সন্তান থেকেও ঠাঁই বৃদ্ধাশ্রমে

‘চল্লিশ বছর আগোত স্বামী মারা গেইছে। কত কষ্ট করি ছাওয়াপোয়াক (ছেলে-মেয়ে) মানুষ করচু। নিজে না খ্যায়া ছাওয়াক খোয়াচু (খাওয়ানো)। আজই সেই ছাওয়ার ঘরোত মোর থাকার জাগা নাই। বেটি তিনটার বিয়াও হইছে। ব্যাটা দুইটাও বিয়া করি বউ-ছাওয়া নিয়্যা ঢাকাত থাকে। ব্যাটার বউ দেখাশোনা করে না। আইজ কাইলক্যার (এখনকার) বউরা তো শ্বশুর-শাশুড়ির দেইখপার পারে না। বেটিরা তো পরের বাড়িত থাকে। কেউ আমার দেখাশোনা করে না, এ জন্য আশ্রমে এসে আছি। যত দিন বাঁচি আছি, এ্যাটে থাকমো।’ চোখে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে পড়তে কথাগুলো বলছিলেন বৃদ্ধা নুরজাহান বেগম।
সত্তরোর্ধ্ব বয়সী এই বৃদ্ধা থাকেন দেবী চৌধুরানী বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে। রংপুরের পীরগাছা উপজেলা সদর থেকে ছয় কিলোমিটার দক্ষিণে রংপুর-সুন্দরগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়কের কৈকুড়ী ইউনিয়ন পরিষদের পাশে এই বৃদ্ধাশ্রমের অবস্থান।
ইতিহাসখ্যাত দেবী চৌধুরানীর নামে পরিচিত প্রতিষ্ঠিত এই বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রটিতে বিধবা নুরজাহান বেগমের মতো ভাগ্যতাড়িত ২২ জন (বর্তমান সংখ্যা) বৃদ্ধ-বৃদ্ধা জীবনের পড়ন্ত বেলায় পেয়েছেন নিরাপদ আশ্রয়। পুনর্বাসন কেন্দ্রটিতে তিন বেলা উন্নত মানের খাবার, চিকিৎসাসেবা, ওষুধ, পোশাক-পরিচ্ছদসহ নানা সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন এসব অসহায় বাবা-মা।
সরেজমিনে দেখা যায়, বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রটিতে আশ্রিতরা কেউ ঘুমাচ্ছেন, কেউবা নামাজ পড়ছেন। কেউ ঘরে বসে পত্রিকার পাতায় নজর দিচ্ছেন। আর কেউবা ব্যস্ত জীবনের ফেলে আসা স্মৃতিগুলো গল্পে গল্পে একে অন্যকে শোনাচ্ছেন। যেন সবার চোখেমুখে না পাওয়ার ছাপ। এসব মানুষ পুনর্বাসন কেন্দ্রে নতুন কাউকে আসতে দেখলেই আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে ওঠেন। ভাবেন, হয়তো কেউ তাদের খোঁজ নিতে এসেছেন। নয়তো নিজের পরিবারের ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনি বা আত্মীয়স্বজন মনে করে ছুটে যান তারা।
বৃদ্ধাশ্রমের পশ্চিম দুয়ারীতে বসে কথা হয় পঁচাত্তর বয়সী বৃদ্ধা আমেনা বেগমের সঙ্গে। তার স্বামী হবিবর রহমান মারা গেছেন পাঁচ বছর আগে। পরিবারে রয়েছেন একমাত্র ছেলে। কিন্তু তিনি মায়ের দেখাশোনা না করায় আমেনা ভিটেমাটি ছেড়ে বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রটিতে এসে মাথা গোঁজার আশ্রয় পেয়েছেন। ঢাকা পোস্টকে শোনালেন জীবনসায়াহ্নের করুণ বাস্তবতার গল্প।
আমেনা বলেন, স্বামী মরছে অনেক আগোত। ব্যাটা একটা তায় (সে) থাকিয়্যাও (থেকেও) নাই। বড় ছাওয়াক নিয়া ব্যাটার সংসার। মুই মাও হন, মোর জাগা নাই। ব্যাটা-বউ কায়ো মোর দেখাশোনা করে না। সবার খালি অভাব আর অভাব। কায়ো খোঁজও নেয় না। মুই বিধবা মানুষ, এমন করিয়া মোক থাকা লাগবে, জীবনে ভাবো নাই। কী করিম, আল্লাহ্ যতদিন হায়াত দিছে, এমন করিয়া জীবন চলি যাইবে।
ষাটোর্ধ্ব বিধবা মল্লিকা খাতুন বলেন, ছয়টা ব্যাটা-বেটিক মানুষ করনো। বিয়াসাদি দিনো। সবায় এ্যালা আলাদা থাকে। মোর স্বামী মারা গেইছে। মুই এ্যালা (এখন) সবার কাছে অচল মানুষ। ব্যাটা-বেটিরা ভাত দিবার চায় না। অসুখ হইলে ওষুধপাতি-চিকিৎসা করায় না। কষ্ট করি থাইকপার (থাকতে) না পারি এই বৃদ্ধাশ্রমোত চলি আসি আচু।
মল্লিকার দীর্ঘদিন ধরে কানে সমস্যা। ঠিকমতো চিকিৎসা করাতে না পারায় এখন কম শুনতে পান তিনি। কয়েক দিন ধরে শরীরটা বেশি ভালো যাচ্ছে না তার। ‘মোর ব্যাটাগুল্যাও ভালো না, বউও না। বউ কয় হামরা নিজে ছইল (সন্তান) নিয়্যা চইলবার পারি না, তোমাক (শাশুড়িকে) কোত থাকি খোওয়ামো। মেয়ে তিনটার অবস্থা ভালো না। সবাই অভাবের মধ্যে আছে। মোর কোনো গতি হয় নাই, এই জন্য আইজ জীবনোত এতো কষ্ট।’ আক্ষেপ করে বলেন মল্লিকা।
এই পুনর্বাসন কেন্দ্রে স্বামী-সন্তানহারা এক অসহায় বৃদ্ধা রয়েছেন। যার দুচোখে এখনো পুরোনো দিনের স্মৃতি ভাসে। পরিবার পরিকল্পনায় চাকরির জন্য তিন মাস প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন জমিলা বেগম। কিন্তু চাকরির ট্রেনিং শেষ করেই তাকে বসতে হয় বিয়ের পিঁড়িতে। তখন উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছেন। স্বামীর সংসারে গিয়ে উচ্চশিক্ষার বাসনা থেকে ডিগ্রির বই কিনে পড়ালেখা শুরু করেছিলেন। কিন্তু তার আর কলেজে ভর্তি হওয়া হয়নি।
অপ্রাপ্ত বয়সে বিয়ে হওয়ায় অকালে সন্তান প্রসব করেন জমিলা বেগম। সেই সন্তান বেশি দিন বাঁচেনি। এর মধ্যে তার শাশুড়ি আর মায়েরও মৃত্যু হয়। সংসারও টেকেনি। স্বামী, সন্তান, সংসার হারিয়ে দুঃখের সাগরে পড়েন তিনি। ৩৯ বছর ধরে ছিলেন বাবার বাড়িতে। কিন্তু এখন ছোট ভাই আর দুই বোন ছাড়া কেউ নেই জমিলার। সবাই সবার মতো ব্যস্ত থাকায় কেউ তার দেখভাল করে না। বাধ্য হয়ে বৃদ্ধাশ্রমে চলে এসেছেন জমিলা। এখানেই তিন বছর ধরে রয়েছেন তিনি।
জমিলা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আগে ভাবতাম ছেলে মেয়ে থাকলে হয়তো এত কষ্ট হতো না। বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে হতো না। কিন্তু এখন তো দেখি ছেলে-মেয়ে থেকেও শান্তি নেই। অনেকে এই আশ্রমে আছে, যাদের ছেলে-মেয়েরা মা-বাবাকে দেখাশোনা করে না। সেই হিসেবে আমি ভালো আছি। এই বৃদ্ধাশ্রমে ভালো খাচ্ছি, থাকছি, কোনো সমস্যা নেই। আগের দিনের কথা মনে পড়লে কান্না আসে, কষ্ট লাগে।
নূরজাহান, আমেনা, মল্লিকা, জামিলা, রহিমার মতো এ রকম অনেকেই আছেন দেবী চৌধুরাণী বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে। যাদের বেশির ভাগই এখানে এসেছেন ছেলের সংসারে মাথা গোঁজার ঠাঁই না পেয়ে। কেউ কেউ এসেছেন জীবনে কোনো কূলকিনারা না পেয়ে। অভাব-অনটনও রয়েছে কারও কারও পরিবারে। তবে সবার মধ্যেই একসময় ছিল দুবেলা-দুমুঠো ভাত, কাপড়, ওষুধ আর সেবাযত্ন না পাওয়ার অভাব।
সেই অভাব পূরণে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন এই পুনর্বাসন কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক রাজেকা রহমান। তাদের জন্য প্রতি মাসে গড়ে ব্যয় করছেন ৫০ থেকে ৭০ হাজার টাকা। রাজেকার বেতনের সঙ্গে স্বামীর ব্যবসার টাকাও জোগান দিতে হয় কখনো কখনো। তবে স্থানীয় প্রশাসন ও দানশীল ব্যক্তিদের সহযোগিতা এই পুনর্বাসন কেন্দ্রে পরিচালনার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে।
অভাবী, অসহায়-দুস্থ ও স্বামী-সন্তানহারা বৃদ্ধ মা-বাবাদের জন্য ২০১৫ সালে গড়ে তোলা হয় দেবী চৌধুরানী বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রটি। নিজ উদ্যোগে সেবামূলক এই পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছেন বিমাকর্মী রাজেকা রহমান। বর্তমানে সেখানে ২২ জন অসহায় বৃদ্ধ মা-বাবা রয়েছেন। তাদের থাকা-খাওয়াসহ দেখাশোনা সবই করছেন রাজেকা।
বিমাকর্মী হওয়ায় রাজেকা রহমান একসময় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার শত শত মানুষের বাড়ি ঘুরেছেন। তখন নিজ চোখে দেখেছেন অভাবে জর্জরিত পরিবারগুলোয় বয়স্ক মা-বাবাদের দুঃখ-কষ্ট আর বিড়ম্বনা। দেখেছেন, ছেলের সংসারে বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়ির প্রতি বউয়ের আড়চোখা দৃষ্টি। আবার কোথাও দেখেছেন জমিজমার ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে ছেলে-মেয়েদের কারণেই ঘরছাড়া অসহায় মা-বাবারা। অন্যের এসব দুঃখ-কষ্ট দেখতে দেখতে হাঁপিয়ে ওঠেন তিনি। নিজের তেমন সাধ্য না থাকলেও তখনই মনস্থির করেন, বয়স্কদের পুনর্বাসনে কাজ করবেন। যেই ভাবনা সেই কাজ। যদিও রাজেকার ভাবনার বাস্তব রূপ পেতে পোহাতে হয়েছে অনেক কাঠখড়ি।
সেই মহান মানুষ রাজেকার সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের। তিনি বলেন, বৃদ্ধাশ্রমে এসব অসহায় বৃদ্ধ মা-বাবা যতই ভালো থাকুন, কিন্তু তাদের মনে শান্তি নেই। তাদের চোখেমুখে একটা হতাশা কাজ করে। সন্তান থাকার পরও তারা ঘরহীন, আশ্রয়হীন। এমন চিন্তা তাদের তাড়িত করে। আমি সব সন্তানের প্রতি অনুরোধ করব, মা-বাবাকে কষ্ট দেবেন না। যত কষ্টই হোক মা-বাবাকে সঙ্গে নিয়ে জীবনটা উপভোগ করুন।
তিনি বলেন, আমি চাই না, কোনো মা-বাবা আমার পুনর্বাসন কেন্দ্রে এসে দীর্ঘদিন ধরে থাকুন। যে-ই আসুন, তিনি যেন তার সন্তানের কাছে নিরাপদ আশ্রয় পান, আমি সেই উদ্দেশ্য নিয়েই কাজ করছি।
এনএ