‘মা হবো ভাবলে কোনো কষ্টই কষ্ট মনে হতো না’

‘শ্বশুড়বাড়িতে মেহমানের হিড়িক। তাদের আপ্যায়নে ব্যস্ত সারাদিন। সকাল গড়িয়ে বিকেল, এরপর সন্ধ্যা। তখনো অর্ধহারে। কখন যে রাত হয়, সেটিও আঁচ করতে পারিনি। হঠাৎ শুরু হয় প্রসব যন্ত্রণা। তখনো একমুঠো ভাত পেটে যায়নি। ক্ষুধার্ত পেট কিছু খেতে চাইছিল। কিন্তু প্রসব যন্ত্রণায় সব ক্ষুধা যেন হারিয়ে যায় নিমিষেই। শুধুই ছটফট করছিলাম। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি কষ্টটা তখন যেন পুরো শরীরজুড়ে ভর করেছিল। চোখ বেয়ে পানি ঝড়ছিল। অসহ্য ব্যথার যন্ত্রণায় দাঁতে দাঁত কেটে হু-হু করে কাঁদতে থাকি। সবাই হাত-পা শক্ত করে ধরছে। হঠাৎ এক কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে কানে। থমকে যাই, প্রসব ব্যথা যেন মুহূর্তেই শেষ। অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে দেখি সন্তানের মুখ। বুঝতে পারি আমি মা হয়েছি।’
প্রথম সন্তান প্রসবের দিনটির কথা বলছিলেন রংপুর মহানগরীর শাপলা চত্বর হাজীপাড়া এলাকার বাসিন্দা ফাতেমা বেগম। যে যন্ত্রণা আর অসহ্য ব্যথা সয়ে তিনি এখন ‘মা’। তার কোলজুড়ে একে একে এসেছে চার সন্তান। তাদের মধ্যে প্রথম সন্তানের সঙ্গে মায়ের নাড়ির যে টান, তা ভুলে যাওয়ার মতো নয় বলে মনে করেন ফাতেমা বেগম।
মা হওয়ার মধ্য দিয়ে সংসার জীবনে পূর্ণতা এসেছে তার। সমাজের অন্য আর দশজনের মতো মা না হতে পারার অপবাদ, লাঞ্ছনা বা বঞ্ছনা থেকে মুক্তি পেয়েছেন তিনি। কিন্তু মা হতে গিয়ে সন্তান গর্ভে ধারণ করে প্রতিনিয়ত তাকে সহ্য করতে হয় অবর্ণণীয় কষ্ট। আঠারোর আগেই বিয়ের পিুঁড়িতে বসা তাঁর অসচ্ছল স্বামীর কাঁধে তখন সংসারের বোঝা সামলানোটা ছিল বেশ কঠিন। এ কারণে শ্বশুড়বাড়িতে সবার পাতে ভাত পৌঁছাবার পর তার প্লেটে জুটতো একমুঠো ভাত। অনাগত সন্তানের পুষ্টি তো দূরের কথা, নিজেই তিন বেলা পেট ভরে খেতে পারতেন না।
ফাতেমা বেগম জানান, সন্তান গর্ভধারণের পর থেকে তার অসুখ-বিসুখ হতে থাকে। তিন মাস বিছানায় ছিলেন। ঠিক মতো চলাফেরা করতে পারেননি। গোদ রোগে আক্রান্ত রোগীর মতো তার পা দুটো ফুলে উঠেছিল। গ্রামের যে যেমন পরামর্শ দিয়েছে সন্তানের কথা ভেবে তাই করেছেন। কখনো কবিরাজের তাবিজ নয়তো হুজুরের ঝাড়ফুঁকে খুঁজেছেন সুস্থতার মন্ত্র।
তিনি বলেন, গর্ভাবস্থায় একটার পর একটা অসুখ লেগেই ছিল। অসুস্থ শরীর নিয়েই শ্বশুড়বাড়িতে রান্নাবান্নার কাজ করতে হতো। স্বামী-সংসার সামলাতে হতো। হঠাৎ পা ফুলে যায়। খালা শাশুড়িকে নিয়ে হেঁটে হেঁটে কবিরাজের বাড়ি যেতাম। সেখান থেকে এসে আবার রান্নার কাজ করতাম। কষ্টের কমতি ছিল না। ওই সময়ে আমার চিকিৎসায় দশ হাজার টাকা খরচ হয়। তখন শুধু মনের মধ্যে একটাই সান্তনা ছিল ‘মা’ হতে যাচ্ছি। সন্তানের কথা ভাবলে কোনো কষ্টই কষ্ট মনে হতো না। আমার সেই সন্তানকে কেউ যদি কোনো কষ্ট দেয় আমি সহ্য করতে পারি না। বুকের ভেতরে তখন কিছু একটা যেন আঘাত করে।
সন্তান প্রসবের সেই দিনটির কথা বলতে গিয়ে ফাতেমা বেগম বলেন, ওই দিন শুক্রবার রাত ছিল। আমার ছোট্ট ঘরটা ছিল মানুষ ভর্তি। হারিকেনের মিটিমিটি আলো জ্বলছিল। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ঘরে-বাইরে সবাই উৎকণ্ঠায়, আল্লাহ আল্লাহ করছিল। কারণ তখন আমি সবেমাত্র সুস্থ হয়েছি। এরই মধ্যে প্রসব ব্যথা ওঠে। আমার মা-খালা-শাশুড়িসহ বাড়ির অন্যরাও তখন পাশে ছিলেন। মনে হচ্ছিল মৃত্যুর কোনো এক অসহ্য ব্যথার যন্ত্রণায় আমার প্রাণটা বেরিয়ে যাচ্ছে। এখনকার মতো তখন এতো ওষুধপাতি, আধুনিক চিকিৎসা ছিল না। কিছু হলেই সবাই কবিরাজের কাছে নয়তো হুজুরের কাছে যেত। আমার বেলায়ও তাই হয়েছিল। আল্লাহর রহমতে সন্তানের মা হয়েছি। কিন্তু আমার সেই সন্তান জন্মের পর থেকেই অসুস্থ ছিল। একটার পর একটা অসুখ হয়।
যে বয়সে বইখাতা নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথা ছিল। সেই বয়সে মা হন ফাতেমা। অনেক না বলা কষ্ট পুষে স্বামী-সন্তান-সংসার আগলে রাখেন তিনি। যৌথ পরিবারে সবার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে অনেক সময় নানান রকম সমস্যা হলেও শুধু সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে নীরবে সয়ে গেছেন। তার মন সব সময় কাঁদতো ‘সন্তানের অসুখে’। জন্মের পর থেকে তার নবজাতক শিশুটি শুধু বমি আর পাতলা পায়খানা করতো। অপুষ্টিতে ভুগতে থাকায় শিশুর শরীরের চামড়া ছিল ঝুলঝুলে, যেন বয়স্ক কোনো মানুষ।
ফাতেমা বেগম বলেন, আমার প্রথম সন্তানের মতো কষ্ট অন্য তিনজনের বেলায় হয়নি। আমি যখন অন্তঃসত্ত্বা হই, তখন নিজেই টানা তিন-চার মাস অসুস্থ ছিলাম। প্রসবের পর থেকে আমার সন্তান অসুস্থ হয়। বুকের দুধ খাওয়াতে পারতাম না। ওর (সন্তানের) অসুখের কারণে সবাই আমাকে বকাবকি করতো। শুধু একটা বছর বমি আর পাতলা পায়খানা করেছে। কোনো খাবার পেটে থাকত না। অনেক চিকিৎসা করেছি। শেষ পর্যন্ত অসুখ না কমায় সন্তান হাতবদল (অন্যের কাছে দেওয়া) করেছিলাম। আমার খালা শাশুড়ি ওকে (বাচ্চাকে) নিয়েছিল। চারআনা পয়সার বিনিময়ে সন্তান হাতবদল করে আমার আঁচলে মুড়ি দেন তারা। তখন গ্রামে এসবের প্রচলন ছিল। এখন মানুষ শুনলে বলে সামাজিক কুসংস্কার। অথচ সন্তানের ভালোর জন্য যে যেটা পরামর্শ দিয়েছিল সবই করেছি। কোনটা কুসংস্কার, আর কোনটা সঠিক ছিল না তা ভেবে দেখেনি।
তিনি জানান, তার প্রথম সন্তান ছিল শান্ত প্রকৃতির। যখন যেখানে বসিয়ে রাখতো সেখানেই পুতুলের মতো বসে থাকতো। দেড় বছর বয়সেও হাঁটতো না, বসে থাকতে থাকতে কোমরের নিচে ঘা হয়েছিল। অনেক চিকিৎসা আর পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানোর পর ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে। পাঁচ বছর না যেতেই তার সেই সন্তান হার্নিয়া রোগে আক্রান্ত হয়। ওই রোগের চিকিৎসা চলাকালে নতুন করে চর্মরোগও দেখা দেয়। যেন একটার পর একটা অসুখ লেগেই ছিল। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সুস্থতা ফিরেছে। তার সেই সন্তান বড় হয়েছে। আগের সেই অসুখ-বিসুখ নেই। কিন্তু এখনো তার সন্তানের সামান্য জ্বর হলে তিনি সহ্য করতে পারেন না।
‘একবার এক বর্ষা মৌসুমে রাতে ঘরে পানি ঢুকেছিল। বিছানা ছুঁইছুঁই পানি। বাইরে ঝড়ের শব্দ। হারিকেনের আলো নিভে যায় আচমকা বাতাসে। ওর বাবা জেগে দেখে বিছানায় বাচ্চা নেই। সঙ্গে সঙ্গে উঠে দেখি বাচ্চা চকি থেকে পড়ে গিয়ে বিছানার এক কোণে আটকে আছে। ওর শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। সেদিন যদি ওর বাবা ওই অবস্থায় দেখতে না পেত, তাহলে হয়তো আমার কষ্টের ধনকে বাঁচাতে পাড়তাম না।’ -যোগ করেন মা ফাতেমা বেগম।
১৯৮৪ সালে বিয়ে হয় ফাতেমা বেগমের। স্বামী এম এ মজিদ ছিলেন চিত্রশিল্পী (আর্টিস্ট)। মঞ্চ এবং বেতার নাটকে অভিনয়ের পাশাপাশি রংপুরের আঞ্চলিক ভাষার প্রচার-প্রসারে ভাওয়াইয়া নিয়ে দীর্ঘ সময় কাজও করেছেন এম এ মজিদ। নির্মাণ করেছেন প্রায় অর্ধশত অডিও এবং ভিজ্যুয়াল অ্যালবাম। নাটকপাড়া ছেড়ে বর্তমানে রংপুর সিটি কর্পোরেশনে চাকরি করছেন তিনি।
ফাতেমা-মজিদ দম্পতির বিয়ের দুই বছর না যেতেই প্রথম ছেলে সন্তানের জন্ম হয়। এর পাঁচ বছর পর কোলে আসে কন্যা সন্তান। এখন দুই ছেলে ও দুই মেয়ে সন্তানের জননী ফাতেমা। নিজে পড়ালেখা না জানলেও সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে ভুল করেননি। তার সন্তানদের মধ্যে তিনজনের বিয়ে হয়েছে। বর্তমানে ছোট ছেলে ফাহিম মুরশেদ রংপুরের একটি বেসরকারি কলেজে পড়ালেখা করছে। সংসার জীবনের শুরুতে যে কষ্ট করেছেন তিনি, তা এখন আর নেই। স্বামীর চাকরির মধ্য দিয়ে সংসারে সচ্ছলতা ফিরেছে।
৩৮ বছর পর নিজের মা হবার অনুভূতির কথা যখন বলছিলেন, তখন ফাতেমা বেগমকে অশ্রুসিক্ত চাপা কান্না করতে দেখা যায়। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সব ছেলে-মেয়ের জন্য কষ্ট করেছি। ওরা সবাই আমার কাছে সমান। আজ যখন নিজে মা হিসেবে কথা বলছি তখন আমার মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে। আমার এক ছেলে ও দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। দুইজনের দুটি বাচ্চা রয়েছে। আজ আমার মা-বাবা বেঁচে থাকলে কত খুশি হতো।’
ফাতেমা-মজিদ দম্পতি রংপুর মহানগরীর শাপলা চত্বর হাজীপাড়া এলাকার বাসিন্দা। তাদের চার সন্তানের মধ্যে বড় দুই ছেলে-মেয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন। ছোট মেয়ে স্নাতক সম্পন্ন করে ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প নিয়ে কাজ করছেন। তাদের বড় ছেলে সাংবাদিকতা করছেন। বড় মেয়ে ছাড়া বাকিরা সবাই এক সঙ্গেই থাকছেন। ছেলের সাংবাদিকতা পেশাকে ভালোবাসেন তারা। তাদের উৎসাহে দীর্ঘদিন ধরে লেখালেখি করছেন বড় ছেলে।
এ প্রসঙ্গে ফাতেমা বেগম বলেন, অনেকেই বলে আমার ছেলে নাকি বেকার। কিছু করে না। তাদের কাছে হয়তো সাংবাদিকতা কিছু না, কিন্তু আমার কাছে অনেক কিছু। ওর লেখালেখিতে অনেকের উপকার হয়েছে। কত মানুষকে দেখেছি ওকে (ছেলেকে) আদর স্নেহ ও ভালোবাসতে। আমি তো চাই আমার সন্তানদের মানুষ ভালোবাসুক, সম্মান করুক। ধন, সম্পদ, রিজিক এসব তো আল্লাহর হাতে, তাই ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করি না। শুধু চিন্তা করি আল্লাহ যেন ওদেরকে সবসময় ভালো রাখেন, এটা সব মা-বাবাই চায়।
নিজের মা সম্পর্কে ছোট ছেলে ফাহিম মুরশেদ বলেন, আমার মা সবার মায়ের চেয়ে ভিন্ন এবং অনন্য। অনেক বেশি ধৈর্য্যশীল আমার মা। আমাদের জন্য আগেও কষ্ট করেছেন, এখনো করছেন। কত ধরনের কষ্ট যে তাকে সইতে হয়, তা আমরা উপলব্ধি করতে পারি। আমরা ভাই-বোনেরা মা-বাবাকে ভালোবাসি, আমাদের মা-বাবাও আমাদের ভালোবাসেন। কিন্তু সব সময় কেন জানি মনে হয় মা আমাকেই বেশি ভালোবাসে। যদিও এ নিয়ে পরিবারে আমরা ভাই-বোনেরা প্রায়ই খুনসুঁটি করি। আমরা ভাগ্যবান আমাদের মা-বাবা আছে। কারণ পৃথিবীতে যার মা-বাবা আছে, সে গরিব নয়।
কিছু বলার আগেই আপ্লুত হয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদেন বড় ছেলে ফরহাদুজ্জামান ফারুক। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বলেন, আমি তো সাংবাদিক হয়েছি আমার মায়ের জন্য, বাবার জন্য। যে নৈতিকতার শিক্ষা আমার মা-বাবা দিয়েছেন সেটাও তো আমার বড় অর্জন। আমার জন্য কত কষ্টই না করতে হয়েছে তাদের। আমি বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত এখনো আমার মা রাত জেগে থাকেন। রংপুরের বাইরে গেলে বারবার ফোন করে খোঁজ নেন। আর আমার বাবা আমার শিক্ষক। তাদের ঋণ কখনোই শোধ করার মতো নয়। আল্লাহর কাছে একটাই চাওয়া আমি যেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমার মা-বাবার সঙ্গে থাকতে পারি। জীবনযুদ্ধে মা-বাবা পাশে থাকলে অন্য কারো আশীর্বাদ, শক্তি, সাহসের প্রয়োজন হয় না।
তিনি আরও বলেন, মা আমাদের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। মাকে হয়তো আলাদা করে মুখ ফুটে আমরা ভালোবাসার কথা বলতে পারি না। আমার কাছে মনে হয়- আমার মা তার পুরো জীবনটাই পরিবার এবং সন্তানের জন্য উৎসর্গ করেছেন। মা আমার জীবনের প্রথম শিক্ষক, মায়ের কাছেই কথা বলতে শেখা। মা ছাড়া এই পৃথিবী কী কখনো এত সুন্দর হতো? কখনো কী এত ভালোলাগায় ভরে উঠতো চারপাশ? মায়ের চোখেই দেখেছি পৃথিবীর প্রথম আলো, মাকে ভালো না বেসে কি থাকা যায়। শুধু বিশেষ দিন কিংবা দিবসে নয়, প্রতিদিনই পৃথিবীর সবটুকু ভালোবাসা হোক মায়ের জন্য।
আরএআর