আমার ঢাকা পোস্ট, ঢাকা পোস্টের আমি

দেখতে দেখেতে পথচলার পাঁচ বছরে পদার্পণ করল জনপ্রিয় নিউজ পোর্টাল ঢাকা পোস্ট। নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছে দেশের ইতিহাসে মর্যাদাপূর্ণ এই সংবাদমাধ্যমটির একজন সহযাত্রী হতে পেরে। ২০২১ সালের আজকের দিনে দেশব্যাপী বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু হয় আমাদের। প্রতিশ্রুতি ছিল সত্যের সাথে সন্ধি রাখার। পুরো টিমের আকাঙ্ক্ষাও ছিল বিক্রিত বা বিকৃত সংবাদভাষ্য তৈরি করে মুখরোচক কোনো টনিক পাঠককে গেলাবো না। আমরা নিরপেক্ষতাকে ঠকাবো না। নিরস, নিরাসক্ত এবং ঘটনার মর্মমূলের তথ্য সন্নিবেশিত করে প্রাঞ্জল ভাষায় সংবাদ পরিবেশন করব।
আমাদের সেই প্রতিশ্রুতির কতটুকু অর্জিত হয়েছে সেই বিচার পাঠকের হাতে। তবে ঢাকা পোস্টের একজন ক্ষুদ্র অংশীজন হিসেবে বলতে পারি যাত্রা শুরুর প্রথম দিন থেকে চার বছর শেষ করে আজকে অর্থাৎ ১ হাজার ৪৬১ তম দিনে এসেও আমরা অবিচল সত্যের সাথে।
দেশের ইতিহাসে অনলাইন গণমাধ্যমের যাত্রা খুব পুরোনো নয়। যতগুলো নিউজ পোর্টাল সাংবাদিকতার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে তার মধ্যে নিঃসন্দেহে ঢাকা পোস্ট সেরা। এই মতামত অবশ্য আমার না, সাধারণ পাঠকের। যেহেতু অঙ্কুরোদগম থেকে বিকাশমান পরিক্রমায় যুক্ত রয়েছি সেজন্য এই পথচলায় অসংখ্য মানুষের সাথে মিথস্ক্রিয়া হয় সংবাদসূত্রে। সমাজের সব শ্রেণি পেশার মানুষের সাথে কোনো না কোনো কারণে ঢাকা পোস্টের পরিচয়ে কথা হয়। এদের কিছু মানুষ নিউজ পোর্টাল হিসেবে চেনেন, কেউ ফেসবুক পেইজ হিসেবে আবার অনেকে ইউটিউব চ্যানেল হিসেবে জানেন ঢাকা পোস্টকে। যেহেতু দেশে শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত ও অক্ষরজ্ঞানহীন লোকও রয়েছে— এরা যে যে মাধ্যমে ইন্টারনেটে যুক্ত সেই মাধ্যমে পরিচিত হয়েছে ঢাকা পোস্টের সাথে। আমি যেটা বলতে চেয়েছি, প্রিয় ঢাকা পোস্ট অন্তত সব শ্রেণি-পেশার মানুষের দরজায় কড়া নাড়তে পেরেছে। এটাকে আমি সফলতা মনে করি।
আমি ঢাকা পোস্টের হয়ে বরিশালে কাজ করছি। বরিশাল বলতে শুধু যে বরিশাল জেলায় তেমন নয়, পুরো বিভাগের সবগুলো জেলার নিউজ করার অবাধ স্বাধীনতা দেওয়া আছে। এটা শুধু আমাকেই নয়, আমাদের সকল জেলা এমনকি উপজেলার সহকর্মীও করতে পারেন। মুশকিল হলো সুযোগ থাকলেও অনেক সময় হয়ে ওঠে না। কারণ প্রতিটি মুহূর্ত আমাদের নজর রাখতে হয় চলমান পরিস্থিতি, আশপাশের ঘটনাবলী নিয়ে। প্রতিটি ঘটনার পর্যালোচনা করতে হয়। প্রতিটি সংবাদের নেপথ্যে ঘটনা কিন্তু সব ঘটনাই সংবাদ যে নয় তা সজাগ দৃষ্টিতেই অনুসরণ করে সিদ্ধান্তে আসতে হয়। এজন্য সময় ও সমাজকে নিয়মিত অধ্যায়ন করতে হয়। ফলে ঢাকাপোস্টের সংবাদ নির্বাচন এবং সংবাদ মান বন্ধুপ্রতিম অন্য নিউজ পোর্টালগুলো থেকে আলাদা। মানুষের মাঝে অল্প দিনে তাই গ্রহণযোগ্যতাও পেয়েছে তারুণ্যেদীপ্ত ঢাকা পোস্ট। আর এই তাগিদ আসে আমাদের বন্ধুবৎসল ডেস্ক থেকে। বন্ধুবৎসল শব্দটি ব্যবহার করেছি এই কারণে, ঢাকা পোস্টের উপজেলার সহকর্মী থেকে শুরু করে প্রধান বার্তা বা অন্যান্য যেসব বিভাগ রয়েছে সবার সাথে একটি আন্তরিক, সমমর্যাদা ও সহায়তার বন্ধন দৃঢ়। দৃঢ় করেছে টিম ওয়ার্ক।
চার বছরে বিভিন্ন আঙ্গিকে সাড়ে তিন হাজারের বেশি নিউজ করেছি ঢাকা পোস্টে। মোটাদাগে টপিকগুলো যদি বলি, এর মধ্যে রয়েছে সাম্প্রতিক ঘটনা, রাজনীতি, সামাজিক, অপরাধ, মানবাধিকার, দুর্নীতি, পরিবেশ-প্রকৃতি, আইন আদালত, ভয়ংকর দুর্ঘটনা, মানবিক সংবাদ, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, পর্যটন ইত্যাদি বিষয়ে। এসব সংবাদ করতে গিয়ে প্রতিকূল পরিস্থিতির শিকার যে হইনি তেমন নয়। মামলার শিকার হয়েছি, হামলার ভয়ে আড়ালে থেকেছি আবার কখনো কখনো প্রশংসায় ভেসেছি। সবমিলিয়ে টক-ঝাল-মিষ্টির স্বাদের জার্নি সাংবাদিকতার। সাংবাদিকতা মানেই ঝুঁকি নেওয়া। এটি জেনে বুঝেই নিজেকে উৎসর্গ করেছি। সুতরাং কে কখন বৈরী পরিবেশ সৃষ্টি করেছে সেসব স্মরণ রাখতে চাই না। বিপরীতে ঢাকা পোস্টের মাধ্যমে তুমুল আলোচিত কিছু নিউজ করেছি যাতে মানুষের নিরঙ্কুশ ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছি— সেসবই আজ স্মরণ করতে চাই।
সাংবাদিকতার স্বাদ প্রথম অভিভূত করে ২০২১ সালের ২৯ জুলাইয়ে করা প্রতিবেদনে। তখন নিদারুণ করোনাকাল। লকডাউন। কাউনিয়ার বাসিন্দা আর্টিস্ট মাহাবুব আলম মেয়ের দুধ কিনতে পারছিলেন না টাকার অভাবে। রং-তুলি ফেলে নেমে পড়েন রিকশা নিয়ে। ‘মেয়ের জন্য দুধ কিনতে আর্টিস্ট বাবা রিকশা নিয়ে রাস্তায়’ শিরোনামে ভিডিও সংবাদ প্রচার করি। এরপরের ঘটনা ইতিহাস। ঢাকা পোস্টের সংবাদে আস্থা রেখে সারাদেশ থেকে সহায়তা পাঠালো সাধারণ পাঠক। পাশে দাঁড়ালো সরকারি দফতরগুলো। সংবাদ প্রকাশের পর অন্তত দুই সপ্তাহ মাহাবুবের জন্য সময় দিতে হয়েছে। প্রতিদিন পাঠকরা মাহাবুবের খোঁজখবর নিতেন, সহায়তা করতেন। সেই নিউজ আর সবার সহায়তায় মাহাবুবের জীবন বদলে যায়।
নিজের কাছে এত ভালো লেগেছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। সেই অনুভূতি আর ঢাকা পোস্টের প্রতি পাঠকের আস্থা দেখে তুমুল বেগে ছুটতে শুরু করি সংবাদের পেছনে। ঢাকা পোস্টের সংবাদ প্রকাশের পর চিকিৎসার ব্যবস্থা হয়েছিল ব্লাড ক্যান্সার আক্রান্ত শিশু জান্নাত, শিশু হাফসা, কিশোর রিয়নের। যদিও এর মধ্যে জান্নাত আর রিয়ন আর আমাদের মাঝে নেই। মুজিব বর্ষের ঘর বিতরণে অনিয়ম নিয়ে সংবাদ প্রচার করায় তা পুনর্বণ্টন হয়েছিল। সরকারি সহায়তা পেয়েছে ৩৫ জনের বেশি। পাসপোর্ট অফিস, ভূমি রেজিস্ট্রি অফিস, থানা, বিআরটিএ, সিটি কর্পোরেশনের অনিয়মের সংবাদ হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিল।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন, সিটি নির্বাচন, উপজেলা, ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে তৎকালীন ক্ষমতাশীনদের বিরুদ্ধে করা নিউজগুলো এখনো মানুষের মুখে মুখে আলোচিত হয়।
নিউজ করতে গিয়ে ট্রমার মধ্য দিয়েও যেতে হয়েছে। বিশেষ করে অভিযান ১০ ট্রাজেডির নিউজ কভার করে মাসখানেক ঘুমাতে পারিনি। সেই বিভৎসতা চোখের সামনে ভেসে উঠতো। আবার ঝড়-বন্যায় উদ্দাম নিয়ে গাও-গেরাম ঘুরে বেড়ানো এবং আর্ত মানুষের গল্প তুলে আনাও শিখেছি ঢাকা পোস্টের মাধ্যমে।
ডেস্ক থেকে মফস্বলের আমাদের প্রতিনিয়ত স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়, ঢাকা পোস্টে একজনমাত্র বস, তিনি সম্পাদক মহোদয়। এছাড়া বাকি সকলেই সহকর্মী। ফলে কাজের উদ্দীপনাও আসে সমান্তরাল। আসলে ঢাকা পোস্টে যদি আমরা সম্মিলিতভাবে কাজ না করতে শিখতাম তাহলে হয়তো আমাদের গল্প বিচ্ছিন্ন ও ভিন্ন হতো।
ঢাকা পোস্ট শুধু সংবাদই নয় সহকর্মীদের বিপদে যেমন পাশে দাঁড়াতে শিখিয়েছে তেমনি আনন্দ ভাগাভাগিও করে নিতে উৎসাহিত করে। আমাদের তাই দেশের ৬৪ জেলার প্রতিনিধিদের সাথে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ হয়। আমাদের সারাদেশ একই সুঁতোয় গাথা।
দেশের ইতিহাস বদলেছে, প্রেক্ষাপট বদলেছে কিন্তু ঢাকা পোস্টের একটি বিষয় বদলেনি তা হলো কর্মীদের সময়মতো বেতন পরিশোধ পদ্ধতি। আমরা প্রায়ই মাস শেষ হওয়ার আগেই বেতন পেয়ে যাই। মফস্বলের কর্মীদের জন্য এমন দায়বদ্ধতা সত্যি বিরল।
ঢাকা পোস্টের মাধ্যমেই দেশে মাল্টিমিডিয়া সংবাদের বহুল প্রসার ঘটে। উদ্বোধনের পরই সারাদেশে প্রতিনিধিদের ভিজ্যুয়াল সাংবাদিকতায় সংযুক্ত করে বুম সরবারহ করা হয়। এতে আমাদের সংবাদ সংগ্রহ প্রক্রিয়াও সহজ হয়। তথ্য নিখাদ থাকে। আমাদের পরে আরও অনেকে একই প্রক্রিয়া অবলম্বন করেছে। আর এখনতো অনলাইন বলতেই মাল্টিমিডিয়া সংবাদ চর্চা।
সব কিছু মিলিয়ে ঢাকা পোস্টে আমার জার্নিটা অত্যন্ত আনন্দের এবং আশাব্যাঞ্জক। পথচলা শুরুর তিনটি টেলিভিশন স্টেশনে সুযোগ এসেছিল। কিন্তু সচেতনভাবেই এড়িয়ে গেছি সেই প্রস্তাব। কারণ অনলাইন হলেও ঢাকা পোস্ট আমাকে যেভাবে সম্মানিত করেছে, কাজের শৃঙ্খল আর বন্ধুত্বে আগলে রেখেছে তা সহজেই ছিন্ন করার সক্ষমতা আমার নেই। ফলে এই পরিবারেই রয়ে গেছি।
হয়তো কখনো এমন ইতিহাসও বদলে যেতে পারে জীবনের বাকবদলে। তবে ঢাকা পোস্টই আমার জীবনের সেরা সংবাদমাধ্যম, সেরা অভিজ্ঞতা আর সোনালী সময়। ঢাকা পোস্ট দীপ্ত প্রেরণায় এগিয়ে চলবে পাঠকের আস্থায়।
লেখক : সৈয়দ মেহেদী হাসান, নিজস্ব প্রতিবেদক (বরিশাল), ঢাকা পোস্ট
আরএআর