এনআইডি জালিয়াতি : আ.লীগ নেতাসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট
কুষ্টিয়ায় জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) জালিয়াতি করে শত কোটি টাকার জমি হাতিয়ে নেওয়ার মামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি হাজী রবিউল ইসলামসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। গত মঙ্গলবার (জুলাই ৩০) কুষ্টিয়া আদালতে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার (সিআইডি) জিয়াউদ্দিন আহম্মেদ এ অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
শুক্রবার (২ আগস্ট) বিকেলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার (সিআইডি) জিয়াউদ্দিন আহম্মেদ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
তিনি জানান, কুষ্টিয়ায় জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) জালিয়াতি মামলায় ৩৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দেওয়া হয়েছে। ৬ জন সরকারি চাকুরিজীবী থাকায় এবং তাদের অভিযোগ দুদকে থাকায় চার্জশিটে ৩৫ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। ওই ৬ জনের বিরুদ্ধে আদালতকে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
ভুক্তভোগী ও মামলার বাদী কুষ্টিয়া শহরের বাসিন্দা এমএমএ ওয়াদুদ বলেন, আমিসহ আমার পরিবারের আরও ৫ সদস্যের নাম ও তথ্য দিয়ে জাল জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করেন আসামিরা। আমাদের নামে ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করে ভুয়া মালিক সাজিয়ে আমার শত কোটি টাকার সম্পত্তি বিক্রি করে দেওয়া হয়। ২০১৭ সাল থেকে তারা এগুলো শুরু করে। এরপর বিষয়টি জানতে পেরে আমি মোট ৮ থেকে ১০টি মামলা করি। এ ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি। দ্রুত মামলার রায়ের দাবি জানাচ্ছি।
অভিযোগপত্রভুক্ত আসামিরা হলেন- কুষ্টিয়া জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান, কুষ্টিয়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি, জেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি হাজী রবিউল ইসলাম, জাহানারা বেগম, আমির হোসেন, সদর উদ্দিন, পিঞ্জিরা খাতুন, আঞ্জেরা খাতুন, ফারুক মন্ডল, মুহিবুল ইসলাম, জাহিদুল ইসলাম, মহিবুল ইসলাম, খালিদ বীন সাদী, হালিম উদ্দিন, আশরাফুজ্জামান সুজন, খয়বার শেখ, রঙ্গিলা খাতুন, মহিরন খাতুন, হারুনুর রশিদ, আমিরুল ইসলাম, হুর আলী, সুমন হোসেন, কামরুজ্জামান কাবিল, দেলোয়ার হোসেন, মিন্টু খন্দকার, জরিনা খাতুন, মোমেনা খাতুন, জীবন খাতুন, ছানোয়ারা খাতুন, হেনা, জাহানারা, মিলন হোসেন, নজরুল ইসলাম, মোস্তফা করিম, মোরশেদুল হাসান ও ছরোয়ার হোসেন।
মামলার অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, ২০১৭ সালে কুষ্টিয়া শহরের এনএস রোডের বাসিন্দা এমএমএ ওয়াদুদ ও তার পরিবারের ৫ সদস্যের নাম ও তথ্য দিয়ে জাল জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করা হয়। ছয় ব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করে ভুয়া মালিক সাজিয়ে ওয়াদুদের শত কোটি টাকার সম্পত্তি বিক্রি করে দেওয়া হয়। এরপর বিষয়টি জানাজানি হলে জালিয়াতির অভিযোগে ২০২০ সালের ৭ সেপ্টেম্বর জেলার রাজনৈতিক ব্যক্তিসহ ১৮ জনের নামে প্রথমে মামলা হয়। পরে আরও বেশ কয়েকটি মামলা হয়। আসামিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনেও পৃথক মামলা দায়ের করা হয়। সেইসব মামলা চলমান রয়েছে।
সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রটি ক্রেতা-বিক্রেতা সেজে কুষ্টিয়া সাব-রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে দলিল সম্পাদন এবং হস্তান্তর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাদীর প্রায় ১০০ কোটি টাকা মূল্যের বাড়িসহ ভূ-সম্পত্তি দখলের চেষ্টা করে। আদালতে গ্রেপ্তারদের দেওয়া স্বীকারোক্তিতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতার কথা উঠে আসায় অধিকতর তদন্তের জন্য সিআইডিকে ২০২০ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর মামলাটির তদন্ত ভার দেওয়া হয়।
এ ঘটনা জানাজানি হলে দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। পরে ঘটনা তদন্তে নামে নির্বাচন কমিশন। তদন্তে কুষ্টিয়া জেলা নির্বাচন অফিসের তৎকালীন কর্মরত পাঁচ কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া যায়। এনআইডি জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ২০২১ সালের ৪ মার্চ চার নির্বাচন কর্মকর্তা ও এক কর্মচারীর বিরুদ্ধে দুটি মামলা করা হয়। কুষ্টিয়ার জ্যেষ্ঠ জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা আনিসুর রহমান বাদী হয়ে কুষ্টিয়া মডেল থানায় একটি ও কুমারখালী থানায় আরেকটি মামলা দায়ের করেন। দুটি মামলাতেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের তিনটি ধারা ব্যবহার করা হয়েছে।
কুষ্টিয়া মডেল থানায় দায়ের হওয়া মামলার আসামিরা হলেন- নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের উপসচিব (সাবেক জ্যেষ্ঠ জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা) নওয়াবুল ইসলাম, ফরিদপুরের অতিরিক্ত আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা (সাবেক কুষ্টিয়া সদর উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা) জিয়াউর রহমান, মাগুরা সদরের উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা (সাবেক কুষ্টিয়া সদর উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা) অমিত কুমার দাস ও কুষ্টিয়া সদর উপজেলা নির্বাচন কার্যালয়ের অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক জিএম সাদিক। কুমারখালী থানায় দায়ের হওয়া মামলার একমাত্র আসামি হলেন কুষ্টিয়া সদর উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা (সাবেক কুমারখালী উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা) ছামিউল আলম।
দায়ের হওয়া মামলা তদন্ত করতে গিয়ে জালিয়াতিতে আনিসের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পায় সিআইডি। সে সময় জেলা নির্বাচন কার্যালয়ের অফিস সহকারী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। গ্রেপ্তারের পর কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন আনিসুর রহমান আনিস। তাদেরকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয় নির্বাচন কমিশন।
এ বিষয়ে জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি হাজী রবিউল ইসলাম বলেন, আমি তৎকালীন পুলিশ কর্মকর্তার সম্পূর্ণ আক্রোশের শিকার হয়েছিলাম। আমার নামে মামলাটি তাদের মনগড়া। আমার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট। এ ঘটনার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আমি আইনিভাবে লড়াই চালিয়ে যাব। সত্যের জয় হবে ইনশাল্লাহ।
রাজু আহমেদ/আরএআর