প্রবেশ পাসে লেখা ছিল ‘স্টেডিয়ামের বাইরে’

কখনো ভাবিনি পুরোদস্তুর একজন সাংবাদিক হয়ে উঠব। তবে অনেকের মতো ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার কথাও কখনো ভাবিনি বা নিজেকে প্রস্তুত করা হয়নি। বরং খুব ছোটবেলায় হতে চেয়েছিলাম ট্রাকচালক। তারপর ঘুরেফিরে, হেলেদুলে নানাভাবে কেটে যাচ্ছিল আমার দিনগুলো। পাশাপাশি চলছিল পড়াশোনাও। তখনো ভেবে ওঠা হয়নি যে, সাংবাদিকতায় যুক্ত হব। তবে কোনো ঘটনা, ঘটনার পেছনের ঘটনা নিয়ে আমার কৌতূহল সেই শৈশব থেকেই। এলাকাসহ দেশ ও বিদেশের খবরাখবর রাখার ব্যাপারে আমার দুর্নিবার আগ্রহ।
এভাবেই একসময় যুক্ত হয়ে যাই নিউজ পোর্টাল ঢাকা পোস্টের সঙ্গে। ঢাকা পোস্টের যাত্রা শুরু ২০২১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি। এখানে আমি কাজ শুরু করি ২০২১ সালের ১৬ জুন। আমার প্রথম নিউজ আসে ১৭ জুন। নিউজটি ছিল ফরিদপুরে করোনায় দুজন মারা যাওয়ার বিষয়ে। নিয়োগপত্র হাতে পাই ওই বছর ২১ নভেম্বর।
ওই বছরই একটি ঘটনা আমার মানে আজও গেঁথে আছে। ২০২১ সালের ৩ অক্টোবর রোববার সন্ধ্যায় ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে একটি গোয়ালঘরের ভেতরে বজ্রপাতে পুড়ে মারা যায় এক কৃষকের দুটি গাভি। এ ঘটনায় দুই চোখে যেন অন্ধকার দেখতে পান ওই কৃষক। কেননা ওই গাভি দুটিই ছিল তার আয়ের একমাত্র উৎস। বজ্রপাতে শেষ সম্বল হারিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন ফরিদপুরের বোয়ালমারীর দাদপুর ইউনিয়নের আমুরদি গ্রামের ৬৫ বছর বয়সী কৃষক হাবিবুর রহমান।
এ খবরটি ছবিসহ ঢাকা পোস্টে প্রকাশ হয়। এতে ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। ঢাকা পোস্ট.কম এর বর্তমান জৈষ্ঠ্য বার্তা সম্পাদক মাহাবুর আলম সোহাগের মাধ্যমে এগিয়ে আসেন দুই ব্যক্তি। সেই বৃদ্ধ কৃষককে সহায়তা দেন। সহায়তার টাকায় ওই কৃষককে কিনে দেওয়া হয় দুটি গাভি। সেদিন প্রথম সাংবাদিকতার আসল উদ্দেশ্য ও আনন্দ বুঝতে পারি। এ খবরটির কথা ভাবলে আমার মন এখনো অনাবিল আনন্দে ভরে ওঠে।
এখন প্রতিদিন খবরের পেছনে ছুটতে ছুটতে আমার দিন কেটে যায়। বিশেষ প্রতিবেদনের পাশাপাশি আমাদের কাজ তাৎক্ষণিক ঘটনা নিয়েও। কোথাও সংঘর্ষ, হত্যাকাণ্ড কিংবা সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করতে হলে পুলিশের বক্তব্য নেওয়া জরুরি ও অনিবার্য। তবে পুলিশের বক্তব্য নিতে গিয়ে আমাদের প্রতিনিয়ত বিড়ম্বনার মুখে পড়তে হয়। এসব নানা প্রতিকূলতা মাথায় রেখেই আমাদের কাজ করতে হয়। কেননা সাংবাদিকতার পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়, পদে পদে রয়েছে বিপদের হাতছানি।
তবে সাংবাদিকতার জীবনে এমন অনেক ঘটনাও ঘটে যা দীর্ঘদিন মানসপটে রেখাপাত করে যায়, যা ভুলতে চাইলেও ভুলা যায় না। এমনই একটি ঘটনা ঘটে ২০২৩ সালের ২৪ জুন। ওই দিন ঢাকা থেকে ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা আসার পথে ভাঙ্গার মালিগ্রামের এক্সপ্রেসওয়ের রেলিংয়ে ধাক্কা লেগে একটি অ্যাম্বুলেন্সে আগুন ধরে যায়। এতে আটজন নিহত হন। সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ছিলাম ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গের সামনে। মর্গের সামনে একটি নসিমন। সেখানে হাইওয়ে পুলিশের বিশেষ ব্যাগে মোড়ানো আট ব্যক্তির দগ্ধ মরদেহ। কাছে গেলে পোড়া পোড়া গন্ধ নাকে লাগে।
নসিমনের পাশে বসে ভাবছিলাম কয়েক ঘণ্টা আগেও যারা জীবিত ছিল, জীবনের প্রয়োজনে দৌড়ে বেড়িয়েছেন এখন তারা একটি নসিমন ওপর লাশ হয়ে পড়ে আছেন। সন্ধ্যায় স্বজনরা এসে মরদেহগুলো নিয়ে গেল। নসিমনটি যখন মর্গ এলাকা ছেড়ে যাচ্ছে তখন মনে হলো সকালে তারা কত পরিকল্পনা করে দিন শুরু করেছিলেন। অথচ সন্ধ্যায় তাদের শেষ গন্তব্যে চলে যেতে হচ্ছে। এইতো মানবজীবন, ‘যার নেই এক মুহূর্তের নিশ্চয়তা, চোখ বুঝলেই দুনিয়া আন্ধার।’
আরেকটি ঘটনার কথা মনে পড়লে আজও হাসি পায়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২৩ সালের ১০ অক্টোবর ফরিদপুরের ভাঙ্গায় আসেন। এ উপলক্ষ্যে কাজী আবু ইউসুফ স্টেডিয়ামে এক জনসভার আয়োজন করা হয়। এ সংবাদ কাভার করার জন্য জেলা পুলিশের তরফ থেকে কার্ড দেওয়া হয়। কোনো সাংবাদিকই আগে বিষয়টি বুঝতে পারেননি। তারা ভেবেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর জনসভার স্থলের পাশে সাংবাদিকদের নির্ধারিত জায়গায় বসে তারা নিউজ সংগ্রহ করতে পারবেন। সাংবাদিকরা যখন স্টেডিয়ামের ভেতরে ঢুকতে যান তখন আটকে দেয় নিরাপত্তারক্ষীরা। সাংবাদিকদের যে পাসগুলো দেওয়া হয়েছে তাতে লেখা ছিল ‘স্টেডিয়ামের বাইরে’। অগত্যা আমাদের স্টেডিয়ামের বাইরে ঘোরাফেরা করেই সংবাদ সংগ্রহ করতে হয়েছিল সেদিন। এ কথা ভেবে আজও মনের অজান্তে হেসে উঠি। স্থানীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে কী ব্যবহারটাই না করা হয়েছিল সেদিন।
আমি কাজের সময় সতর্ক থাকি যেন মিথ্যা বা অতিরঞ্জিত কিছু মনের অজান্তেও লিখে না ফেলি। কেননা আমার পরিবেশিত একটি ভুল তথ্য ব্যক্তি, গোষ্ঠী কিংবা সমাজের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে।
বলতে দ্বিধা নেই যে, দায়িত্ববোধ ও বস্তুনিষ্ঠতা যা শেখার শিখেছি ঢাকা পোস্টে জড়িত আমার সব সহকর্মীদের কাছ থেকে। এজন্য আমার সহকর্মীদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। বলা যায়, ‘যা চেয়েছি যা পেয়েছি, তার তুলনা নেই।’
লেখক : জহির হোসেন, জেলা প্রতিনিধি (ফরিদপুর), ঢাকা পোস্ট
আরকে/এমজেইউ