উপজেলা চেয়ারম্যানের ব্যবসা থাকলেও আয় নেই, স্বর্ণের দামে উঠানামা
স্বর্ণের বাজারে টানা কিছুদিন থেকে দাম উঠানামা করছে। একই সঙ্গে স্বর্ণের দাম উঠানামা করেছে নির্বাচনী হলফনামাতেও। তিনটি হলফনামাতে একই পরিমাণ স্বর্ণের তিন রকম দাম পাওয়া গেছে। শুধু তাই নয় চেয়ারম্যান পদের পাশাপাশি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে নেওয়া হয়েছে ঋণ। তবে ব্যবসা থেকে নেই কোনো আয়। আবার ১০ বছরে নগদ টাকা বেড়েছে ১৮ গুণ।
এমনই হলফনামা নির্বাচন কমিশনে জমা দিয়েছেন জয়পুরহাটের কালাই উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মিনফুজুর রহমান ওরফে মিলন। আর নির্বাচন কমিশনে তার দেওয়া ২০১৪, ২০১৯ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনী হলফনামা বিশ্লেষণ করে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
হলফনামার তথ্য মতে, ২০১৪ সালে কৃষি খাতে তার বছরে আয় ৬ হাজার টাকা, উপজেলা চেয়ারম্যানের ভাতা ২ লাখ ৬৪ হাজার টাকা। কৃষি খাতে নির্ভরশীলদের মধ্যে মায়ের একক নামে বছরে আয় ৩০ হাজার টাকা, ওয়ারিশ সূত্রে বণ্টন না হওয়া টাকার পরিমাণ ৫১ হাজার ও বাড়ি, অ্যাপার্টমেন্ট বা দোকান ভাড়া ওয়ারিশ সূত্রে ২৫ হাজার টাকা। অস্থাবর সম্পদে নিজ নামে নগদ ২ লাখ টাকা, ব্যাংকে জমা ৫০ হাজার টাকা ছিল। একটি ল্যাপটপের মূল্য ধরা হয়েছিল ৬০ হাজার টাকা ও ৭০ হাজার টাকার কিছু আসবাবপত্র ছিল। অন্যান্য খাতে ছিল ৮ লাখ টাকা। স্ত্রীর নামে বন্ড, ঋণপত্র, স্টক এক্সচেঞ্জের তালিকাভুক্ত নয় এমন কোম্পানির শেয়ার ৫০ হাজার টাকা। এ ছাড়া স্ত্রীর নামে উপহার পাওয়া ১০ ভরি স্বর্ণ দেখানো হয়েছে, যার মূল্য আনুমানিক ৪ লাখ টাকা। নির্ভরশীলদের নামে নগদ ১০ হাজার টাকা, ব্যাংকে জমা ৫০ হাজার ১৮০ টাকা। এ ছাড়া ১০ ভরি স্বর্ণও রয়েছে, যার অর্জনকালীন সময়ের মূল্য ধরা হয়েছে ৪ লাখ টাকা। ইলেকট্রনিক সামগ্রীতে এক লাখ ও আসবাবপত্রে এক লাখ ৭০ হাজার টাকা দেখানো হয়েছে।
স্থাবর সম্পদে নিজ নামে ০.৬৩ একর কৃষি জমির দলিল মূল্য ধরা হয়েছে ৯ হাজার টাকা। নিজ নামে অকৃষি জমি ও দালান নেই। নির্ভরশীলদের মধ্যে মায়ের একক নামে ৩.০৯ একর কৃষি জমির মূল্য ধরা হয়েছে ৯ লাখ ২৭ হাজার টাকা। যৌথ মালিকানায় বণ্টন না হওয়া ৫.১২ একর কৃষি জমির ছিল মূল্য ধরা হয়েছিল ১৫ লাখ ৩৬ হাজার টাকা এবং অকৃষি জমি ১.৭৭ একরের মূল্য ৩ লাখ ৮১ হাজার টাকা। যৌথ মালিকানায় ৩ লাখ টাকার একটি গোডাউন ও ১৫ লাখ টাকার একটি বাড়ি রয়েছে। যৌথ মালিকানার ক্ষেত্রে প্রার্থীর অংশে ১.৮০ একর কৃষি জমি দেখানো হয়েছে, যার মূল্য ৫ লাখ ৪০ হাজার টাকা। আর অকৃষি ০.৪৪ একর জমির মূল্য দেখানো হয়েছে ১ লাখ ৩২ হাজার টাকা। এ ছাড়া বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্ট বাবদ ওয়ারিশ সূত্রে দেখানো হয়েছে ৫ লাখ টাকা। তার সে সময় কোনো মামলা বা দায়-দেনা ছিল না।
২০১৯ সালের হলফনামায় কৃষি খাত থেকে মিনফুজুরের বছরে আয় ৯ হাজার টাকা। চেয়ারম্যানের ভাতাদি হিসেবে বছরে পেয়েছেন ৫ লাখ ৪০ হাজার টাকা। প্রার্থীর ওপর নির্ভরশীলদের মধ্যে মায়ের একক নামে বছরে আয় ৫০ হাজার টাকা। ওয়ারিশ সূত্রে বণ্টন না হওয়া টাকার পরিমাণ ৮১ হাজার ও বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্ট বা দোকান ভাড়া ওয়ারিশ সূত্রে ৪৫ হাজার টাকা। অস্থাবর সম্পদে নিজ নামে নগদ টাকার পরিমাণ ২৪ লাখ ৫৭ হাজার ৩০০ টাকা। ব্যাংকে জমা এক লাখ টাকা। উপহার হিসেবে পাওয়া ১০ ভরি স্বর্ণ সে সময় স্ত্রীর নামে না দেখিয়ে নিজের নামে দেখিয়েছেন। আর তার মূল্য ধরা হয়েছিল ৭০ হাজার টাকা, যা ২০১৪ সালের হলফনামার তুলনায় ৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা কম। একটি ল্যাপটপের মূল্য ধরা হয়েছিল ৬০ হাজার টাকা ও ৭০ হাজার টাকার কিছু আসবাবপত্র ছিল। স্ত্রীর নামে সেসময় অস্থাবর সম্পদে কিছুই দেখানো হয়নি। নির্ভরশীলদের নামে নগদ বা ব্যাংকে কোনো টাকা ছিল না। তবে ১০ ভরি স্বর্ণ ছিল, যার অর্জনকালীন সময়ের মূল্য ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা, যা ২০১৪ সালের হলফনামার তুলনায় ৫০ হাজার টাকা বেশি। এ ছাড়া ইলেকট্রনিক সামগ্রীতে ২ লাখ ও আসবাবপত্রে ২ লাখ টাকা দেখানো হয়েছে।
স্থাবর সম্পদে নিজ নামে কৃষি জমির পরিমাণ ২০১৪ সালের হলফনামার সঙ্গে মিল রাখা হয়েছে। তবে আমমোক্তারনামা দলিলে ৩০.৯৯ শতক জমি দেখানো হয়েছে। স্ত্রীর নামে দানে পাওয়া ২৮ শতক কৃষি জমি দেখানো হয়েছিল, যার মূল্য ৩ লাখ টাকা। নির্ভরশীলদের মধ্যে মায়ের নামে কৃষি জমির পরিমাণ ঠিক রাখা হয়েছিল। আর যৌথ মালিকানায় বণ্টন না হওয়া ৬.২ একর কৃষি জমি ছিল, মূল্য ১৫ লাখ ৩৬ হাজার টাকা এবং অকৃষি জমি ১.৭৭ একর, মূল্য ৩ লাখ ৮১ হাজার টাকা। যৌথ মালিকানায় ৩ লাখ টাকার একটি গোডাউন ও ১৫ লাখ টাকার একটি বাড়ি রয়েছে। এ ছাড়া যৌথ মালিকানার ক্ষেত্রে প্রার্থীর অংশে ২.২৫ একর কৃষি জমি দেখানো হয়েছে, যার মূল্য ১৪ লাখ ৪৬ হাজার টাকা। আর অকৃষি ০.৪৪ একর জমির মূল্য দেখানো হয়েছে ১ লাখ ৩২ হাজার টাকা। এ ছাড়া বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্ট বাবদ ওয়ারিশ সূত্রে দেখানো হয়েছে ৫ লাখ টাকা। রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকে যৌথ সিসি ঋণ দেখানো হয়েছে ১০ লাখ টাকা। তার সেসময় দুটি মামলা ছিল।
এবারের ২০২৪ সালের হলফনামায় প্রার্থীর বছরে কৃষি খাত থেকে আয় ২০ হাজার টাকা। উপজেলা চেয়ারম্যানের ভাতা হিসেবে বছরে পেয়েছেন ৫ লাখ ৪০ হাজার টাকা। প্রার্থীর উপর নির্ভরশীলদের মধ্যে মায়ের একক নামে আয় ১ লাখ ১০ হাজার টাকা, ওয়ারিশ সূত্রে বণ্টন না হওয়া ৯০ হাজার টাকা দেখানো হয়েছে। প্রার্থীর অস্থাবর সম্পদ নিজ নামে নগদ টাকা ৩৬ লাখ ৮৯ হাজার ৩০০ টাকা ও সোনালী ব্যাংক পুনট শাখায় জমার পরিমাণ এক লাখ টাকা। উপহারে পাওয়া ১০ ভরি স্বর্ণের অর্জনকালীন সময়ের আনুমানিক মূল্য দেখিয়েছেন ৭ লাখ টাকা, যা গত ২০১৯ সালের হলফনামার তুলনায় ৬ লাখ ৩০ হাজার টাকা বেশি। আর তার সেই ল্যাপটপটি এবারও দেখানো হয়েছে। স্ত্রী ও নির্ভরশীলদের নামে নগদ ও ব্যাংকে কোনো টাকা জমা নেই। তবে উপহারে পাওয়া সেই স্বর্ণের পরিমাণ এবারও দেখানো হয়েছে। তবে এবার অর্জনকালীন সময়ের আনুমানিক মূল্য দেখিয়েছেন ৭ লাখ টাকা, যা গত ২০১৪ সালের হলফনামার তুলনায় ৩ লাখ টাকা বেশি এবং ২০১৯ সালের হলফনামার তুলনায় ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা বেশি। ইলেকট্রনিক সামগ্রীতে ২টি টিভি, ২টি ফ্রিজ, ২টি ল্যাপটপ, একটি কম্পিউটার, ২টি এসি বাবদ ৩ লাখ টাকা দেখিয়েছেন। তবে এবার তার কোনো আসবাবপত্র নেই।
তিনটি হলফনামায় মিনফুজুর রহমান ব্যবসা বা পেশার বিবরণীতে ধান, চাউল এবং মৎস্য চাষ দেখিয়েছেন। তিনি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার পরেও তার ব্যবসা খাত থেকে কোনো আয় নেই বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তার ২০১৪ সালের হলফনামায় দেখানো নগদ ২ লাখ টাকা এবার ৩৬ লাখ ৮৯ হাজার ৩০০ টকা দেখানো হয়েছে। তবে স্বর্ণ একই পরিমাণ থাকলেও ওঠানামা করছে দাম।
স্থাবর সম্পদ নিজ নামে পূর্বের হলফনামার মতো কৃষি জমি ও আনমোক্তারনামা জমির পরিমাণ একই দেখিয়েছেন। স্ত্রীর নামে দানে পাওয়া ২৮ শতক কৃষি জমি দেখানো হয়েছে, যার মূল্য ৩ লাখ টাকা। নির্ভরশীলদের মধ্যে মায়ের নামে কৃষি জমির পরিমাণ ঠিক রাখা হয়েছে। যৌথ মালিকানায় বণ্টন না হওয়া ওয়ারিশ সূত্রে কৃষি ও অকৃষি একই পরিমাণ দেখানো হয়েছে। তবে গোডাউনের দাম বাড়িয়ে ৩ লাখ ৬৩ হাজার টাকা করা হয়েছে। আর একটি বাড়ির দাম ঠিক রাখা হয়েছে। এ ছাড়া যৌথ মালিকানার ক্ষেত্রে প্রার্থীর অংশে কৃষি, অকৃষি জমি ও বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্ট বাবদ ওয়ারিশ সূত্রে দেখানো সম্পদ পূর্বের হলফনামার সঙ্গে ঠিক রাখা হয়েছে। তবে দালাল বাবদ ওয়ারিশ সূত্রে সম্ভাব্য অংশে এক লাখ ৫ হাজার টাকা দেখানো হয়েছে।
রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক থেকে যৌথভাবে ৩৫ লাখ টাকার সিসি ঋণের অর্ধেক সাড়ে ১৭ লাখ টাকা ও মার্কেন্টাইল ব্যাংকে ঋণ ৭ লাখ টাকাসহ মোট ২৪ লাখ টাকা ৫০ হাজার টাকার ঋণ রয়েছে মিনফুজুরের। এবার তার তিনটি মামলা দেখানো হয়েছে। এর মধ্যে একটি মামলা বিচারাধীন ও অপর দুটি থেকে তিনি অব্যাহতি পেয়েছেন বলে উল্লেখ আছে।
জানতে চাইলে কালাই উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী মিনফুজুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি ব্যবসাও করেছি, এর জন্য প্রায় ২৫ লাখ টাকা ঋণ নিতে হয়েছে। তবে ব্যবসা থেকে আয় উল্লেখ না করার বিষয়টি ভুল হয়েছে। আর স্বর্ণের দামে লিখতে একটু সমস্যা হয়েছে। আমার যা আছে তাই তুলে ধরা হয়েছে।
ব্যাচেলর অব ফার্মেসি (অনার্স) পাশ করা মো. মিনফুজুর রহমান কালাইয়ের পুনট পাঁচপাইকা গ্রামের বাসিন্দা। তিনি ২০০৯ সালে প্রথমবারের মতো কালাই উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি টানা তিন বার কালাই উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের পদে আছেন। এরমধ্যে ২০১৯ প্রথমবারের মতো তিনি আওয়ামী লীগের মনোনীত দলীয় প্রার্থী হিসেবে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করেছিলেন। এবার ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে তিনি আবারও উপজেলা চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী হয়েছেন। মিনফুজুর রহমান কালাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির পদে দায়িত্ব পালন করছেন।
এএএ