‘চোখের ইশারাত তিস্তা হামার সোগকিছু ভাঙি নিয়া গেইল’
‘ঈদের আগ থাকি হামার এত্তি কোনা পানি আসছে। হামরা মনে করছি নো এবার বুঝি এইপাকে (এদিকে) নদীভাঙন হবার নেয়। কিন্তু তিস্তা কয় থাকিস তোর বাড়িটায় আগত ভাঙি নিয়া যাং। চোখের ইশারাত তিস্তা হামার সোগকিছু (সবকিছু) ভাঙি নিয়া গেইল। নদী গরিব-দুঃখী বোঝে না বাহে। বুঝলে কি আজই হামাক চিন্তাত থাকা নাগে।’
অশ্রুসিক্ত চোখে আগ্রাসী তিস্তার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলছিলেন সত্তরোর্ধ্ব বয়সী আব্দুস সাত্তার। তিস্তা নদীবেষ্টিত রংপুরের গংগাচড়া উপজেলার মর্ণেয়া ইউনিয়নের আলফাজ টারী গ্রামের বাসিন্দা তিনি। উজান থেকে নেমে আসা ঢল আর অব্যাহত বৃষ্টিতে নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় ওই এলাকায় ভাঙন শুরু হয়েছে। সঙ্গে সৃষ্ট বন্যায় আব্দুস সাত্তারের বাড়িঘর ভেঙে নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে।
একই গ্রামে তিস্তার বন্যায় বাড়িঘর ভেঙে যাওয়া আজিজুল ইসলাম (৪০) নামের এক ব্যক্তি বলেন, ‘সেই ছোট্ট থাকি শুনি আসবার নাগছি যে সরকার হামার নদীটা বান্দি দেবে। কয়েক দিন আগে শুননো এবার নাকি নদীর কাজ শুরু করবে। ওই তকনে মনোত সাহস নিয়্যা কষ্ট করি পাকাবাড়ি বানাইনো। কিন্তুক সেই পাকা বাড়িত আর থাকিবার পাইনো না। খালি ইটগুল্যা খুলি নিছি, বাকি সোগকিছু বানের (বন্যার) পানিত ভাসি (ভেসে) গেইছে।’
শুধু আব্দুস সাত্তার কিংবা আজিজুল ইসলাম নয়, এবার গংগাচড়ায় তিস্তায় বিলীন হয়েছে শতাধিক পরিবারের ঘরবাড়ি। কয়েক দিনের ভারী বৃষ্টি আর ভারতের সিকিম থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে ফুলেফেঁপে উঠেছে তিস্তা নদী। এতে রংপুরের গংগাচড়ার চারটি ইউনিয়নের প্রায় ১০০টি পরিবারের ঘরবাড়ি তিস্তায় বিলীন হয়েছে। ২৫০টিরও বেশি পরিবার ভাঙন আতঙ্কে তাদের ঘরবাড়ি সরিয়ে নিয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে গংগাচড়া উপজেলার প্রায় ৫ হাজার পরিবার।
বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে টিউবওয়েল, রান্নার চুলা, পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা। দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানি ও খাবার সংকট। পানিবন্দি পরিবারগুলো দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে। এ ছাড়া পানিতে তলিয়ে নষ্ট হয়েছে কয়েক বিঘা জমির বাদাম খেত ও আমন ধানের বীজতলাসহ বিভিন্ন শাকসবজির খেত।
বৃহস্পতিবার (৪ জুলাই) উপজেলার মর্ণেয়া ইউনিয়নের তালপট্টি, আলফাজ টারী, নরশিং, হরিণ চরা কোলকোন্দ ইউনিয়নের চর মটুকপুর, চর ছিলাখাল, মধ্য চিলাখাল, লক্ষ্মিটারী ইউনিয়নের চর ইচলি, পশ্চিম ইচলি, চল্লিশসাল ও নোহালী ইউনিয়নের বাগডহরা, মিনার বাজার এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বানভাসি ও বন্যায় ঘরবাড়ি ভেঙে যাওয়া পরিবারগুলোর দুর্বিষহ জীবন। গবাদিপশু-পাখি সঙ্গে নিয়ে ঠাঁই নিয়েছেন তারা রাস্তার ধারে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ ও বিভিন্ন খোলা স্থানে। ভাঙন হুমকিতে থাকায় আগেভাগেই অনেক পরিবার তাদের বাড়িঘর অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
নোহালীর চরের আনোয়ার, আয়নাল ও আমিনুর জানান, নদীতে পানি বাড়া-কমার মধ্যে থাকলেও বন্যার পানি থেকে যায়। বাড়ি কোলঘেঁষে নদীর পানি বয়ে যাচ্ছে। আর এতে করে নদীপাড়ে ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে তারা নিজেদের বাড়িঘর নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়েছে। কারও কারও বসতভিটা নদীতে বিলীনও হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে এই বর্ষা মৌসুমে তিস্তাপাড়ের মানুষ ভাঙন ঝুঁকিতে দিন কাটাচ্ছেন বলে তারা জানান।
চরাঞ্চলগুলো প্লাবিত হওয়ায় তলিয়ে গেছে গ্রামীণ রাস্তাঘাট। মর্ণেয়া ইউনিয়নের আলফাছটারী এলাকায় ব্যাপক ভাঙন দেখা দিয়েছে। নদীভাঙনে গত চার দিনে ওই এলাকার মতিয়ার রহমান, খালিদ হোসেন, আব্দুল জলিল, আব্দুল মতিন, নাজমুল হক, মনির হোসেন, হাসিদুল ইসলাম, মুসফিকুল ইসলামসহ অন্তত অর্ধশত পরিবারের ঘরবাড়ি বিলীন হয়েছে। চরম দুর্ভোগ দেখা দিয়েছে পানিবন্দি পরিবারগুলোর। ভাঙন আতঙ্কে অনেকে বাড়িঘর-আসবাবপত্র সরিয়ে নিচ্ছে।
মর্ণেয়া ইউনিয়নের বানভাসি মনজুম আলী (৪৮) বলেন, ‘হামরা (আমরা) আইজ (আজ) ১০ দিন থাকি পানিবন্দি হয়্যা (হয়ে) আছি বাহে। হামার চেয়ারম্যান, মেম্বার, সরকারি লোক কায়ো (কেউ) একনা (একবার) ভুলকি মারিবারও আইসে নাই (দেখতে আসেনি)। ছোট্ট ছাওয়া (বাচ্চা) আর গরু-ছাগল এগুলা নিয়া খুব বিপদে দিন পার করছি।’
কোলকোন্দ ইউনিয়নের দুলালী বেগম জানান, তিস্তা নদী থেকে প্রায় ২০০ মিটার দূরে তার বাড়িটি ছিল। বুধবার রাতে রান্নাঘরসহ তিনটি ঘর নিমেষেই তিস্তার গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। তিনি এখন তার ছোট ছেলে-মেয়েদের নিয়ে এক আত্মীয়ের বাড়িতে আছেন।
এদিকে মর্ণেয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জিল্লুর রহমান জানান, গত কয়েক দিনে তার ইউনিয়নে অর্ধশত পরিবারের বাড়িঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে এক হাজারের বেশি পরিবার।
কোলকোন্দ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুর রউফ জানান, চর মটুকপুর, বিনবিনা এলাকায় এক হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল হাদী জানান, শংকরদহ, ইছলি ও বাগেরহাট এলাকার ৭০০ পরিবার পানিবন্দি।
গংগাচড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাহিদ তামান্না বলেন, আমাদের কাছে তিস্তার ভাঙনে বিলীন হয়ে যাওয়া মর্ণেয়া ইউনিয়নের এখন পর্যন্ত ২০টি পরিবারের তালিকা আছে। আমরা আরও খোঁজখবর নিয়ে তালিকা করছি। তবে ভাঙন হুমকিতে থাকায় কোলকোন্দ, নোহালী, মর্ণেয়া, লক্ষ্মিটারী ইউনিয়নের প্রায় ২৫০টির মতো পরিবার তাদের বাড়িঘর অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছে।
এদিকে প্রতিবছর বন্যায় এমন ভাঙন রোধে স্থায়ী সমাধানের জন্য তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন জরুরি উল্লেখ করে নদীবিষয়ক সংগঠন ‘রিভারাইন পিপল’ এর পরিচালক ড. তুহিন ওয়াদুদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, উজান থেকে নেমে আসা পানিতে পলি জমে তিস্তার পেট ভরাট হচ্ছে। ফলে এবার তিস্তার আগ্রাসী ভাঙন প্রতিরোধ সহজ হবে না। এই নদীকে নিয়ে কার্যকরী দ্রুত কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে এবারের বন্যায় তিস্তা রুদ্র রূপ ধারণ করতে পারে। তাই পানি উন্নয়ন বোর্ডকে এখনই নদীর ভাঙন পয়েন্টগুলো চিহ্নিত করে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, ৮ হাজার ২০০ কোটি টাকা মূল্যের তিস্তা মহাপরিকল্পনা নামক সোনার হরিণের দেখা কবে মিলবে, সেই অপেক্ষায় উত্তরাঞ্চলের মানুষ। মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে শিল্পায়ন, কর্মসংস্থানসহ উত্তরের অর্থনীতিতে বড় ধরনের সুফল আসবে। এর ফলে নদীপথের যোগাযোগ তৈরি হবে। স্যাটেলাইট শহর হবে, আবাদি জমি বাড়বে। ফলে মানুষের জীবনমানে ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হবে। বর্ষায় ভাঙন, প্লাবন এখন দীর্ঘ দুর্যোগে রূপ নিয়েছে আর শুষ্ক মৌসুমে বন্ধু দেশ ভারতের পানি প্রত্যাহারে মরতে বসেছে তিস্তা। সেই কারণে ২ কোটি মানুষের স্বপ্ন পূরণে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।
তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম হক্কানি ঢাকা পোস্টকে বলেন, অসময়ের বন্যা ও ভাঙনে প্রতিবছর এক লাখ কোটি টাকার সম্পদ তিস্তার গর্ভে চলে যায়। এই সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য নদী খনন, সংরক্ষণ ও তিস্তা মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন করা ছাড়া বিকল্প নেই। মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবিতে আগামী ৬ জুলাই তিস্তা নদীর কাউনিয়া পয়েন্টে সমাবেশ করা হবে বলেও জানান তিনি।
এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যার পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, দেশের উত্তরাঞ্চল এবং তৎসংলগ্ন উজানে আগামী ২৪ ঘণ্টায় ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস রয়েছে। এ সময় তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার নদীর পানি সমতল সময় বিশেষে বৃদ্ধি পেয়ে কতিপয় পয়েন্টে স্বল্পমেয়াদে বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে।
সূত্র আরও জানায়, বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা থেকে তিস্তা নদীর কাউনিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ৩৯ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এর আগে সকাল ৯টায় বিপৎসীমার ৩৬ সেন্টিমিটার নিচ এবং সকাল ৬টায় ৩৩ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়। কাউনিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমা ২৯ দশমিক ৩১ সেন্টিমিটার ধরা হয়।
অন্যদিকে দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্টে দুপুর ১২টায় পানিপ্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫১ দশমিক ৬৭ সেন্টিমিটার, যা বিপৎসীমার ৪৮ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর আগে সকাল ৯টায় ৫১ দশমিক ৭১ সেন্টিমিটার এবং সকাল ৬টায় ৫১ দশমিক ৭৪ সেন্টিমিটার পানিপ্রবাহ রেকর্ড করা হয়। এ পয়েন্টে ৫২ দশমিক ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হলে বিপৎসীমা অতিক্রম করে।
এদিকে পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রংপুরের গংগাচড়া ছাড়াও কাউনিয়া ও পীরগাছা উপজেলার তিস্তা অববাহিকার নিম্নাঞ্চল, চর ও দ্বীপ চরের কিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। তিস্তা নদীতে পানি বাড়া-কমায় ভাঙনের মুখে পড়েছে বিভিন্ন এলাকা। বেশ কিছু চরাঞ্চলের বাড়িঘরের চারপাশে পানি প্রবেশ করার খবর পাওয়া গেছে। তলিয়ে গেছে গ্রামীণ সড়ক। ডুবে গেছে ওইসব এলাকার সবজিখেত।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের উত্তরাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী মাহবুব রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রবল বর্ষণ আর উজানের ঢলে নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। তিস্তায় পানি বাড়া-কমায় গংগাচড়ায় কিছু স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। দ্রুত ভাঙন রোধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
রংপুর-১ (গংগাচড়া ও আংশিক সিটি) আসনের সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান বাবলু ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি তিস্তার ভাঙনে বিলীন হয়ে যাওয়া পরিবারগুলোর বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি আমার এলাকার তিস্তার ভাঙনে বিলীন হয়ে যাওয়া পরিবারগুলোকে পুনর্বাসনের আশ্বাস দিয়েছেন। আমি সংসদ অধিবেশনের কারণে ঢাকায় আছি। আশা করছি, আগামী ১১ জুলাই নিজেই গিয়ে আমার তিস্তাপাড়ের ভাঙনকবলিত এলাকাগুলো ঘুরে দেখব। আমি এখান থেকে সব সময় পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। কোথাও ভাঙনের খবর পেলে আমি সেখানে তাদের দ্রুত জিওব্যাগ ফেলতে বলছি এবং তারাও সেখানে দ্রুত ভাঙন রক্ষায় কাজ করছে।
এমজেইউ