৯ ঘণ্টা খাটুনি, মজুরি মাত্র ৩০০ টাকা!

গাইবান্ধা জেলায় বয়ে চলা তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার বুক চিরে গড়ে ওঠা চর আর দ্বীপচরের সংখ্যা ১৬৫টি। বিস্তীর্ণ নদীভাঙা ভূমিতে গড়ে ওঠা এসব চরে বাস করে লাখ লাখ মানুষ যাদের অধিকাংশই দারিদ্র্যসীমার নিচে। এখানকার জীবন সংগ্রামী, প্রকৃতিনির্ভর, আর বৈষম্যে মোড়ানো।
এই চরাঞ্চলের মানুষের প্রধান অবলম্বন কৃষিকাজ। বছরের প্রায় পুরোটা সময় ধরেই চলে নানা ফসলের আবাদ। ধান, গম, মরিচ, পেঁয়াজ, আর শহরগামী সবজি। তবে চরবাসীর সবচেয়ে বড় আস্থার ফসল হলো ভুট্টা। হাজার হাজার বিঘা জমি জুড়ে শুধুই ভুট্টার মাঠ। যা এই অঞ্চলের কৃষি অর্থনীতির মেরুদণ্ড।
তবে সেই অর্থনীতির চালিকাশক্তি যারা, তারা যেন সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত। ভুট্টার মাঠে প্রতিদিন সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত যারা হেলে-দুলে কাস্তে চালান, মাথায় ঝুড়ি বয়ে ফসল তোলেন, তাদের একটি বড় অংশ চরাঞ্চলের নারী শ্রমিকরা।
তাদের কাজের ঘণ্টার কোনো কমতি নেই, ঘাম ঝরানো শ্রমের ঘাটতিও নেই। কিন্তু পারিশ্রমিক? একজন পুরুষ শ্রমিক যেখানে সারাদিন কাজ করে পান ৬০০ টাকা, সেখানে নারীরা পাচ্ছেন মাত্র ৩০০ টাকা। শুধুমাত্র নারী হওয়ায় তারা এ বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।

প্রতিবছর মহান মে দিবস শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের কথা বিশেষভাবে উচ্চারিত হলেও কৃষিপ্রধান অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় কৃষি শ্রমিকরা থেকে যান আলোচনার বাইরে।
ভুট্টা তোলা, মরিচ তোলা কিংবা মাটির কাজ, সব কিছুতেই তাদের রয়েছে সমান বিচরণ। অথচ সেই কাজের প্রকৃত মূল্য তাদের হাতে পৌঁছায় না। দিনশেষে ক্লান্ত দেহ, ঝলসে যাওয়া ত্বক আর হাতে গোনা টাকা—এটাই যেন তাদের নিয়তি।
স্থানীয়রা জানান, পুরুষদের তুলনায় নারীরা সমান পরিশ্রম করলেও মজুরিতে রয়েছে বিস্তর ফারাক। কেউ কেউ আবার অভিযোগ করছেন, কাজের ধরন বুঝে পুরুষদের অতিরিক্ত টাকা দিলেও, নারীদের সেই সুযোগও দেওয়া হয় না।
আরও পড়ুন
গাইবান্ধার সদর, ফুলছড়ি, সাঘাটা ও সুন্দরগঞ্জ এই চরের উপজেলার যমুনা, ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তা নদীর বুক চিরে রয়েছে ছোট-বড় ১৬৫টি চর। এসব চরে প্রচুর পরিমাণে হয়ে থাকে কৃষির চাষাবাদ। এসব চরের মাঠে কাজ করে থাকেন নারীদের একটি বড় অংশ।
সরেজমিনে, সদর উপজেলার কামারজানি ইউনিয়নের পোড়ার চর, সিধাই এবং ফুলছড়ি উপজেলার রসূলপুর, হারোডাঙা, গুপ্তমনি ও রতনপুরসহ বেশ কয়েকটি চর ঘুরে দেখা যায়, ভুট্টা ও মরিচ তোলার উৎসবমুমুখর পরিবেশে কর্মচাঞ্চল্যতা চলছে। এসব চরে যারা কাজ করছেন তাদের ৯০ ভাগই নারী শ্রমিক। মরিচ ও ভুট্টার খেতে কাজ করে থাকেন শতভাগ নারীরা। আর ওই দশ ভাগ পুরুষ শ্রমিকদের দেখা যায় কেবল ভুট্টা ভাঙার মেশিনে কাজ করতে।
এ সময় কথা হয় হারো ডাঙার চরে ভুট্টা তোলার নারী শ্রমিক আলেয়া বেগমের সঙ্গে। জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা সকাল সাড়ে ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে ভুট্টা তোলার কাজ শুরু করি। কাজ শেষ করি বিকেল ৫টারও পরে। আমাদের কামলার দাম (মুজুরি) দেওয়া হয় ৩০০ টাকা।

অপর নারী শ্রমিক মরিয়ম বেগম বলেন, এখন ভুট্টা ও মরিচ তোলার সময়। আমরা পুরুষদের সঙ্গে ভুট্টা ভাঙার কাজ করছি। আমরা ৩০০ টাকার বিনিময়ে সারাদিন রোদে পুড়ে কাজ করি। অথচ আমাদের সঙ্গে যে তিনজন পুরুষ কাজ করছে তাদের মুজুরি ৬০০ টাকা। একই সঙ্গে, একই সময় কাজ করে আমরা অর্ধেক দাম পাই। এসময় এক প্রশ্নের জবাবে জোবেদা বলেন, কি করমো (করবো) তাছাড়া খাবো কি? আমরা গরিব মানুষ।
এসময় নারীদের সঙ্গে ক্ষেতে থাকা জমির মালিক হোসনে আরা বলেন, আমরা তিন বিঘা জমিতে ভুট্টার চাষ করেছি। ফলন ভালো হয়েছে। নারীদের দিয়ে ভুট্টা উঠাচ্ছি, নারীদের কিছুটা কম দামে পাওয়া যায়। পুরুষদের দ্বিগুণ মজুরি দিতে হয়। অথচ নারীরাও সমান কাজ করে থাকেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই বৈষম্য শুধুই অর্থনৈতিক নয়, এটি একটি সামাজিক অবমূল্যায়নেরও প্রতিফলন। তাদের মতে, সরকারি কিংবা বেসরকারি উদ্যোগে এই শ্রমিক নারীদের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা জরুরি।
এখন প্রশ্ন হলো—এই শ্রম, এই ঘাম, এই নিরব প্রতিবাদ কবে পৌঁছাবে আমাদের নীতিনির্ধারকদের কানে? চরের এই নারীরা শুধু মজুরি নয়, চান সম্মান ও অধিকার।
এ ব্যাপারে নারীমুক্তি কেন্দ্রের গাইবান্ধার সাধারণ সম্পাদক নিলুফার ইয়াসমিন শিল্পী বলেন, সব ক্ষেত্রেই নারীদের সঙ্গে বৈষম্যের মাপকাঠি আজও বিদ্যমান। নারী শ্রমিকদের শ্রমের বৈষম্য নিরসনে সরকার তথা প্রশাসনকে কাজ করতে হবে। প্রশাসন শুধু খাতা-কলমে কাজ দেখালে চলবে না। মাঠ পর্যায়ে নীতিমালা বাস্তবায়নে কাজ করতে হবে।
গাইবান্ধার জনসংখ্যা ২৪ লাখ ৫৫ হাজার ৭১৯ জন। এর মধ্যে শতকরা ৫৪ ভাগ পুরুষ এবং ৪৬ ভাগ নারী।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র বলছে, জেলায় শতকরা ৯৮ ভাগই কৃষি পরিবার। জেলার ৬ লাখ ১ হাজার ৭২১টি কৃষক পরিবারের মধ্যে শতকরা ৩৮ ভাগই প্রান্তিক কৃষক পরিবার, ৩১ ভাগ ক্ষুদ্র কৃষক, ২০ ভাগ ভূমিহীন কৃষক, ৯ ভাগ মাঝারি কৃষক এবং মাত্র ২ ভাগ বড় কৃষক পরিবার রয়েছে। জেলায় মোট কৃষি পরিবারের মধ্যে বর্গাচাষি পরিবারের সংখ্যা ৭১ হাজার ৭৭২টি। সাত উপজেলায় কৃষি বিভাগের তালিকাভুক্ত কৃষি শ্রমিক রয়েছেন ৫৫ হাজার ৬৫০ জন ।
রিপন আকন্দ/আরকে