে হামরা যারা মাছ কাটি, ওমারগুলার কারো কারো স্বামী নাই। ছাওয়া সন্তান নিয়্যা অনেক কষ্ট! একবেলা মাছ না কাটলে ভাত জুটে না। সকাল থাকি (থেকে) সন্ধ্যা পর্যন্ত যত কেজি মাছ কাটিবার পারি সেভাবেই হামার ইনকাম হয়।’
সকাল থেকে শুরু করে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাছ কেটে দিয়ে প্রতিদিন শেফালীর আয় হয় ৫০০-৬০০ টাকা। তা থেকে জায়গা ভাড়া, ইজারা, পানির বিল ও ময়লা পরিষ্কার বাবদ প্রায় ১০০ টাকা দিতে হয় বাজার কর্তৃপক্ষকে। শেফালী বেগমের মতো এই সিটি বাজারে প্রায় ৫০ জন নারী উনুনের খড় পোড়ানো ছাই আর ধারালো বটি দিয়ে মাছ কেটে জীবিকা নির্বাহ করেন।
রোববার দুপুরে রংপুর সিটি মাছের বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সারি সারি নানা বয়সী নারীরা মাছ কেটে দিচ্ছেন। ভ্যাপসা গরমে যে বয়সে ফ্যান বা হাতাপাখার বাতাসে গা জুড়ানোর কথা সেই বয়সে নিজে চলার পাশাপাশি অনেকে নিয়েছেন পরিবার চালানোর মতো গুরু দ্বায়িত্ব।
কথা হয় সিটি বাজারে মাছ কেটে জীবিকা নির্বাহ করা সংগ্রামী নারীদের অনেকের সঙ্গে। তারা বলেন, এই বাজারের মাছ কাটা নারীদের অনেকই বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা, বয়স্ক কেউবা অভাবের সংসার চালাতে এ পেশায় এসেছেন। আর মাছ ভেদে প্রতি কেজির বিনিময়ে নেন ১০ থেকে ৫০ টাকা।
ষাটোর্ধ্ব রাবেয়া বেগম নামের এক নারী বলেন, এই বাজারে মানুষের মাছ কেটে পরিবার চালানোর পাশাপাশি মেয়ের বিয়ে ও নাতি-নাতনির পড়াশোনা খরচ চালাচ্ছি। এ ছাড়া নিজের চিকিৎসার পাশাপাশি প্রতিদিনই ১০০ থেকে দেড়শ টাকার ওষুধও কিনতে হয়। প্রতিদিন যে আয় হয় তা দিয়ে কোনোরকম চলছি। কিন্তু যদি স্থায়ী কোনো জায়গার ব্যবস্থা হত তাহলে আমাদের সবার জন্যই ভালো হত। পাশাপাশি এই যে প্রতিদিন ১০০ টাকার মতো দেওয়া লাগে সেটাও যদি মওকুফ করে দিত তাহলে অনেকেরই সংসার আরও ভালোভাবে চলত।
এই তীব্র গরমে শরীরের ঘাম আর পানিতে একাকার হয়ে মাছ কাটছেন ফরিদা বেগম। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যে গরম বাবা হামার কষ্ট দেখার কায়ো নাই। চেংড়ি বয়স হাতে স্বামী নাই। তখন থাকি এই বাজারে মাছ কাটাকাটি করি। মোর বাড়িঘর নাই, মাইনসের বাড়িত ভাড়া থাকো। এ্যটে সকালে আসি মাছ কাটি শুরু করি, যা টাকা পাই তা দিয়্যা জীবন চলছে। হামার কষ্টের বাকি দিনগুল্যাও এদোন (এমন) করি যাইবে বাহে।’
আরেক নারী নাম প্রকাশে অনীহা জানিয়ে বলেন, ‘এই ভ্যাপসা গরমোত বাঁচা দায় হয়া গেইছে। কিন্তু ছাওয়ার ঘরে কথা চিন্তা করি বাড়িত বসি না থাকি। সকালে আসি আর রাইতোত যাই। মাছ কুটিয়া, ধুইয়া দেই ১০-২০ করি কেজি, সারাদিনে সাড়ে ৪শ থেকে ৫শ টাকা পাই। এই টাকা দিয়্যা বাজার খরচ, ছাওয়ার পড়ালেখা, কিস্তি দিতে অনেকটা আগায়। স্বামী রিকশা চালায় একা হাতের উপার্জনে সংসার চলে না। হামার কষ্ট করারি কপাল, তাই গরম গায়ে নাগলেও পেটের কথা চিন্তা করি গরম টের না পাই।’
ছোট পরিবার আর চাকরিজীবনের ব্যস্ততম সময়ে একটু অবসর কাটাতে বাজারেই ছোট-বড় মাছ কেটে নেন ক্রেতারা। স্বল্প আয়ে অনেক পরিবারের একমাত্র অবলম্বন এই বিধবা-বয়স্ক নারীরা। সেরাজুল ইসলাম নামে এক ক্রেতার সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, যারা ছোট মাছ প্রিয় এনারাই আমাদের একমাত্র ভরসা। পরিবারের লোকেরা তো ব্যস্ত থাকে। ছোট মাছ বাড়ি নিয়ে গেলে মা, বোন বা বউয়েরা মাছ কাটতে চান না। তারা মাছ কেটে দিচ্ছে বলেই ছোট মাছের স্বাদ নিতে পারছি।
মশিউর রহমান নামের আরেকজন বলেন, তাদের এই পেশাটা অনেক ভালো। তারাও আয় করে সংসার চালাচ্ছেন আমাদেরও সুবিধা হচ্ছে। তবে রোদ বা বৃষ্টি থেকে বাঁচতে মাথার উপর টিনশেড করে দেয়া হলে ভালোভাবে কাজ করতে পারতো।
রংপুর সিটি বাজারের ব্যবসায়ী ও সংগঠক ইসমাইল হোসেন প্রিন্স বলেন, এই বাজারে প্রায় অর্ধশত নারী মাছ কেটে সংসার চালাচ্ছেন। তাদেরকে কেউ অবহেলার চোখে দেখে না। বরং ক্রেতা-বিক্রেতা সবার সহযোগিতা ও আন্তরিকতার কারণে এসব অসহায় নারীদের অনেকেই এখন কিছুটা হলেও সংসারে সচ্ছলতা ফেরাতে পেরেছেন। আমরাও চেষ্টা করছি, তাদেরকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করার।
আরকে/এমজেইউ