তীব্র নদী ভাঙনের কবলে ভোলার শিবপুর, হুমকিতে শহর রক্ষা বাঁধ

মেঘনা নদী তীরবর্তী ভোলা সদর উপজেলার শিবপুর ইউনিয়নে তীব্র নদী ভাঙন দেখা দিয়েছে। মেঘনার ভাঙনে ইতোমধ্যে নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে অনেকের ভিটেমাটি ও ফসলি জমিসহ নানান স্থাপনা। ভাঙন আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটছে বাঁধের ভেতরে ও বাহিরে বসবাসকারী হতদরিদ্র মানুষদের। ইতোমধ্যে ভিটেমাটি ও ফসলি জমি হারিয়ে দিশেহারাদের কেউ কেউ অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন তাদের বসতঘর। ভাঙনের হুমকিতে রয়েছে জেলা শহর রক্ষা বাঁধ।
নিজেদের ভিটেমাটি ও শহর রক্ষা বাঁধ রক্ষার্থে আসন্ন বর্ষা মৌসুমের আগেই সিসি ব্লকের মাধ্যমে স্থায়ীভাবে ভাঙনরোধে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের জোড়ালো দাবি জানিয়েছে এলাকাবাসী।
সরেজমিনে শিবপুর ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের শিবপুর গ্রামের স্লুইসগেট, মাছঘাটসহ বেশ কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, তীব্র নদী ভাঙনের কবলে পড়েছে অন্তত চার কিলোমিটার এলাকা। সম্প্রতি আগ্রাসী রুপ ধারণ করেছে মেঘনা, গত কয়েকমাস ধরে এ ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। এতে নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার হুমকিতে রয়েছে বেশ কয়েকটি বাজারসহ অনেকের ভিটেমাটি ও ফসলি জমি। অন্যদিকে নদী থেকে শহর রক্ষা বাঁধের দূরত্ব প্রায় ৫৫ মিটার।
স্থানীয়দের অভিযোগ, এভাবে নদী ভাঙন অব্যাহত থাকলে আগামী বর্ষা মৌসুমে যে কোনো মুহূর্তে জেলা শহর রক্ষা বেড়িবাঁধ ভেঙে জেলা শহর পানিতে ডুবে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। ভোলা জেলা শহর রক্ষা বেড়িবাঁধসহ শিবপুর ইউনিয়নকে মেঘনার ভয়াবহ ভাঙন থেকে রক্ষার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড নামেমাত্র কিছুসংখ্যক জিওব্যাগ ডাম্পিং ব্যতীত নদী ভাঙনরোধে স্থায়ী পদক্ষেপ নিচ্ছে না।
কথা হয় স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুর রহিমের সাথে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, নদীটা আরও ওদিকে ছিল।ভাঙতে ভাঙতে এখানে চলে আসছে (বেড়িবাঁধ সংলগ্ন)। এই নদীর পেটে আমার দেড় কানি জমি চলে গেছে। বর্তমানে ৫ গন্ডা জমি আছে। চাষাবাদ করে খাই। নদী ফের আমার জমির কাছে চলে আসছে। আগামী বর্ষাতে হয়তো অবশিষ্ট জমিটুকুও আর থাকবে না। জমিটুকু ভেঙে নদীতে নিয়ে গেলে একেবারে ফকির হয়ে যাব।
স্থানীয় বাসিন্দা মো. সিরাজ (৭০) বলেন, নদী ভাঙতে ভাঙতে এখন আমার বসতঘরের পাশে চলে এসেছে। আমার কোনো টাকা-পয়সাও নাই যে অন্য আরেক জায়গায় একটু জমি কিনে আরেকটা ঘর উঠাবো।
কৃষক মঞ্জুর আলম বলেন, আমার এই জমিটুকুতে চাষাবাদ করে সংসার চালাই। এ জমিটুকু যদি নদী ভেঙে নিয়ে যায় তাহলে ভিক্ষা করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। নদী ভাঙন বন্ধ করা গেলে আমার জমিটুকু রক্ষা পেত। চাষাবাদ করে খেতে পারতাম।
মো. সোহেল রানা বলেন, বেড়িবাঁধের ওপর পাশেই আমাদের বসতভিটা। মেঘনা নদী যেভাবে ভাঙতেছে মনে হয় না আমাদের বসতবাড়ি থাকবে। বেড়িবাঁধ ভেঙে গেলে আমাদের বসতভিটাও চলে যাবে এবং ভোলা সদরে পানি চলে যাবে।

এদিকে ভাঙন আতঙ্কে রাত-দিন সমানভাবে কাটছে বেড়িবাঁধের বাহিরে বসবাসকারীদের। ইতোমধ্যে কয়েকবার নদী ভাঙনের শিকার হয়ে হারিয়েছেন ভিটেমাটি ও বসতঘর। তাদের মধ্যে একজন বিধবা আনোয়ারা বেগম।
তিনি বলেন,নদী ভাঙনের কবলে পড়ে সর্বস্ব হারিয়ে বেড়িবাঁধের ভেতরে আশ্রয় নিয়েছি। নদী এখন ঘরের পাশে চলে এসেছে। এখানে আর থাকার সুযোগ নেই। তাই অন্যত্র ঘর ভেঙে সরিয়ে নিচ্ছি।
ইয়াসমিন বেগম ও রাবেয়া বলেন, ভাঙন আতঙ্কে রাতে ঠিকমত ঘুমাতে পারি না। অন্য জায়গায় জমি কিনে ঘর তোলার মতো সামর্থ্য আমাদের নেই। কী করব? এখানকার সবাই নিম্নআয়ের। দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে আমরা নদী ভাঙনের কবলে। আমাদের এখানকার বাসিন্দারা ইতোমধ্যে অনেকে সর্বস্ব হারিয়ে পথে বসেছি।
এ এলাকায় যখনই নদী ভাঙন শুরু হয় তখনই পানি উন্নয়ন বোর্ড নামেমাত্র কিছুসংখ্যক জিওব্যাগ ডাম্পিং করে তাদের ধোঁকা দেয় বলে অভিযোগ করেন স্থানীয় বাসিন্দা আল আমিন ও মো.ফারুক।
তারা বলেন,ডাম্পিংকৃত সে জিওব্যাগগুলো কিছু দিন পর নদীর স্রোতে নিয়ে যায়। আবার নদী ভাঙে,বারবার এ নদী ভাঙনের কবল থেকে আমরা রক্ষা পেতে চাই। সিসি ব্লকের মাধ্যমে শিবপুর ইউনিয়নের ভাঙন রোধ করে জেলা শহর রক্ষা বাঁধ সুরক্ষিত করার জোড়ালো দাবিও জানান তারা।
এ বিষয়ে ভোলা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জিয়া উদ্দীন আরিফ বলেন, ভোলা সদর উপজেলার শিবপুর ইউনিয়নে দেড় কিলোমিটার এলাকায় নদী ভাঙন দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে আধা কিলোমিটার এলাকায় অতিভাঙন দেখা দিয়েছে। শিবপুরে নদী ভাঙনরোধে পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ খাতের আওতায় ৬০ মিটারের জন্য বরাদ্দ পেয়েছি, জিওব্যাগ ডাম্পিং চলছে। বাকি এলাকার জন্য বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে, বরাদ্দ পেলে বাকি অংশে জিওব্যাগ ডাম্পিং করা হবে।
স্থায়ীভাবে ভাঙনরোধে সিসি ব্লক স্থাপন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পাউবোর এই প্রকৌশলী আরও বলেন, সিসি ব্লক নির্মাণের জন্য উন্নয়ন প্রকল্প প্রয়োজন। সিসি ব্লক নির্মাণের জন্য সরকারের নিকট প্রস্তাবনা পাঠাবো। আশা করছি সিসি ব্লকের মাধ্যমে ভাঙন স্থায়ীভাবে বন্ধ করা যাবে।
এদিকে সম্প্রতি সরেজমিনে ভাঙন কবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এনামুল হক। এতে আশার আলো দেখছেন স্থানীয়রা। অতিদ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি তাদের।
খাইরুল ইসলাম/আরএআর