ঢাকা পোস্ট আমার কাছে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়

২০২৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। প্রথম সন্তানের প্রথম জন্মদিন, এক আনন্দময় দিন। হঠাৎ ঢাকা পোস্টের এইচআর থেকে ফোন। নিয়োগ পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হলাম। এরপর একে একে গণমাধ্যমটির সঙ্গে কেটেছে প্রায় দুই বছর। ‘সত্যের সাথে সন্ধি’ স্লোগানে যাত্রা শুরু করা গণমাধ্যমটির বিশাল পরিবারের সদস্য হিসেবে চলছে পথচলা।
ঢাকা পোস্টে আমার দেওয়ার তুলনায় প্রাপ্তির জায়গাটাই বেশি সমৃদ্ধ। কিছু ঘটনার তথ্য মিলে করা সংবাদগুলো এনে দিয়েছে গণমাধ্যমকর্মীর পরিচিতি। সর্বমহলে অর্জিত সুনাম বাড়িয়েছে কাজের স্পৃহা। ঢাকা পোস্ট আমার কাছে প্রাথমিক স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় মনে হয়। এই প্রাথমিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস রুমগুলো হচ্ছে আমার কর্মের জায়গা। যেখানে আমি বিচরণ করে শিখেছি অনেক কিছু। সেই শিক্ষা ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে নিজেকে মেলে ধরতে পেরেছি। যুক্ত থেকে ঘুরেছি জেলা ও বিভাগ থেকে অন্য বিভাগ। এ অর্জন কখনো শেষ হওয়ার নয়।
ঢাকা পোস্টের কর্মী হিসেবে প্রতিদিন নতুন নতুন অভিজ্ঞতার সাক্ষী হচ্ছি। জেলাজুড়ে মানুষের দুঃখ, কষ্ট, আনন্দ, বেদনার মানবিক গল্পগুলো তুলে আনছি, যা প্রকাশের ফলে ভুক্তভোগীরা উপকৃত হচ্ছেন। শুধু তাই নয়, অভাব-অভিযোগের কথাগুলো তুলে ধরতে আসে নানা প্রতিবন্ধকতা। এমন বাস্তবতায় কেউ জোগায় সাহস, কেউবা আবার হতাশা। দিন দিন সাংবাদিকতায় সত্যকে সত্য বলে প্রকাশের ঝুঁকি বাড়ছে। ফলে এক প্রকাশিত খবর ভুক্তভোগীর কথা উঠে এলেও অপরপক্ষের মনে বারে গোস্যা (রাগ)। সবমিলিয়ে শত ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার নামই ঢাকা পোস্ট।
ঢাকা পোস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে ২০২১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি। প্রতিষ্ঠার দুই বছর পর ‘নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী’ হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলাম গণমাধ্যমটিতে। সেই থেকে আজ অবধি চলছে পথচলা। দীর্ঘ পথচলায় ঢাকা পোস্টের মাধ্যমে তুলে ধরা বিভিন্ন সংবাদ পাঠকের মন জয় করেছে। শুধু পাঠকই নন, শুভ কামনা এসেছে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সহযোদ্ধাদের থেকেও। সবমিলিয়ে ঢাকা পোস্ট আর ঢাকা পোস্টের কর্মী হিসেবে সবার মাঝে নিজের পরিচয় ফোটে উঠেছে।
ঢাকা পোস্টে কাজের সুবাদে আজ নানা ঘটনার সাক্ষী। ঢাকা পোস্টে সংবাদ প্রকাশের সুবাদে উপকারভোগী ও ভুক্তভোগী বিভিন্ন প্রকাশিত সংবাদের সাক্ষী আজ। কারণ প্রকাশিত সংবাদ কারও পক্ষে যাবে, আবার কারও বিপক্ষে; এটাই স্বাভাবিক নিয়ম। ভুক্তভোগীর পক্ষে গেলেও অত্যাচারকারীর বিপক্ষে যাবে এটাই স্বাভাবিক। এসব বিষয় নিয়ে এক ধরনের ঝুঁকি তৈরি হয় সংবাদকর্মীর জীবনে। সব ঝুঁকি উপেক্ষা করে ‘সত্যের সাথে সন্ধি’ আমাদের।
বলতে বলতে মনে পড়ে গেল ঢাকা পোস্টে কাজের সুবাদে অনেক প্রকাশিত সংবাদের কথা। তারমধ্যে দু-একটি ঘটনার মধ্যে শুরুর দিকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের লাশকাটা ঘর (মর্গ) নিয়ে বেশ কয়েকটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল ঢাকা পোস্টে। তারমধ্যে একটি সংবাদ পাঠকের মধ্যে বেশ আলোচনায় ছিল ‘পুরুষ দিয়েই চলছে নারীদের ময়নাতদন্ত’। পুরো সংবাদে রাজশাহী বিভাগের সব হাসপাতালগুলোর লাশকাটা ঘরের হাড়ির খবর ছিল।
আমার এখনো পরিষ্কার মনে আছে- তৎকালীন রাজশাহী বিভাগীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তা আনারুল কবীর বিষয়টি শুনে বেশ অবাক হয়েছিলেন। বলেছিলেন- ‘বিষয়টি আমি মন্ত্রণালয়ের সভায় তুলব।’ এও বলেছিলেন- হাসপাতালগুলোতে পুরুষ ডোমের সংকট রয়েছে। তারপর নারী ডোম নিয়োগের বিষয়টি বলেছেন। ধর্মীয় দিক বিবেচনায় নারী ডোম প্রয়োজন।
২০২৩ সালের ১৫ মে ঢাকা পোস্টে প্রকাশিত ‘অক্সিজেনের পাইপ নাকে নিয়ে রিকশা চালান তিনি’ শিরোনামে একটি সংবাদ। মুহূর্তেই সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। ঢাকা পোস্টে প্রকাশিত সংবাদের ছবি- ‘ভারতের গণমাধ্যম আনন্দবাজার পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে ছাপা হয় সেন্টুর সংবাদ।’ এরপর ৫৫ বছর বয়সী মাইনুরজ্জামান সেন্টুর দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন অনেকেই। সেদিন সন্ধ্যায় আমার কাছে ফোন আসে মাইনুরজ্জামান সেন্টুর চিকিৎসা সহায়তা করবে বলে। সংবাদটি রাজশাহীর একটি ফুড গ্রুপে করা পোস্ট থেকে এক ব্যক্তি মাইনুরজ্জামান সেন্টুর জন্য অক্সিজেন কনসেনট্রেটর মেশিন কিনে দেবেন। এরপর হাসপাতালে ভর্তি হন মাইনুরজ্জামান সেন্টু।
এরপর বিষয়টি রাজশাহী তৎকালীন জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদের নজরে আসে। তিনি হাসপাতালে গিয়ে সেন্টুর চিকিৎসার সব খরচ বহনের ঘোষণা দেন। এরপর ধীরে ধীরে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে সেন্টুর সাহায্যে এগিয়ে আসেন অনেকেই। সেন্টুর সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ঢাকা পোস্ট অফিসে ফোন দিয়েও অনেকে আমার মুঠোফোন নম্বর নিয়ে কল দিয়েছেন। এ ছাড়া দেশের বাইরে থেকেও ফোন এসেছিল। সংবাদমাধ্যমে কাজের সুবাদে এরচেয়ে ভালো প্রাপ্তি আর কি হতে পারে।
২০২৪ সালের ২৩ মার্চ ‘রেলসেতুতে ২৭টি স্লিপার আটকাতে ১৯ টুকরো কাঠের বাটাম’ এমন শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়। সেদিনই সংস্কারের কাজ শুরু হয় রেলসেতুতে। তিন দিন ধরে রেলসেতুটির সংস্কারের কাজ করেন রেলওয়ের কর্মীরা। এতে কমেছে দুর্ঘটনার ঝুঁকি ও বিকট শব্দ, জনমনে কমে আতঙ্ক; ফেরে স্বস্তি। সেবাপ্রার্থীদের ভোগান্তি নিয়ে বিআরটিএ ও পাসপোর্ট অফিসের প্রকাশিত সংবাদে মিলেছে জনমনে স্বস্তি।
সবমিলিয়ে চণ্ডী পাঠ দিয়ে দিন শুরু হলেও শেষ হয় জুতা সেলাই দিয়ে। কারণ ঢাকার বাইরে আমরা যারা মফস্বলে কাজ করি তাদের আলাদা আলাদা বিট ভাগ করা নেই। তাই জুতা সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সবই করতে হয় আমাদের। একটা কথা বলতেই হয়- সাংবাদিকতায় বেতনের প্রসঙ্গ এলে অনেক সাংবাদিক চুপসে যান। সেই বিষয়ে ঢাকা পোস্ট কর্মীদের মূল্যায়নের জায়গায় বন্ধপরিকর। শেষ কথা- আমি ঢাকা পোস্ট পরিবারের একজন কর্মী। যারা কি না অন্য সহকর্মীর দুঃসময়ে পাশে দাঁড়াতে শিখেয়েছে। শুভ জন্মদিন ঢাকা পোস্ট।
লেখক : শাহিনুল আশিক, নিজস্ব প্রতিবেদক (রাজশাহী), ঢাকা পোস্ট
এমজেইউ