ভোলায় সম্ভাবনাময় হোগলা পাতার দড়ি শিল্প, প্রয়োজন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা

ভোলায় ঘরে বসে হোগলা পাতা দিয়ে দড়ি বুনে ভাগ্য বদলেছে প্রায় অর্ধলক্ষ নারী। এ দড়ি দিয়ে বানানো বিভিন্ন কারুপণ্য রপ্তানি হচ্ছে বিশ্বের অন্তত ৫০টিরও বেশি দেশে। পরিবেশবান্ধব হওয়ায় প্লাস্টিকের পরিবর্তে এর চাহিদাও রয়েছে ব্যাপক। ফলে দ্বীপজেলা ভোলায় আশার আলো দেখাচ্ছে এ কুটির শিল্পটি। তবে রয়েছে যথাযথ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাব।
তবে উদ্যোক্তারা বলছেন, যথাযথ সরকারি সহযোগিতা না পাওয়ায় লোকসানের মুখে পড়ে বাধ্য হয়েই গত ৩০ বছরে বেশ কয়েকজন উদ্যোক্তা হাত গুটিয়ে নিয়েছেন অপার সম্ভাবনাময় এ খাত থেকে। যথাযথ সরকারি সহযোগিতা পেলে এ শিল্পটি ভোলার অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
সরেজমিনে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৫ সালের দিকে জেলায় এ কুটির শিল্পের পথচলা শুরু হয়। বর্তমানে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত ছোট-বড় উদ্যোক্তা রয়েছেন প্রায় ২০ জন। তাদের মধ্যে ভোলা সদর উপজেলার চরসামাইয়া ইউনিয়নে রয়েছেন ৮ জন। চরাঞ্চলে বেড়ে ওঠা হোগলা পাতা বেপারীদের কাছ থেকে কিনে গ্রামে নারী কারিগরদের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেন উদ্যোক্তারা। এরপর কারিগররা এসব পাতা কেটে পানিতে ভিজিয়ে রেখে নরম করে হাতে পাকিয়ে দড়ি বুনেন। উদ্যোক্তারা ফের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ১০০ হাত দড়ি ১৪ টাকা করে কিনে ৫ হাজার হাত করে প্রতি বান্ডিল বানিয়ে ঢাকার গাজীপুর ও আশুলিয়া, নীলফামারী, রংপুর, সিরাজগঞ্জ, নরসিংদী, ফরিদপুরসহ অন্যান্য স্থানের কারুপণ্য বানানোর ফ্যাক্টরিতে বিক্রি করেন ১০০ হাত ২২-২৪ টাকা দরে। ফ্যাক্টরিতে এসব দড়ি দিয়ে তৈরি করা হয় ঝুড়ি, পাপস, সোফা, প্লেসমেট, ফুলদানি ও মাথার ক্যাপসহ বিভিন্ন নান্দনিক পণ্য। যা বিক্রি হয় চড়া দামে।

স্বামীর স্বল্প আয়ের সংসারে স্বামীর পাশাপাশি ঘরে বসেই হোগলা পাতার দড়ি বুনে আয় করে সংসারে স্বচ্ছলতা ফিরিয়েছেন চরসামাইয়া ইউনিয়নের নাজমিন আক্তার, মনোয়ারা বেগম, রাবেয়া। বাপ্তা ইউনিয়নের লাইজু বেগম মিনজুসহ অসংখ্য নারী। তারা বলেন, উদ্যোক্তার হোগলা পাতা আমাদের বাড়িতে পৌঁছে দেন, পরে প্রতিটি পাতাকে মাঝখান দিয়ে কেটে পানিতে ভিজিয়ে নরম করে হাতে পাকিয়ে দড়ি বানাই। পরে ফের আমাদের থেকে প্রতি ১০০ হাত দড়ি ১৪ টাকা দরে তারা কিনে নেন।
তারা আরও বলেন, ঘরে বসে দড়ি বুনে দৈনিক ১৫০ থেকে ২০০ টাকা আয় করতে পারি। এ টাকা নিজেরা সংসারে ব্যয় করি এতে স্বামীকে সাহায্য করতে পারি।
কথা হয় ভোলা সদর উপজেলার চরসামাইয়া ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের চরছিফলি গ্রামের উদ্যোক্তা সিরাজ মোল্লা ও মো. হাবিবের সঙ্গে। তারা ঢাকা পোস্টকে বলেন, দীর্ঘ ২৫ বছর এ ব্যবসা করছি। প্রতি ১০০ হাত হিসেবে ১৪ টাকা দরে কারিগরদের কাছ থেকে দড়ি ক্রয় করি এবং ৫ হাজার হাত দড়ি এক বান্ডিল করা হয়। পরবর্তীতে ট্রাকের মাধ্যমে ঢাকার আশুলিয়া ও গাজীপুরসহ অন্যান্য স্থানের ফ্যাক্টরিতে প্রতি ১০০ হাত দড়ি ২৪ টাকা দরে বিক্রি করি। শ্রমিক ও পরিবহন ব্যয় বাদ দিলে আমাদের নিজেদের ভাগে তেমন কিছু থাকে না।
তারা আরও বলেন, অনেক সময় ফ্যাক্টরি মালিকরা অর্ডার দিয়েও দড়ি নেন না। ফলে বাধ্য হয়ে অন্যস্থানে কম দামে দড়ি বিক্রি করতে হয়। এতে প্রায়ই ক্ষতির সম্মুখীন হই। এছাড়া বিভিন্ন সময় হোগলা পাতা পঁচে যায়। আমরা ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে আবার ব্যবসা শুরু করি। একাধিকবার ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ায় দেনায় জর্জরিত হয়ে অনেকেই ব্যবসা ছেড়ে অন্য পেশায় যুক্ত হয়েছেন।
যথাযথ সরকারি সহযোগিতা না পাওয়ার অভিযোগ উদ্যোক্তা খোকন মোল্লা ও মো.সুমনের। তারা বলেন, হোগলা পাতার দড়ি দিয়ে ঝুঁড়ি,পাঁপস, সোফা, প্লেসমেট, ফুলদানি ও মাথার ক্যাপসহ বিভিন্ন নান্দনিক পণ্য তৈরি করা হয়। প্লাস্টিকের পরিবর্তে পচনশীল হওয়ায় দেশের বাজারসহ বিদেশের বাজারে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। আমাদের মাধ্যমে প্রায় অর্ধলাখ নারীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু সরকারিভাবে আমরা কোনো সুযোগ সুবিধা পাই না। যদি পেতাম তাহলে আরও বেশি নারীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারতাম। আমাদের প্রয়োজন সরকারি সহযোগিতা।

বিসিকের পক্ষ থেকে উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ ও সহজশর্তে ঋণ প্রদান করা হচ্ছে বলে জানান বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনের (বিসিক) ভোলার শিল্পনগরী কর্মকর্তা মো.হাবিবুল্লাহ। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভোলা জেলায় হোগলা পাতার কারুপণ্য শিল্পটি অনেক সম্ভাবনাময় খাত,এ খাতে যুক্ত রয়েছেন বেশ কয়েকজন উদ্যোক্তা। উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে বেকার নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে,তারা সাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
তিনি আরও বলেন, প্লাস্টিকের পরিবর্তে হোগল পাতার তৈরি কারুপণ্য বিশ্বের ৫০টির বেশি দেশে রপ্তানি হচ্ছে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বিসিক সবসময় এ শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের পাশে আছে।
এদিকে দ্বীপজেলার সম্ভাবনাময় শিল্পটিকে আরও বেশি সম্প্রসারিত করতে সরকারের সুদৃষ্টির জোরালো দাবি এ শিল্পে জড়িতদের। এতে একদিকে যেমন আরও বেশি কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে, অন্যদিকে আরও সমৃদ্ধ হবে এ জেলার অর্থনীতি।
খাইরুল ইসলাম/আরকে