বরিশালে ৯৩ বছর ধরে চলছে দধি ঘর

আধুনিকতার ছোঁয়ায় আমূল পরিবর্তন এসেছে বরিশাল শহরের গির্জা মহল্লায়। সড়কটির নাম বদলে রাখা হয়েছে হেমায়েত উদ্দিন সড়ক। কিন্তু একটি দধি ঘর আজও রয়ে গেছে প্রাচীন ধাঁচে। শহরে অনিন্দ্য সুন্দর ডেকরেশনের অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের পরিচিতি না ছড়ালেও সাদামাটা এই দোকানের খ্যাতি দেশজুড়ে। দধি ঘর নাম হলেও গির্জা মহল্লার দধি ঘর নামে চেনে সকলে। স্থানীয় বাসিন্দারা তো বটেই, আগন্তুকরা একবার হলেও দধি ঘরের মিষ্টান্নে প্রশান্তি নেন।
ভোরবেলা থেকে গভীর রাত, ভোজনরসিকদের আনাগোনায় পা ফেলার জায়গা থাকে না ছোট্ট দোকানটিতে। তিন পুরুষের ব্যবসায় ৯৩ বছর ধরে বরিশালে জনপ্রিয়তায় শীর্ষ অবস্থান ধরে রেখেছে প্রতিষ্ঠানটি। আশ্চর্যের বিষয় দোকান শুরুর সময়ের ঘড়িটি এখনও সঠিক সময় দেয় দেয়ালে। পাশেই আছে সেই আমলের কাঠের বাক্সের রেডিও। দধি ঘরের সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব হলো কাঁসার বাটিতে খাবার পরিবেশন।
ঐতিহ্য ধরে রেখে অতিসাধারণ দধি ঘরটি এখন বরিশালের আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে উঠেছে। দিনে দিনে আরও জনপ্রিয়তা বাড়ছে বলে জানান দধি ঘরের কারিগর জাহাঙ্গীর হোসেন। টানা ৪৯ বছর ধরে নিজ হাতে দধি, ছানা, মাখন, ঘি, ঘোলসহ মুখরোচক খাদ্য প্রস্তুত করে আসছেন তিনি।
জাহাঙ্গীর হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতিদিন ১০০ থেকে ১২০ লিটার খাঁটি দুধ এনে নিজের হাতে মানসম্মত ও খাটি মিষ্টান্ন তৈরি করি। স্বাদ ভালো হওয়ায় প্রজন্মের পর প্রজন্ম অর্থাৎ দাদা, বাবা, ছেলে, নাতি বা তার ছেলে ধারাবাহিকভাবে সকলের প্রিয় আমাদের দধি ঘরের খাবার।
তিনি আরও বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অনেকে কুয়াকাটা ভ্রমণে আসেন। আমি দেখেছি তারা বরিশালে নেমে দধি ঘরে খেয়ে কুয়াকাটা যান, আবার ফেরার পথে এখানে খাওয়াদাওয়া করেন। দধি ঘরে খেয়ে মানুষ তৃপ্তি পায়। অরিজিনাল কাঁচামাল দিয়ে অরিজিনাল খাবার তৈরি করি বিধায় মানুষ আমাদের এত ভালোবাসে।
ষাটোর্ধ্ব আনিসুর রহমান বলেন, ঢাকা থেকে বাড়িতে বেড়াতে এসেছি। যে কয়দিন আছি প্রতিদিন দধি ঘরে এসে দধি-চিড়া, ঘোল, মুড়ি মিক্সচার খাচ্ছি। আমি দেশ ও দেশের বাইরে অনেক স্থানে এসব খেয়েছি। কিন্তু গির্জা মহল্লার দধি ঘরের খাবারের চেয়ে বেশি সুস্বাদু কোথাও পাইনি।
প্রতিবেদককে ছেলেবেলার গল্প শোনালেন আয়নাল হক। তিনি বলেন, প্রাইমারি স্কুলে যখন পড়তাম তখন আমার বাবার হাত ধরে দধি ঘরে এসে খেতাম। তখন প্রতিপ্লেট ছিল আট আনা। আমি এখনও নিয়মিত দধি ঘরে খাই। আমার সন্তান, নাতি অর্থাৎ পুরো পরিবারের পছন্দ দধি ঘরের খাবার।
আয়নাল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ওদের খাবার পরিবেশনের মধ্যে আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে। কাঁসার বাটিতে খাবার খাওয়ার স্বাদ এবং অনুভূতি আলাদা। এর ভালোলাগা বয়সী লোকেরা একটু বেশি বুঝবে।
দধি ঘরে ৫০ থেকে ১০০ টাকার মধ্যে দধি, চিড়া, ঘোল, মুড়ি, মাখনের প্লেট পাওয়া যায় জানিয়ে তিনি আরও বলেন, বর্তমান বাজার দরের সঙ্গে তুলনা করলে ওদের খাবারের প্লেটের দাম বেশি না। দধি ঘরে অরিজিনাল ঘি পাওয়া যায়।
দধি ঘরের বর্তমান মালিক মিজানুর রহমান মনির ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি দধি ঘরের তৃতীয় পুরুষ উত্তরাধিকার। ৯৩ বছর আগে আমার দাদা মিনহাজ উদ্দিন অবিকল ডেকোরেশনে, কাঁসার পাত্রে খাবার পরিবেশন পদ্ধতিতে দোকান চালু করেন। তার মৃত্যুর পর আমার বাবা আব্দুল আজিজ প্রতিষ্ঠানটি চালিয়েছেন। এখন আমরা চালাচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে একটু কষ্ট হয়। কিন্তু ভরসার জায়গা হচ্ছে মানুষের ভালোবাসা। আমরা চেষ্টা করি বাপ-দাদার আমলের সুনাম ধরে রাখতে। আমাদের প্রতিটি পণ্য খাঁটি কাঁচামাল দিয়ে উৎপাদিত। যে কারণে আমরা স্বাদ আর জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পেরেছি।
এমজেইউ