গণিতের শিক্ষক নেই ১৬ বছর, ইংরেজির দুই বছর

এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলে রাজশাহী শিক্ষাবোর্ডের দুটি স্কুলের কোন পরীক্ষার্থী পাস করেনি। ফলে স্কুল দুটির ০% ফলাফল প্রাপ্ত স্কুলের তালিকায় নাম উঠেছে।
গেল আট বছরে এমন শতভাগ ফেল করা স্কুলের সংখ্যা শিক্ষাবোর্ডে রয়েছে আটটি। চারপাশে শতভাগ পাসের মধ্যে শতভাগ ফেল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিব্রত করে শিক্ষাবোর্ডকে।
এমন স্কুলগুলোর বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের ব্যবস্থা গ্রহণ প্রকাশ্যে এলেও প্রতিষ্ঠানগুলোর ফল বিপর্যয়ের পেছনে নির্দিষ্ট বিষয়ে ফেল, শিক্ষক না থাকা, নিয়মিত ক্লাস না হওয়া, বাল্য বিয়েকে দায়ী করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
রাজশাহী শিক্ষাবোর্ডে গত আট বছরের এসএসসির ফলাফল পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০১৭ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত কোনো বছরে একটি এবং কোনো বছর দুইটি স্কুল ০% ফলাফল প্রাপ্তির তালিকায় এসেছে। এরমধ্যে ২০১৭ সালে শতভাগ ফেল করা স্কুল ছিল একটি, ২০১৮-২০১৯ সালে একটি করে, আর ২০২০-২০২১ সালে শতভাগ ফেল করা স্কুল না থাকলেও ২০২২ সালে ছিল ২টি স্কুল। ২০২৩ সালে একটি স্কুল থাকলেও সর্বশেষ ২০২৪ সালের এসএসসি ফলাফলে দেখা গেছে শতভাগ ফেলের তালিকায় রয়েছে দুইটি স্কুল।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শতভাগ ফেল করা এসব স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থী ছাড়াও শিক্ষকের সঙ্কট রয়েছে। ফলে স্কুলগুলোতে নিয়মিত ক্লাস নিয়ে এক ধরনের টানাপোড়েন নিত্যদিনের। কোনো কোনো স্কুলে বছরের পর বছর নেই নির্দিষ্ট বিষয়ের শিক্ষক। আবার কোনো কোনো স্কুলে শিক্ষার্থী বা পরীক্ষার্থী হাতেগোণা কয়েকজন।
তবে এবার শতভাগ ফেল করা রাজশাহী শিক্ষাবোর্ডের রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার ঢোরসা আদর্শ হাই স্কুলের একজন পরীক্ষার্থী ও নওগাঁর আত্রাই উপজেলার বরাইকুড়ি আইডিয়াল গালর্স হাই স্কুলের পাঁচজন পরীক্ষার্থী ছিল। তারা সবাই ফেল করেছে। একই সাথে স্কুল দুটির এমপিও নেই বলেও জানা গেছে।
জানা গেছে, শিক্ষক আর শিক্ষার্থী খরার মধ্যে চলে নওগাঁর আত্রাইয়ের বড়াইকুড়ি আদর্শ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়টি। এবছর ৫ জন পরীক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়। গত বছর (২০২৩) বিদ্যালয় থেকে ছয়জন এসএসসি পরীক্ষা দিলে একজন ফেল করে। এ বছরের এমন ফলফলের পেছনে শিক্ষক না থাকাকে দায়ী করেছেন প্রধান শিক্ষক নবীর উদ্দিন। তিনি এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জে ফলাফল পরিবর্তনের আশাও প্রকাশ করেন।
২০০৪ সাল থেকে বড়াইকুড়ি আদর্শ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়। সেই বছর থেকে ফেলের এমন রেকর্ড নেই বিদ্যালয়টির। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত চলা স্কুলটিতে সাতজন শিক্ষক রয়েছে। বালিকা এই বিদ্যালয়টিতে কখনো তিনজন, কখনো চারজন এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। এমপিও না থাকায় বিদ্যালয়টির বড় সমস্যা শিক্ষক সঙ্কট। বিভিন্ন সময় বিদ্যালয়ের বিসএসি পাস কেরানিসহ অন্য সহকারী শিক্ষকরা নিয়েছে গণিত বিষয়ের ক্লাস। কথাটি অকপটে বললেও পরবর্তীতে অস্বীকার করেন প্রধান শিক্ষক নবীর উদ্দিন।
তিনি বলেন, ২০০৭ সাল থেকে গণিত বিষয়ের শিক্ষক নেই। গণিত বিষয়ের ক্লাস নেয় অন্য সহকারী শিক্ষক ও কৃষি শিক্ষক। তার স্কুল থেকে এ বছর পাঁচজন ছাত্রী এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়। সকলেই গণিত বিষয়ে ফেল করেছে।
‘দীর্ঘদিন ধরে গণিত বিষয়ের কোন শিক্ষক নেই। তার পরেও বিগত বছরে ছয়জন এসএসসি দিলে পাঁচজন পাস করে। এমন ভরাডুবি ফলাফল হয়নি এর আগে।’
এ বিষয়ে বড়াইকুড়ি আদর্শ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি মখলেসুর রহমান বলেন, স্কুলের অতিতে এমন রেকর্ড নেই। তাদের অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত এমপিও রয়েছে। নবম-দশম শ্রেণির পাঠাদান ও পরীক্ষার অনুমতি রয়েছে। গণিত বিষয়ের শিক্ষক অনেক দিন থেকে নেই। আর দুই বছর আগে ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক মারা যাওয়ার পরে ওই পদ ফাঁকা আছে। তবে চাহিদা পাঠানো হয়েছে।
শতভাগ ফেলের কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘এমন খারাপ ফলাফল কোন বছর হয়নি। শিক্ষক সঙ্কট ছাড়াও ছাত্রীদের বাল্যবিয়ে একটা বড় সমস্যা। এবার পাঁচজনের মধ্যে দুই ছাত্রী বিবাহিত ছিল। তারা পরীক্ষা দিয়েছে। তবে শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে যতটুকু জেনেছি তারা বলেছে, এতো খারাপ ফলাফল তাদের হওয়ার কথা না। কয়েকজন ফলাফল চ্যালেঞ্জ করতে চান।’
তবে বিষয়টি নিয়ে মোহনপুর উপজেলার ঢোরসা আদর্শ হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক আব্দুস সালামের মুঠোফোনে কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেনি। তাই এবিষয়ে তার কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
রাজশাহী মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শক মহা. জিয়াউল হক এ বিষয়ে মন্তব্য করতে চাননি। তবে রাজশাহী শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক আরিফুল হক বলেন, ‘ওই স্কুলগুলোর বিষয়ে মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। পুরো ব্যাপারটি বিদ্যালয় পরিদর্শক দেখে থাকেন। তবে আমরা (বিষয়টি) জানার চেষ্টা করব যে কেন এমন ফলাফল হলো।’
শাহিনুল আশিক/এসএমডব্লিউ