রংপুরে দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শীর্ষ নেতাদের

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রংপুর জেলা ও মহানগর কমিটির শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে ওঠা অনিয়ম-দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, মামলা ও নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সংগঠনটির শীর্ষ নেতৃবৃন্দ।
সোমবার (১৯ মে) বিকেলে রংপুর নগরীর মুন্সিপাড়ায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জেলা কমিটির কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে নেতৃবৃন্দ তাদের প্রতি আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করেন।
জেলা কমিটির মুখপাত্র ইয়াসির আরাফাত বলেন, সংগঠন নিয়ে ম্যাসেঞ্জারে যেসব কথা-বার্তা হচ্ছিল। তা জেলা কমিটির সদস্য মাহমুদুর রহমান লিয়ন বাইরে স্ক্রিনশর্ট পাঠাতো। আমরা বিষয়টি জানতে পেরে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। সংগঠনের এমন সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে লিয়ন সংবাদ সম্মেলন করে আমাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা অভিযোগ তুলে সংগঠন থেকে পদত্যাগ করে।
গ্রামীণ ও কুটির শিল্প মেলায় লটারি ও হাউজিকে প্রশ্রয় দিয়ে মোটা অঙ্কের বাণিজ্যের বিষয়ে জেলা কমিটির সদস্য সচিব ডা. আসফাক আহমেদ জামিল বলেন, মেলা নিয়ে আমাদের সঙ্গে কোনো লেনদেন হয়নি। এটি কেউ কোনোভাবেই প্রমাণ করতে পারবে না। মেলাটি হয়েছে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে, জায়গাটিও সেনাবাহিনীর। সেনাবাহিনীর সঙ্গে ছাত্রদের ভালো সম্পর্ক অনেকের সহ্য হচ্ছে না। তারা আমাদের সেনাবাহিনীর মুখোমুখি দাঁড় করানোর অপচেষ্টা করছে। মেলা শুরু হলে হাউজি ও লটারি বন্ধে আমরা ডিসি স্যারের সঙ্গে কথা বলি।
রংপুর সিটি কর্পোরেশনে (রসিক) নিয়োগ বাণিজ্যের বিষয়ে তিনি বলেন, সিটি কর্পোরেশন থেকে বিগত দিনে চাকরিচ্যুতরা আমাদের কাছে আসলে আমরা তাদের পক্ষে সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক বিভাগীয় কমিশনার স্যারের কাছে সুপারিশ করি। তিনি তদন্ত কমিটি করে তাদের পুনর্বহালের ব্যবস্থা করেন। আমরা শুধু ২৫ জনকে চাকরিতে পুনর্বহালের সুপারিশ করেছি।
আরও পড়ুন
প্রশাসনের করা তদন্ত কমিটি চাকরি প্রাপ্তদের পুনর্বহাল করার সুযোগ নেই মর্মে প্রতিবেদন দাখিলের পরও ২৫ জনকে চাকরিতে পুনর্বহালে কেন জোর সুপারিশ করা হলো—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, চাকরি দিয়েছেন বিভাগীয় কমিশনার স্যার। কারণ এটি তার এখতিয়ারে রয়েছে। আমরা শুধু সুপারিশ করেছি। তবে এখানে কোনো লেনদেন হয়নি।
মিঠাপুকুরে অবস্থিত পাওয়ার প্লান্টে তদবির বাণিজ্যের বিষয়ে জেলা কমিটির আহ্বায়ক ইমরান আহমেদ বলেন, পাওয়ার প্লান্ট থেকে কিছু বাই প্রডাক্ট বের হয়। সেটি বিক্রির কিছু অংশ পাওয়ার প্লাটে জমি দেওয়া ব্যক্তিরা পান। ভুক্তভোগীরা যেন তাদের ন্যায্য অধিকার পান সে বিষয়ে আমরা কর্তৃপক্ষকে বলেছিলাম।
বন্যা দুর্গতের ত্রাণের টাকা আত্মসাতের বিষয়ে তিনি বলেন, ফেনীর বন্যার সময় তোলা টাকা থেকে ৮৭ হাজার টাকা বেঁচে যায়। সেই সময় আমাদের কোনো কমিটি ছিল না। পরে কমিটি হলে জেলা কমিটির তহবিলে ৪৩ হাজার ৫শ টাকা এবং বাকি টাকা মহানগর কমিটির তহবিলে দেওয়া হয়। এই টাকা এখনও বহালতবিয়তে রয়েছে। অনাগত দুর্যোগে আমরা সেই টাকা খরচ করবো।
এর আগে, গতকাল রোববার (১৮ মে) রাতে জেলা শিল্পকলা অ্যাকাডেমি মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলন করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন রংপুর জেলা ও মহানগর কমিটির শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, মামলা বাণিজ্য, অর্থ আত্মসাতসহ নানা অভিযোগ তুলে ধরে একযোগে ১৬ জন পদত্যাগ করেন।
পদত্যাগ করা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সংগঠক মাহতাব আবির ও সিয়াম আহসান আয়ান বলেন, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে রংপুর ঘাঘট নদের পাড়ে গ্রামীন কুটির ও শিল্প মেলায় জুয়ার আসর বসে। সেখানে জেলা ও মহানগর কমিটি মিলে ১৪ লাখ টাকা চাঁদা নেয়। এ ঘটনায় কমিটির সদস্যরা মহানগর ও জেলার শীর্ষ নেতাদের কাছে জানতে চাইলে তারা সদস্যদের কোনো জবাব দেননি।
ফেনীর বন্যার সময় ত্রাণের অবশিষ্ট ৮৭ হাজার টাকা আত্মসাৎ, রংপুর সিটি কর্পোরেশনে ২৫ কর্মচারী নিয়োগে লাখ লাখ টাকা বাণিজ্যসহ সংবাদ সম্মেলনে মামলা বাণিজ্যেরও অভিযোগ তোলা হয়।
রংপুর জেলা কমিটির আহ্বায়ক, সদস্য সচিবসহ চার শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে ওঠা চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ এবং এসবের পক্ষে পাওয়া প্রমাণ জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চেতনার পরিপন্থি উল্লেখ করে সংবাদ সম্মেলনে তারা বলেন, গুটিকয়েক নেতার দায় নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে যাওয়া সংগঠক ও সদস্যদের ওপর বর্তাচ্ছে। যা লজ্জাজনক ও অপমানজনক হওয়ায় জেলা ও মহানগর কমিটির সংগঠক ও সদস্যরা পদত্যাগ করেন।
পদত্যাকারী জেলা কমিটির ৫ নেতা হলেন—সদস্য মুবতাসিম ফুয়াদ সাদিদ, সৃজন সাহ, জুনাইদ ইসলাম, মাহতাব হোসেন আবির, সাওম মাহমুদ সিরাজ। অপরদিক মহানগর কমিটির ১১ জনের মধ্যে রয়েছেন—যুগ্ম সদস্য সচিব সিয়াম আহসান আয়ান, সংগঠক আদনান সামির, গোলাম আযম রাতুল, মাহদী হাসান অনিক, এনায়েত রাব্বি, সদস্য আরাফাত সানি আপন, আল শামস সিয়াম, সীমান্ত হোসেন, আল আমিন, মোজাহিদ ও আল তানজীল আহসান। এ ছাড়া ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে গড়ে ওঠা এই প্ল্যাটফর্ম থেকে আরও অর্ধশতাধিক কর্মী সরে আসার ঘোষণা দেন।
হঠাৎ করে একসঙ্গে এসব সংগঠক ও সদস্যদের পদত্যাগের বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশের ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে। সেইসঙ্গে সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের এমন কর্মকাণ্ডের অভিযোগ প্রকাশ পাওয়ায় নিন্দার ঝড় উঠে।
এর আগেও, গত ১৫ মে বৃহস্পতিবার দুর্নীতির অভিযোগ এনে পদত্যাগ করেন জেলা কমিটির আরেক সদস্য মাহমুদুর রহমান লিওন।
উল্লেখ্য, গত বছরের ২৪ নভেম্বর ইমরান আহমেদকে আহ্বায়ক ও ডা. আশফাক জামিলকে সদস্য সচিব করে ১৫৫ সদস্যবিশিষ্ট জেলা কমিটি এবং ইমতিয়াজ আহমেদ ইমতিকে আহ্বায়ক ও রহমত আলীকে সদস্য সচিব করে ১১২ সদস্য বিশিষ্ট মহানগর কমিটি ঘোষণা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
এ বছরের ৮ মার্চ সাংগঠনিক শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন রংপুর মহানগর কমিটির মুখপাত্র নাহিদ হাসান খন্দকারকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তার বিরুদ্ধে একটি বালু মহালে গিয়ে চাঁদাবাজির চেষ্টার অভিযোগ ওঠে এবং চাঁদাবাজির ঘটনার ভিডিও এবং অডিও সামাজিকমাধ্যমে ভাইরাল হয়।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এএমকে