এখনও কম মজুরিতে চলে নারীর জীবনের চাকা
সিরাজগঞ্জ জেলার বিভিন্ন প্রান্তে নানান প্রতিষ্ঠান ও মাঠে পুরুষের পাশাপাশি নিরলসভাবে শ্রমিকের কাজ করে যাচ্ছেন অসংখ্য নারী শ্রমিক। যাদের জীবনের প্রতিকূলতা ও মজুরি তারতম্যের অসংখ্য গল্প থাকলেও এর অবসান হয়নি আজও।
বিড়ি তৈরি, চাতালে শ্রমিকের কাজ, শুঁটকি প্রক্রিয়াকরণ থেকে ধান লাগানো পর্যন্ত পুরুষের পাশাপাশি কাজ করে যাচ্ছেন নারীরাও। কিন্তু কখনো কর্মস্থলে নিরাপদ পরিবেশের পাশাপাশি মজুরি বৈষম্য তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী হলেও এর অবসান হয়নি।
সদরের বনবাড়িয়া এলাকার রতন বিড়ি কারখানায় কাজ করেন ৮০ জনের মতো শ্রমিক। এর মধ্যে ৩৫ থেকে ৪০ জন নারী। বেশিরভাগই অবশ্য বাড়ি থেকে কাজ করে নিয়ে আসেন। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, নারী-পুরুষ শ্রমিক মনোযোগ দিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন।
তবে সবাই বলেন, বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে অবহেলিত বিড়ি শ্রমিকরা। সেখানকার শ্রমিক নেতা আব্দুর রাজ্জাক ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রথমে সাদা কাগজ নিয়ে বিড়ির খোল বানাতে হয়, সেটাতে জুড়তে হয় পট্টি। তারপরে এর ভেতরে তামাক ভরতে হয়। তারপরে মুখ ভেঙে নির্দিষ্ট পলিতে ঢুকিয়ে মুখ পুড়িয়ে প্যাকেট সম্পন্ন করে জমা দিলে প্রতি হাজারে পাওয়া যায় ৫৯ টাকা।
তিনি আরও বলেন, এর মধ্যে যে খোল বানায় তাকে দিতে হয় ১৬ টাকা। যদি ভাঙতে (বিড়ির মাথা ভাঁজ করা) না পারে তাকে দিতে হবে ১০ টাকা। সেক্ষেত্রে শ্রমিকের বাচে ৩৩ টাকা। এর মধ্যে যদি এক প্যাকেট বিড়ি খারাপ বের হয় তাহলে সেখান থেকে সে হিসাবে বাদ দেওয়া হয় মজুরি।
নারী শ্রমিক সাবিত্রী রানী, অঞ্জনা রানী, শান্তি, পুষ্প রানী, কনিকা ও প্রতিভা ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখানে যারা নারী শ্রমিক আছেন তাদের মধ্যে যদি কেউ কাজে পারদর্শী হয়, সেক্ষেত্রে তিনি টানা ৬ ঘণ্টায় ৫ হাজার বিড়ি ভাঙতে পারেন। তাদের ৬ ঘণ্টায় মজুরি আসে ১৬৫ টাকা। অন্যরা ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার বিড়ি ভাঙতে পারে।
তারা আরও বলেন, তাদের ৬ ঘণ্টায় মজুরি আসে ১০০ থেকে ১১৫ টাকা। যা পরিশ্রম ও সময়ের তুলনায় খুবই কম। তাও আবার সপ্তাহে কাজ হয় মাত্র ২ দিন। এই মজুরিতে খেয়ে না খেয়ে খুবই কষ্টের জীবন তাদের বলেও জানান তারা।
তাড়াশ উপজেলার মহিষলুটি বাজার এলাকায় শুঁটকি মাছ প্রক্রিয়াকরণে কাজ করেন নারী শ্রমিক রহিমা বেগম। তিনি বলেন, ৩ বছর হলো এখানে দিনমজুর হিসেবে কাজ করছি। সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত কাজ করে প্রতিদিন মজুরি পাই নামমাত্র টাকা।
তাড়াশের ষোলাপাড়ার বিলে গিয়ে দেখা যায়, পুরুষ শ্রমিকদের পাশাপাশি মাঠে ধান কাটছেন নারী শ্রমিকরাও। এদের মধ্যেই একজন শ্রীমতী সনিতা রাণী। তিনি বলেন, আমরা পুরুষদের সঙ্গে সমানতালে কাজ করে যাচ্ছি কিন্তু তারপরও দিন শেষে মজুরি সমান পাই না।
তিনি আরও বলেন, ধান লাগানোর কাজও করেছি, সেখানেও একই চিত্র ছিল। তিনি বলেন, এখন পুরুষ শ্রমিকরা একই কাজে পাচ্ছেন ৬০০ টাকা আর নারীরা পাচ্ছি ৪০০ টাকা। তবুও পেটের দায়ে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি।
পৌরসভার রামগাতী এলাকার যমুনা কয়েল খরি কারখানায় কাজ করেন কালিয়া হরিপুর ইউনিয়নের পাইকপাড়া গ্রামের মৃত আব্দুল লথিফের স্ত্রী সুফিয়া (৪৫) ও ওই গ্রামের সাবিনা খাতুন (৩৫)।
সুফিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, ৪ বছর হলো কাজ করছি। প্রতিদিন ৮ থেকে ৯ ঘণ্টা আগুনে পুড়ে কাজ করে আগে পেতাম ২০০ টাকা আর এখন পাচ্ছি ২৪০ টাকা। আমার ৪টা মেয়ে, ছেলে নাই। স্বামী মারা গেছেন বছরখানেক হলো। এখানেই গরমে পুড়ে চলছে জীবনের চাকা।
তবে মজুরি বৈষম্য নিয়ে কথা বলতে চাননি কোনও প্রতিষ্ঠান বা কারখানার মালিক। নাম না প্রকাশ করার শর্তে একজন বলেন, এখনও আমরা মনে করি নারীরা পুরুষদের মতো কাজ করতে পারেন না। তবে সরকারি তদারকি বাড়লে বৈষম্য দূর হয়ে যাবে।
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের সিরাজগঞ্জের উপমহাপরিদর্শক রাজীব চন্দ্র ঘোষ ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিষয়টি সত্য হলেও কেউ কখনো অভিযোগ দেয়নি। অভিযোগ পেলে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
এমএসআর