জয়পুরহাটে আদালত বর্জন চলছেই, বিড়ম্বনায় সেবাপ্রার্থীরা

জয়পুরহাটের এক আইনজীবী ও তার সহকারীর বিরুদ্ধে বেঞ্চ সহকারীর দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার না করায় জ্যেষ্ঠ জেলা ও দায়রা জজ আদালত বর্জন করেছেন জেলা আইনজীবী সমিতির সকল আইনজীবীরা। আদালত বর্জনের তৃতীয় দিন পার হলেও কোনো সমাধান হয়নি। এতে সেবাপ্রার্থীরা পড়ছেন বিড়ম্বনায়। তাদের নিজেদেরকেই শুনানিতে অংশ নিতে হচ্ছে।
গত সোমবার (২৪ জুন) থেকে জ্যেষ্ঠ জেলা ও দায়রা জজ মো. নূর ইসলামের আদালত অনির্দিষ্টকালের জন্য বর্জন করেন আইনজীবীরা। এর আগের দিন রোববার (২৩ জুন) জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. শাহনূর রহমান শাহীন স্বাক্ষরিত এক নোটিশে আদালত বর্জনের সিদ্ধান্ত জানানো হয়।
আইনজীবী সমিতি সূত্রে জানা গেছে, গত ৩ জুন আইনজীবী সমিতির সদস্য গোলাম মোর্শেদ আল কোরেশী ও তার সহকারী প্রিয়মের বিরুদ্ধে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে একটি মামলা করা হয়। মামলা বাদী হয়েছেন যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ দ্বিতীয় আদালতের বেঞ্চ সহকারী নাঈম হোসাইন। এই মামলায় আদালত থেকে তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। এরপর উচ্চ আদালত থেকে ওই আইনজীবী ও তার সহকারী জামিন নিয়েছেন। এ ঘটনায় সমিতির সদস্য কয়েকজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেলা ও দায়রা জজ মো. নূর ইসলামের সঙ্গে দেখা করেন এবং অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা নিষ্পত্তি নিয়ে আলোচনা করেন। কিন্তু সন্তোষজনক সমাধান হয়নি। এরপর ৬ জুন সমিতির জরুরি সভা ডাকা হয়। সেখানে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। তবে আলোচনার মূল বিষয় ছিল আইনজীবী গোলাম মোর্শেদ ও তার সহকারী প্রিয়মের নামে দায়ের করা মামলা নিয়ে। সাতদিনের মধ্যে ওই মামলা প্রত্যাহার ও বেঞ্চ সহকারীকে বদলি করা নিয়ে সভায় সিদ্ধান্ত হয়। সাতদিনের মধ্যে এটি করা না হলে জেলা ও দায়রা জজ আদালত বর্জনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
আইনজীবী সহকারী (মোহরার) প্রিয়ম হোসেন বলেন, আমি মামলা বেলবন্ড দাখিল করতে গিয়েছিলাম। আর এর জন্য ৫ হাজার টাকা বেঞ্চ সহকারী ঘুষ দাবি করেন। এ নিয়ে আইনজীবীসহ আমাদের বিভিন্ন ভাষায় কথা বলেন। আমার আইনজীবী আসার পরেও তিনি একই আচরণ করেন। এজলাস থেকে বের হওয়ার সময় তিনি আমার মা তুলে অশ্লীল ভাষায় গালি দেন। এরপর আমি তাকে একটি থাপ্পড় দিই। এরপর আর বেশি কিছু হয়নি। পরে শুনি আমার আইনজীবী ও আমার নামে মামলা করা হয়েছে। আবার ওইদিনই ওয়ারেন্ট ইস্যু হয়েছে। আবার আমি যে মামলার বেলবন্ড দিতে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের বিরুদ্ধে করা মামলার সেই মামলা নম্বর নিয়ে কোনো কথায় নেই।
আইনজীবী গোলাম মোর্শেদ আল কোরেশী বলেন, ঘটনার পর আইনজীবী সমিতিতে অভিযোগ করার মাধ্যমে আমি অপরাধী হলে ব্যবস্থা নিতে পারতো। কিন্তু তা না করে আমাদের নামে মামলা করা হয়েছে। কোনো ধরনের মারধর করি নি। শুধু আমার মোহরারকে ছোট করার কারণে প্রতিবাদ করেছিলাম। আমরা হাইকোর্ট থেকে আগাম জামিন নিয়েছি। এ ঘটনায় আইনজীবী সমিতি আদালত বর্জন করেছেন। আদালত বর্জনের তিনদিন হলেও কোনো সমাধান হয়নি।
জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. শাহনূর রহমান শাহীন বলেন, আইনজীবী ও তার সহকারীর বিরুদ্ধে অসত্য মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়েছিল। কিন্তু মামলাটি প্রত্যাহার করা হয়নি। মিথ্যা মামলার বাদী বেঞ্চ সহকারী নাঈম হোসাইনকে বদলিও করা হয়নি। আমাদের বেঁধে দেওয়া সময়ে বিষয়টি সমাধান করা হয়নি। এ কারণে গত সোমবার থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য জ্যেষ্ঠ জেলা ও দায়রা জজ আদালত বর্জন চলছে।
“জয়পুরহাটের যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ দ্বিতীয় আদালতের বেঞ্চ সহকারী নাঈম হোসাইনকে মারধরের অভিযোগ এনে আইনজীবী গোলাম মোর্শেদ আল কোরেশী ও তার সহকারী প্রিয়ম হোসেনের নামে মামলা করায় তা প্রত্যাহারের দাবি জানান আইনজীবীরা। মামলাটি প্রত্যাহার না করায় জ্যেষ্ঠ জেলা ও দায়রা জজ আদালত বর্জন করেন জেলা আইনজীবী সমিতি।”
এদিকে বেঞ্চ সহকারীর দায়ের করা মামলা সূত্রে জানা গেছে, গত ৩ জুন দুপুর ২টার দিকে এজলাসে দাপ্তরিক কাজ করছিলেন নাঈম হোসাইন। সে সময় অ্যাড. গোলাম মোর্শেদ আল কোরেশীর মোহরার (আইনজীবী সহকারী) প্রিয়ম এসে ১০৯/২০২৪ নম্বর দায়রা মামলার নালিশি চেকের ফটোকপিসহ যাবতীয় কাগজের ফটোকপি চান। মামলার সাক্ষীর জবানবন্দিসহ যাবতীয় কাগজপত্রে ফটোকপি দিতে নিষেধ থাকায় সার্টিফাইড কপি নিতে বলা হয়। প্রিয়ম বলেন, আমাকে অ্যাডভোকেট পাঠিয়েছেন। অ্যাডভোকেট এলেও এটি দেওয়া যাবে না বলে জানিয়ে দেওয়া হয়। পরে আইনজীবী গোলাম মোর্শেদ আল কোরেশী এসে ওই নথির কাগজপত্র চান। এতে অপারকতা প্রকাশ করলে বেঞ্চ সহকারী নাঈম হোসাইনকে চড়, থাপ্পড় কিলঘুষি মারা হয়। এতে আঘাত পেয়ে নাঈম হোসাইন হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নেন এবং আইনজীবী গোলাম মোর্শেদ আল কোরেশী ও তার সহকারী প্রিয়মের বিরুদ্ধে পেনাল কোড ১৮৬০ এর ৩৩২/৩৩৩/৩৫৩/৩৪ ধারায় মামলা করেন।
বেঞ্চ সহকারী নাঈম হোসাইন বলেন, নথির ফটোকপি দেওয়ার নিয়ম না থাকায় আমি তা দিতে চাইনি। আর এজন্য আমাকে মারধর করা হয়েছে। ঘুষ দাবি করেছেন কি-না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এটি সত্য নয়।
জেলা ও দায়রা জজ আদালতের ভারপ্রাপ্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোফাজ্জল হোসেন বলেন, কোনো মামলার কাগজপত্র নেওয়ার বিধান আছে। দরখাস্ত করলে সেগুলো নকল বিভাগ সরবরাহ করেন। কিন্তু কোনো মামলার ফটোকপি দেওয়ার নিয়ম নেই। আর এই কাগজের ফটোকপি দেওয়া নিয়েই বেঞ্চ সহকারীর সঙ্গে একটি ঘটনা ঘটে। আইনজীবীরা জজ স্যারের আদালত বর্জন করেছেন। আদালতে মামলা হয়েছে, সেটি আদালতে ব্যাপার। এখানে আমাদের তো কোনো হাত নেই। তবুও আমরা একপ্রকার নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। এখন আমাদের চাওয়া আমাদের কাজে যেন কোনো বিঘ্ন না ঘটে। আমরা আগের মতো স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে চাই।
বুধবার (২৬ জুন) বেলা ১১টা ৪০ মিনিটে জেলা ও দায়রা জজ আদালত মো. নূর ইসলামের এজলাসে গিয়ে দেখা গেছে, আদালতের এজলাস চলছিল। জ্যেষ্ঠ জেলা ও দায়রা জজ মো. নূর ইসলামের এজলাসে ছিলেন। আদালতের বেঞ্চ সহকারীসহ অন্যরাও উপস্থিত ছিলেন। এজলাসে আইনজীবীদের কাউকে দেখা যায়নি। তবে আইনজীবীদের সহকারীদের দেখা গেছে। আর শুনানিতে সেবাপ্রার্থীরা নিজেরাই অংশ নিচ্ছেন। এ ছাড়া জেলা ও দায়রা জজ আদালতের অন্য বিচারকদের এজলাসে স্বাভাবিক কার্যক্রম চলছিল।
জানতে চাইলে জ্যেষ্ঠ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বেঞ্চ সহকারী এসএম শাহীন বলেন, আদালতের কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবেই চলছে। তবে আইনজীবীরা আদালতে আসছেন না। প্রথম দিন রাষ্ট্রপক্ষের একজন আইনজীবী দিয়ে ১৮টি মামলা শুনানির জন্য উপস্থাপন হয়। পরের দিন ও আজ কোনো আইনজীবী আসেননি। গতকাল মঙ্গলবার শুনানির জন্য ১৯টি মামলা উপস্থাপন হয় এবং আজ বুধবার ২০টি মামলা উপস্থাপন করা হয়। সেবাপ্রার্থীরা নিজেরাই শুনানিতে অংশ নেন।
চম্পক কুমার/এএএ