পদ্মার চরের রাখালদের গল্পগাথা

সকাল সাড়ে ৮টায় নৌকা ছাড়ার কথা থাকলেও সেই নৌকা ছাড়ল সাড়ে ৯টায়। যাত্রার উদ্দেশ্যে ওঠা নৌকাটি ঘোষদের। পেশায় দুধ দোহন করা এমন মানুষদের চলাচল করার নৌকা এটি। বসে থাকার কিছুক্ষণ পর ধীরে ধীরে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা খাবার নিয়ে আসছে। একে একে ১২ থেকে ১৫ জনের খাবার উঠল নৌকায়। পরে শোনা গেল এই খাবারগুলো যাবে পদ্মা নদীর মধ্য চরে। সেই চরে সবমিলিয়ে প্রায় পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার গরু, মহিষ ও ভেড়া রয়েছে। এই পশুগুলো দেখভাল করা রাখালদের খাবার এগুলো। খাবার নৌকাতে উঠতে উঠতে একে একে দুধের পাত্র নিয়ে নৌকায় উঠলেন চার থেকে পাঁচজন ঘোষ। নৌকাটি আমাদের নিয়ে রাজশাহী নগরীর মিজানের মোড়ের সাতবাড়িয়া ঘাট থেকে রওনা হয়ে শ্যামপুর ঘাট দিয়ে চারঘাট ঘুরে গেল পবা উপজেলার হরিয়ান ইউনিয়নের চরখিদিরপুরের ১০ নম্বর বা মিডল চরে।
নৌকায় কথা হয় স্থানীয় বাসিন্দা রকিবুলের সঙ্গে। তার ভাষ্য ভাঙা-গড়ার পদ্মায় ঘুরছে অর্থনীতির চাকা। প্রায় শুকিয়ে যাওয়া পদ্মায় কেউ নৌকা, কেউ মাছ শিকার, কেউবা জমিতে চাষাবাদ করে আবার কেউ পশু পালন করে। এমন বিভিন্ন উপায়ে পদ্মার পানি ও জেগে থাকা চরে রুজি-রুটির ব্যবস্থা হচ্ছে শত শত মানুষের। একদিনে নিজ ও পরিবারের চাহিদা মিটে, অপরদিকে দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছে চরের মানুষ। গল্পের একপর্যায়ে ৪৫ মিনিটে নৌকা পৌঁছাল মিডেল চরে। নৌকা থেকে দেখা যাচ্ছে দূরে গরু, মহিষের বড় বড় পাল। একই সঙ্গে বাথান ও রাখালদের থাকার ছাউনি বা টাপর।
নৌকা ঘাটে ভিড়তেই রাখালরা এগিয়ে এলো খাবার নিতে। তারা নৌকা থেকে খাবারগুলো নিয়ে নিজ নিজ বাথানে চলে যাচ্ছে। এই কাজে ঘোষেরাও সহযোগিতা করছেন। বাথানে পৌঁছামাত্রই দুধ মাপার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন ঘোষরা। আগে থেকেই দুধ দোহনের কাজ সেরে রেখেছেন রাখালরা। এখন শুধু মাপা ও নৌকায় তোলার পালা। এই কাজে ঘোষদের সময় লাগে এক ঘণ্টারও বেশি। সেই নৌকা ছাড়তে ছাড়তে দুপুর দেড়টা। এই নৌকাতে সবাই চলে আসে। শুধু থেকে যায় রাখালরা। এই রাখাল ও দুধ দোহনের ঘোষেরা নগরী সাতবাড়িয়া ও শ্যামপুর এলাকার বাসিন্দা।

রাখাল জীবন, যাযাবর জীবন
রাখালরা মাসে দুই দিনের জন্য ছুটিতে বাড়ি ফেরে। তাদের এই যাযাবর জীবনে ঘরে ফেরার আকাঙ্ক্ষা কমই। তপ্ত বালুতে রোদে পুড়ে, পানিতে ভিজে দিনের পর দিন এ চর থেকে ও চর ছুটে বেড়ায়। মাথার ঘাম পায়ে ফেলার মজুরি হিসেবে দিনে ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা পান রাখালরা। পদ্মা নদীতে যতদূর চোখ যায়, ধু ধু বালুচর। কোথাও কোথাও সবুজ প্রান্তরে নীলচে আকাশ দূরের দিগন্তে গিয়ে একাকার হয়েছে। মাথার ওপরে সূর্য গলগলে সিসার মতো কড়া রোদ মেলে বসেছে। রোদ থেকে রেহাই পাওয়ারও কোনো বন্দোবস্ত নেই চারপাশে; না আছে গাছপালা, না কোনো ছাউনি।
তবে কখনো কখনো নৌকায় নদীতে কয়েকজন মানুষকে দেখা যাচ্ছে। পদ্মা নদীর বুকে ছাতি ফাটানো রোদেও লোকগুলোর কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই, একমনে নিজেদের কাজ করে যাচ্ছেন। তবে রাখালদের মাথার ওপর ছাতা, হাতে বড় লাঠি, ঘাড়ে গামছা, বগলে দুই লিটারের একটা পানির বোতল। তাদের মুখে ‘ওই যা যা, ঘুর ঘুর’ চলে অবিরাম।
রাখালরা ঢাকা পোস্টকে জানান, সারা বছরই তাদের পদ্মা নদীর চরে থাকতে হয়। কখনো এই চর তো কখনো অন্য চর। এভাবে যাযাবরের মধ্যে ছুটে চলতে হয়। খাওয়া-দাওয়ার ঠিক নেই। শহরে মালিকদের বাড়ি। সেখান থেকে খাবার এলে তিনবেলা খাওয়াদাওয়া করেন রাখালরা। এ ছাড়া খাবারের ব্যবস্থা নেই। সবচেয়ে বেশি সমস্যা বর্ষার সময়ে। সব সময় প্রস্তুত থাকতে হয় কখন বন্যা এসে সবকিছু তলিয়ে নিয়ে যাবে এই ভয়ে। এ ছাড়া চরে আছে সাপের ভয়। সেজন্য সাবধানে চলাচল করতে হয় পশুর পাল নিয়ে।
দিনরাত বাথানে কাটে রাখালদের
২৪ ঘণ্টাই চরে গরুর সঙ্গে থাকতে হয়। সারাদিন বিভিন্ন চরে ঘাস খাওয়ানোর পর সন্ধ্যায় বাথানে নিয়ে আসতে হয় পশুগুলোকে। বাথান বলতে সাধারণত বোঝায় মাচার উপরে টাপর দেওয়া। তার পাশে খোলা আকাশের নিচে বাথান তৈরি করা হয়। বাথানের চারপাশ বাঁশ দিয়ে ঘেরা থাকে। শুধু গরু যেন বাইরে যেতে না পারে সেই জন্য। বাথানে থাকলেও শেয়াল ও কুকুরের আক্রমণ থেকে নিরাপদে থাকে পশু।
রাখাল আনসের আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, শেয়ালের উপদ্রব দেখা দিলে কখনো কখনো রাত জাগতে হয়। কারণ শেয়াল গরু ও ভেড়ার ছোট বাচ্চা নিয়ে যায়। এই থেকে সাবধানতার জন্য তাদের রাতে জেগে থাকতে হয়। তবে বর্তমানে জেগে থাকা লাগে না। রাতে উঠে একবার চারপাশে লাইট বা হারিকেন দিয়ে দেখলেই হয়। বাথানগুলোতে সারারাত জ্বলে হারিকেন। ভোররাতে বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর রাখাল গাভিগুলোর দুধ দোহন শুরু করে।

তিনি আরও বলেন, সকাল সাড়ে ১০টার দিকে নৌকায় করে ঘোষরা সকাল ও দুপুরের খাবার নিয়ে আসে। সকালের খাবার খাওয়া হলে রাখালরা বিভিন্ন চরে পশু নিয়ে বের হয় তাদের খাওয়ানোর সন্ধানে। বলতে গেলে সব সময় চরে পশুর পালের সঙ্গেই থাকতে হয় তাদের। সন্ধ্যায় ফিরে গরু ঠিকঠাক বাথানে রাখতে রাখতে রাত ১০টা পার হয়ে যায়। ততক্ষণে নৌকায় করে রাতের খাবার চলে আসে বাথানে। সব কাজ শেষে রাতের খাবার খাওয়ার পর ঘুমিয়ে যায় যে যার মতো। তবে এখানে খাবার পানি ও স্যানিটেশনের অসুবিধা সবচেয়ে বেশি। নদীর পানি খেয়ে থাকতে হয় তাদের।
নৌকায় খাবার আসে দুধ যায়
সাতবাড়িয়া ঘাট থেকে সকাল সাড়ে ৯টায় ছাড়ে ঘোষদের নৌকা। ঘাটে যে কাউকে বললে নৌকাটিকে চিনিয়ে দেবে। নৌকায় সকাল ৯টার মধ্যে রাখালদের খাবার চলে আসে। সেই খাবারগুলো নৌকায় রাখা হয়। এরপর ঘোষরা আসেন তাদের দুধের টিন (পাত্র) নিয়ে। এই চরের দুধ নেওয়ার জন্য চার থেকে পাঁচজন ঘোষ আসার পর ছাড়ে নৌকাটি।
পদ্মা নদীতে পানির স্বল্পতা থাকায় নগরীর সাতবাড়িয়া থেকে নৌকা ছেড়ে শ্যামপুর বালুর ঘাট হয়ে চারঘাট উপজেলা এলাকা দিয়ে যায় পবার মধ্যচরে। স্থানীয় ভাষায় মধ্যচরের নাম মিডলচর। মিডল চরে নৌকায় দাঁড়ানো মাত্র রাখাল ও ঘোষরা খাবারগুলো নিয়ে যায় বাথানে। আর বাথানগুলোতে আগে থেকেই গরু বা মহিষের দুধ দোহন করে রেখেছেন রাখালরা। খাবার দেওয়া শেষে রাখালরা দুধ মাপতে শুরু করেন। দুধ মাপা শেষে তারা আবার মাথায় করে নৌকার কাছে নিয়ে আসেন।
সেই সময় চরে থাকা ঘোষ ছাড়াও কৃষক ও মাঝিরা নৌকায় উঠেন নদী পারাপারের উদ্দেশ্যে। এই পারাপারের জন্য প্রত্যেককে দিতে হয় ২০ টাকা। আর ঘাটে দিতে হয় ১০ টাকা। নৌকা যে পথে যায় আবার সেই পথে ফিরে সাতবাড়িয়া ঘাটে ভিড়ে।
রাখালরাই গরুর চিকিৎসক
পদ্মা নদীর চরখিদিরপুরে মধ্যচরে রাখাল দিয়ে পশু পালন করেন সেন্টু। তিনি ঢাকা পোস্টকে জানান, পশু অসুস্থ হলেও প্রাণিসম্পদের কর্মীরা আসেন না। সেই ক্ষেত্রে তারা শহর থেকে চিকিৎসককে নিয়ে আসেন। তবে চরের গরুর মালিকদের পক্ষ থেকে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে বলা হলে তারা কখনও আসেন, আবার কখনও আসেন না। তারা এলেও ওষুধ পরে দেব বলে চলে যান, আর আসেন না। এখানে ৫ থেকে ৬ হাজার পশু আছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের আচরণ দায়িত্বশীলের মতো না বলে জানান তিনি। নিজেরা যা পারেন তা করেন। বাঁচলে বাঁচলো না হলে মারা যায়। চরের যোগাযোগব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় সবচেয়ে বেশি সমস্যা। তাই চিকিৎসকরা আসতে চান না।

সকাল ৯টার আগে গরুর দুধ দোহন করা হয়। এরপর নদীতে পানি খাওয়ানো হয়। পানি খাওয়ানোর পর নিয়ে যেতে হয় বিভিন্ন চরে। যে চরগুলোতে ঘাস, লতাপাতা রয়েছে সেগুলোতে সন্ধ্যা পর্যন্ত পশু নিয়ে থাকতে হয়। সন্ধ্যায় আবার ফিরে বাথানে আসতে হয়। এর মধ্যে কোনো গরু অসুস্থ হলে তাকে নিয়ে আসতে হয়। অনেক সময় নাপা বা ব্যথার ওষুধ খাওয়ানো হয়। এই চরে তিন থেকে চারজনকে ৫০০ থেকে সাড়ে ৫০০ পশু সামাল দিতে হয়। পালগুলোতে ছাগল না থাকলেও রয়েছে গরু, মহিষ ও ভেড়া।
তিনি বলেন, এই চরে বেশ কয়েকটি এমন বাথান রয়েছে যে বাথানগুলোতে তিন থেকে পাঁচজন পর্যন্ত রাখাল রয়েছে। সেই রাখালরা ভোরে উঠে একে একে সব গাভির দুধ দোহন করেন। দুধ দোহন শেষে তারা খাবারের জন্য অপেক্ষা করেন। নৌকায় খাবার এলে তারা সেই খাবার খেয়ে আবার পদ্মা নদীতে জেগে ওঠা বিভিন্ন চরে গরুগুলোকে নিয়ে যায়। তার আগে ঘোষরা নৌকায় এসে বাথানগুলো থেকে দুধ সংগ্রহ করে নিয়ে যান।
পশুগুলো রাতে রাখার বিষয়ে সেন্টু বলেন, বাথানে আসার পর গরুগুলো বাইরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে। এরপর চারপাশে বাঁশ দিয়ে ঘেরা বাথানে রাখা হয়। সেখানে গরুগুলো সারারাত থাকে। এই চরে বেশ কয়েকটি কুকুর রয়েছে। এই কুকুরগুলো সন্ধ্যা নামলে বাথানের আশপাশে এসে থাকে। বাথানের রাখালরা সকাল, দুপুর ও রাতে যা খায় সেই খাবারের কিছু অংশ কুকুরগুলোকে দেয়। ফলে চর থেকে আর কুকুরগুলো কোথাও যায় না।
রাখালরাই পশুর ধাত্রী
গরুর মালিকরা বাথানে গরু-মহিষ বুঝিয়ে দেন। এরপর সব দায়িত্ব রাখালদের। খাওয়া-দাওয়া ও গোসল এবং চিকিৎসা থেকে শুরু করে সব কাজ করতে হয় রাখালদের। এমনকি কোনো গরু বা মহিষের বাচ্চা হলে রাখালরাই সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়।
গরুর মালিক আতিক বলেন, কোনো গরু বা মহিষ বাচ্চা প্রসব করলে রাখালরাই সব করে। তারা এই কাজে যথেষ্ট পারদর্শী। গরুর বাচ্চা হওয়ার পর সেই বাচ্চার যত্ন নেওয়া থেকে দুধ খাওয়ানো সব কাজ করে রাখালরা। অনেক সময় ছোট বাচ্চারা হাঁটতে পারে না। তাদের কোলে বা কাঁধে করে বাথানে নিয়ে আসে রাখালেরা। বাচ্চা হওয়ার পর রাখালেরা মালিকদের খবর দেয়। অনেক সময় গরুর মালিক খুশি হয়ে রাখালদের গেঞ্জি বা গামছা উপহার দেয়। কেউ কেউ নগদ টাকাও দেন।
তিনি আরও বলেন, কোনো গাভি গাভিন (গর্ভবতী) হলে নজরে রাখেন রাখালরা। অসুখ হলে তারা গরুর মালিকদের জানান। এরপর গরুর মালিক বা রাখালরা চিকিৎসক ডেকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে থাকেন। তখন শহর থেকে চিকিৎসক এসে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। তবে চরের গরুর অসুখ-বিসুখ খুব কম হয়। তারপরও সতর্ক থাকতে হয় তাদের।

চরের দুধের কদর বেশি শহরে
চরের আবহাওয়া গরম হওয়ার কারণে দুধ নষ্টের হাত থেকে রক্ষার জন্য দোহনের পর নদীর পানিতে দুধের পাত্র চুবিয়ে রাখেন রাখাল ও ঘোষরা। এরপর বাথানগুলো থেকে দুধ সংগ্রহ শেষে ঘোষরা একসঙ্গে দুধগুলো নৌকায় তোলেন। তবে দুধ কিনতে ইচ্ছুক এমন অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে থাকে এই নদীর ঘাটে। দুধ নদীর বাঁধের উপর তোলার পর কেউ এক লিটার, কেউ দুই লিটার, কেউবা তিন থেকে পাঁচ লিটার দুধ নেন। রাজশাহীর পাড়া-মহল্লা ও দোকানে যে দুধ পাওয়া যায় তার লিটার ৮০ টাকা। কিন্তু চরের দুধের লিটার ৬০ থেকে ৬৫ টাকা। দামেও তুলনামূলক কম হওয়ায় চাহিদাও ভালো। পরবর্তী সময়ে এই দুধ রাজশাহীর বিভিন্ন মিষ্টান্ন ভান্ডারে বিক্রি করা হয়।
তবে গরুর মালিক ও রাখালরা জানান, চরের গরু থেকে দুধ পাওয়া মুখ্য বিষয় না। গরুর দুধ পরিমাণে অনেক কম হয়। মাসে যে টাকার দুধ বিক্রি হয় তা দিয়ে কিছুই হয় না। কারণ একটি গাভি থেকে গড়ে এক কেজির কম-বেশি দুধ পাওয়া যায়। যেখানে শহরে কমপক্ষে ৫ কেজি। তাদের মূল উদ্দেশ্য গরু লালনপালন করা। তারপর দুধ থেকে যে টাকা আসে তা ভারতি আয় হিসেবে ধরে থাকেন।
দুধের ক্রেতা নুরুল ইসলাম বলেন, চরের গরুর দুধ মানে ও গুণে ভালো। কারণ চরে ঘাস আর লতাপাতা ছাড়া গরুকে তেমন খাবার দেওয়া হয় না। শহরের গরুতে দুধ হয় তিন থেকে পাঁচ লিটারের বেশি। আর চরের গরুর দুধ হয় মাত্র ১ লিটার বা তারও কম। এই দুধের কদর সারা বছরই থাকে।
পশুর সঙ্গে নিজেদের সতর্কতা
খোলা আকাশের নিচে ধু-ধু মরুভূমি। পানি আর বালু ছাড়া কোথাও কিছু নেই। বর্ষাকালে বন্যা ও বজ্রপাত নিয়ে সতর্ক থাকতে হয়। শুধু তাই নয়, অনেক সময় ঝড় উঠে নদীতে। তখন মুখমণ্ডল ঢেকে বাথানের টাপরের নিচে লুকিয়ে থাকতে হয়। এ ছাড়া এখানে রয়েছে সাপের ভয়। গত বছর এই চরে রাসেলস ভাইপারের কামড়ে এক রাখালের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে রাখালদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক রয়েছে। এ ছাড়া অনেক সময় গরুও শিং দিয়ে গুতো দেয়। রাতে অসুস্থ হলে চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা নেই। সকাল হলে নৌকায় করে শহরে আনতে হয়। চর এলাকায় চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই অনেক সময় নাপা ও গ্যাসের ওষুধ রাখা হয়। সেই সঙ্গে খাবার পানির প্রচুর অভাব রয়েছে। আর চরে টয়লেটের ব্যবস্থা নাজুক।
বজ্রপাতে গরু মরে প্রতি বছর
গত ৭ মে দিবাগত রাতে পবা উপজেলার হরিয়ান ইউনিয়নের পদ্মা নদীর চরখানপুরে বজ্রপাতে আটটি গরুর মৃত্যু হয়। সেদিন রাতে রাজশাহীতে ৫১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে বলে জানায় আবহাওয়া অফিস। এই বৃষ্টিপাত রাত ১টা থেকে শুরু হয়ে ভোর ৫টা পর্যন্ত চলে। বৃষ্টির সময় বিকট শব্দে বজ্রপাত হচ্ছিল। এতে চরে খোলা আকাশের নিচে থাকা শত শত গরুর মধ্যে আটটি গরু মারা গেছে। এর মধ্যে দুইটি ষাঁড় ও ছয়টি গাভি। এই ঘটনায় কয়েকটি গরু আহত হয়েছে।

মৃত গরুগুলোর মধ্যে সফিকুল ইসলাম, সেলিম ও শরিফের দুইটি করে এবং বাবু ও সাদ্দামের একটি। বজ্রপাতে গরুগুলোর মৃত্যুতে তাদের ছয় থেকে সাড়ে ছয় লাখ টাকার ক্ষতি হয়।
চরে গরু আছে এমন এক ব্যক্তি জানান, ২০২২ সালে বজ্রপাতের তার তিনটি গরুর শরীর পুড়ে ফোঁসা ফোঁসা হয়ে গিয়েছিল। সর্বশেষ গত বছর বজ্রপাতের এই চরে তার দুইটি গরুর মৃত্যু হয়। অন্য একজনেরও দুইটি গরুর মৃত্যু হয় এই চরে। এতে তার এক লাখ টাকার ক্ষতি হয়।
ক্ষতিপূরণের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বজ্রপাতে ক্ষতি হলে যে ক্ষতিপূরণ পাওয়া যায় তা আমরা জানি না। আমাদের কেউ কোনোদিন বলেনি। যদি জানতাম তাহলে ইউএনও (উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা) অফিসে দরখাস্ত দিতাম।
তিনি আরও বলেন, প্রতি বছর বজ্রপাতে তিন থেকে চারটি গরুর মৃত্যু হয়। এই বছরও (২০২৪) বজ্রপাতে একরাতে আটটি গরুর মারা গেছে। পরে গরুগুলো নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। বজ্রপাত ছাড়াও বিভিন্ন অসুখ হয় গরুর। সেই অসুখের চিকিৎসায় শহর থেকে চিকিৎসক ডেকে আনতে হয় চরে। এরপর তারা গরুর চিকিৎসা দেন। তাদের দাবি- সরকারিভাবে তারা কোনো সহযোগিতা পান না পশুর চিকিৎসার বিষয়ে।
গরুর মালিক সফিকুল ইসলাম জানান, চরের সব গরু খোলা আকাশের নিচে থাকে। প্রতিদিনের মতো গত ৭ মে দিবাগত রাতেও ছিল। গভীর রাতে বৃষ্টিপাতের সময় বজ্রপাতের কারণে আটটি গরুর মৃত্যু হয়েছে। এতে তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

বিষয়টি নিয়ে কথা হয় পশু চিকিৎসক নজরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, কোনো পশু অসুস্থ হলে আমাদের খবর দেন। আমরা শহর থেকে প্রয়োজনীয় ওষুধ কিনে নিয়ে চরে যাই। তবে তুলনামূলক চরের গরুর অসুখ কম হয়। জ্বর বা ছোট অসুখগুলোর জন্য কোনো ধরনের চিকিৎসা তারা করান না। সাধারণত বাদলাসহ বিভিন্ন অসুখের টিকাগুলো ঠিকমতো তারা করান না। চরে সবচেয়ে বড় সমস্যা যোগাযোগ। চরে কোনো চিকিৎসক আসতে চান না। চরে এলে দীর্ঘক্ষণ নৌকার জন্য অপেক্ষা করতে হয়।
এ বিষয়ে রাজশাহী জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. জুলফিকার আখতার হোসেন জানান, চরে পশু অসুস্থ হলে তারা চিকিৎসাসেবা দিয়ে থাকেন। এ ছাড়া নিয়মিত ভ্যাকসিনও প্রদান করা হয়।
পবার ৮ নম্বর হরিয়ান ইউনিয়নের মেম্বার সহিদুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, চরে প্রতি বছর বজ্রপাতে গরুর মৃত্যু হয়। এই বছরও পদ্মার মিডলচরে কয়েকজনের আটটি গরু মারা গেছে। এতে গরুর মালিকরা আর্থিকভাবে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এই চরে যোগাযোগ ভালো না হওয়ার কারণে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের চিকিৎসকরা ঠিকমতো আসেন না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পবা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবু সালেহ্ মোহাম্মদ হাসনাত জানান, বিষয়টি তার জানা নেই। তবে বজ্রপাতে কারও ক্ষতি হলে নির্ধারিত ফরমে আবেদন করলে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা হয়।
এমজেইউ