এবার নির্দিষ্ট সময়ে বাজারে আসছে না হাঁড়িভাঙা আম

স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয় জিআই পণ্য স্বীকৃত সুস্বাদু হাঁড়িভাঙা আম এবার নির্দিষ্ট সময়ে বাজারে আসছে না। হাঁড়িভাঙার আনুষ্ঠানিকতা এবার দুই সপ্তাহ পেছাতে পারে। কারণ গাছে আমের মুকুল এক মাস দেরিতে এসেছে। ডিসেম্বরের শেষে জানুয়ারি প্রথম দিকে সাধারণত আমের মুকুল দেখা গেলেও এবার রংপুরে আমের মুকুল এসেছে ফেব্রুয়ারিতে। বর্তমানে আমের বয়স প্রায় চার মাস।
প্রতি বছর হাঁড়িভাঙা আম জুনের ২০ তারিখে আনুষ্ঠানিকভাবে বাজারজাত শুরু হলেও এবার তা দেড় থেকে দুই সপ্তাহ পিছিয়ে যাবে। তবে কৃষি অফিস বলছে, আবহাওয়া তপ্ত থাকলে এর আগেও গাছ থেকে আম পাড়া যেতে পারে।
কৃষি অফিস ও চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হাঁড়িভাঙা আমের মুকুল সাধারণত জানুযারি মাসে আসে। এবার একটু দেরিতে এসেছে। পাঁচ থেকে ছয় মাসের মধ্যে চাষিরা আম ঘরে তুলতে পারেন। এবার কিছুটা ব্যতিক্রম হয়েছে। দেরিতে মুকুল আসায় ফলও দেরিতে আসবে।
আমচাষিরা বলছেন, জুনের শেষ নয়তো জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে বাজারে মিলবে পরিপক্ব হাঁড়িভাঙা আম। এর আগে বাজারে হাঁড়িভাঙা আম পাওয়া গেলেও তা হবে অপরিপক্ব। হাঁড়িভাঙা প্রকৃত স্বাদ পেতে এবার একটু অপেক্ষায় থাকতে হবে। বর্তমানে বাগানগুলোতে আমের পরিচর্যা চলছে।
এদিকে হাঁড়িভাঙা আম সংরক্ষণে ‘গবেষণা জরুরি’ বলে দাবি করে চাষি ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই আম পরিবহনের জন্য বিশেষ বাস ও ট্রেন সার্ভিস চালু করা দরকার। একই সঙ্গে ন্যায্য দাম নিশ্চিতকরণে প্রশাসনকে উদ্যোগ নিতে হবে। হাঁড়িভাঙা আমের রাজধানীখ্যাত পদাগঞ্জ হাটের রাস্তাঘাটের সংস্কার এবং হাটে আম বিক্রির শেড নির্মাণ, ব্যাংকিং সুবিধা বাড়ানো, পাবলিক টয়লেট স্থাপন ও বৃষ্টির সময় পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করার জোর দাবি তাদের।
হাড়িভাঙা আম আবাদের লক্ষ্যমাত্রা
বিষমুক্ত ও অতি সুমিষ্ট আঁশহীন হাঁড়িভাঙা আমের চাহিদা বাড়ছে দিন দিন। কয়েক বছর ধরে ফলন ভালো হওয়ায় বেড়ে চলেছে আম উৎপাদনের পরিধিও। রংপুর সদর, মিঠাপুকুর ও বদরগঞ্জ উপজেলার বিস্তৃত এলাকার ফসলি জমি, বাগানসহ উঁচু-নিচু ও পরিত্যক্ত জমিতে চাষ হচ্ছে এই আম।
এবার রংপুর জেলায় আম আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তিন হাজার ৩৫৯ হেক্টর। এর মধ্যে হাঁড়িভাঙা আম এক হাজার ৯১০ হেক্টরের বেশি জমিতে চাষ হয়েছে। প্রতি হেক্টরে হাঁড়িভাঙা আম প্রায় ১০ থেকে ১২ মেট্রিক টন ফলন হয়। সব কিছু ঠিক থাকলে অন্তত দুই শ কোটি টাকার ওপরে হাঁড়িভাঙা আম বিক্রি হবে বলে জানিয়েছে চাষি ও ব্যবসায়ীরা।
সম্প্রতি রংপুরের মিঠাপুকুর ও বদরগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, শেষ সময়ে ঝড়-বৃষ্টির হাত থেকে আম রক্ষা করতে পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন চাষিরা। এ মৌসুমে তিন দফায় ঝড় হওয়ায় ফলনে কিছুটা ব্যঘাত ঘটতে পারে বলে শঙ্কা করছেন তারা। একই সঙ্গে আবহাওয়া অধিদপ্তরের সাম্প্রতিক ঝড়ের পূর্বাভাস নতুন করে উদ্বেগ বাড়িয়েছে আমচাষিদের মধ্যে।
মিঠাপুকুর উপজেলার খোড়াগাছ ইউনিয়নের তেকানি গ্রামের আমচাষি বেলাল হোসেন বলেন, এবার গাছে আমের মুকুল এক মাস দেরিতে এসেছে। মুকুল আসার পর থেকে তিন বার ঝড় হয়েছে। এর ফলে আমের ফলন গতবারের তুলনায় কম হয়েছে। আম পাড়ার আর দেড় মাস সময় বাকি। যদি ফের বড় ধরনের ঝড়-বৃষ্টি হয় তাহলে আমরা বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ব।

যেভাবে হাঁড়িভাঙার গোড়াপত্তন ও সম্প্রসারণ
হাঁড়িভাঙা আমের গোড়াপত্তন করেছিলেন খোড়াগাছ ইউনিয়নের তেকানি গ্রামের নফল উদ্দিন পাইকার নামে এক বৃক্ষবিলাসী মানুষ। স্বাধীনতার আগের বছর ১৯৭০ সালে নফল উদ্দিন পাইকার ১২০ বছর বয়সে মারা যান। এখন তার লাগানো হাঁড়িভাঙা গাছটির বয়স ৭৬ বছর।
নফল উদ্দিন পাইকারের ছেলে আমজাদ হোসেন ঢাকা পোস্টকে জানান, সম্ভবত ১৯৪৯ সাল, তখন তার বাবা নফল উদ্দিন এই গাছটি রোপণ করেছিলেন। উপজেলার বালুয়া মাসুমপুর গ্রামটি ছিল ঝোপজঙ্গলে ভরপুর। সেই এলাকার একটি জমি থেকে দুটি আমের চারা নিয়ে এসে কলম করেন তার বাবা। তবে একটি গাছ চুরি হয়ে যায়। বাকি গাছটিতে মাটির হাঁড়ি বেঁধে পানি (ফিল্টার সিস্টেমে) দেওয়া হতো। একদিন রাতে কে বা কারা মাটির হাঁড়িটি ভেঙে ফেলে।
তিনি আরও জানান, গাছটিতে এক সময় বিপুল পরিমাণ আম ধরে। খেতে খুবই সুস্বাদু। বিক্রির জন্য বাজারে নিয়ে গেলে লোকজন এই আম সম্পর্কে জানতে চায়। তখন থেকেই গাছটি হাঁড়িভাঙা নামে পরিচিতি পায়। এখন হাঁড়িভাঙা আমের সুনাম মানুষের মুখে মুখে। গড়ে উঠেছে হাজার হাজার বাগান। তিনি হাঁড়িভাঙা আমের মাতৃগাছটির সংরক্ষণের দাবি জানান।
১৯৯২ সাল থেকে হাঁড়িভাঙা আমের সম্প্রসারণ শুরু হয় আখিরাহাটের আব্দুস সালাম সরকারের হাত ধরে। শুধু চাষবাদ নয়, এই অঞ্চলের হাঁড়িভাঙা সম্প্রসারণে তার অবদান অনস্বীকার্য। তার হাত ধরেই রংপুর অঞ্চলের মানুষ এখন অন্যান্য ফসলের চেয়ে বেশি লাভের আশায় উঁচু-নিচু ও পরিত্যক্ত জমিতে প্রতিবছর হাঁড়িভাঙা আম চাষের দিকে ঝুঁকছেন।
আব্দুস সালাম সরকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে হাঁড়িভাঙা আমের চাষ করছি। টেকসই অর্থনীতির জন্য হাড়িভাঙা আমের সংরক্ষণের জন্য হিমাগার স্থাপন, আধুনিক আমচাষ পদ্ধতি বাস্তবায়ন ও গবেষণা কেন্দ্র স্থাপনের দাবি করে আসছিলাম। কিন্তু বিভিন্ন কারণে এই দাবি উপেক্ষিত হলেও আমের উৎপাদন ও বাগান সম্প্রসারণ থেমে নেই। সরকার একটু দৃষ্টি দিলেই হাঁড়িভাঙাকে ঘিরে এই অঞ্চলের অর্থনীতি আরও চাঙ্গা হবে।
হাঁড়িভাঙা আমের বৈশিষ্ট্য
ভালো মানের হাঁড়িভাঙা আম চেনার উপায় প্রসঙ্গে আমজাদ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, হাঁড়িভাঙা আমের ওপরটা যত কালচে, ভেতরে ততই সুন্দর। এর স্বাদ ও মিষ্টি লোভনীয়। দেখতে সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন আমে কীটনাশক ও স্প্রে ব্যবহার বাগান কিনে নেওয়া ব্যবসায়ীরা নিজেদের লাভের জন্য করে থাকেন। এতে আম দেখতে ভালো, সুন্দর ও পাকা রঙের মনে হয়।
হাঁড়িভাঙা আমের বৈশিষ্ট্য হলো এটি আঁশবিহীন, মিষ্টি ও সুস্বাদু। এই আমের আঁটিও খুব ছোট। ছাল পাতলা। প্রতিটি আমের ওজন হয় ২০০ থেকে ৩০০ গ্রাম। মৌসুমের শুরুতে হাঁড়িভাঙার চাহিদা বেশি থাকায় এর দাম কিছুটা বেশি হয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে প্রতি কেজি হাঁড়িভাঙা আকারভেদে ৬০ থেকে ১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতে পারে।
আরও পড়ুন
আম সংরক্ষণে গবেষণার দাবি
চাষিরা বলছেন, হাঁড়িভাঙা আম পাকলে এটি তিন-চার দিনের বেশি রাখা যায় না। সংরক্ষণের কোনো কার্যকর পদ্ধতি নেই। যদি এই আম সংরক্ষণের সঠিক প্রক্রিয়া থাকত, তাহলে স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব হতো।
তরুণ উদ্যোক্তা মেহেদী হাসান বলেন, দীর্ঘদিন ধরে শুনে আসছি, কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এই আমের লাইফলাইন নিয়ে কাজ করছে। কিন্তু, আমরা এখনো এর কোনো সুফল দেখিনি। সম্প্রতি হাঁড়িভাঙা আম জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পেলেও স্থানীয়ভাবে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। অনেক চাষি ও ব্যবসায়ী এই স্বীকৃতির গুরুত্ব সম্পর্কেও অবগত নন।
রংপুর কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, হাঁড়িভাঙা আম সংরক্ষণের ওপর কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কাজ করছে। তবে কবে নাগাদ গবেষণার ফল আসবে, তা নিশ্চিত করে বলতে পারেনি সংশ্লিষ্ট দপ্তর। হাঁড়িভাঙার লাইফলাইন ও সংরক্ষণ পদ্ধতি নিয়ে স্থানীয় এবং জাতীয় পর্যায়ে গবেষণা চলছে।
কৃষি বিভাগ ও জেলা প্রশাসনের আশ্বাস
রংপুর অঞ্চলে হাঁড়িভাঙা আমের ফলন সবচেয়ে বেশি হলেও ফজলি, সাদা ল্যাংড়া, কালা ল্যাংড়া, মিশ্রিভোগ, গোপালভোগ, আম্রপালিসহ আরও অনেক জাতের আম চাষ হয়। তবে এসব আমের মধ্যে হাঁড়িভাঙার চাহিদা সবচেয়ে বেশি।
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (উদ্যান) হাবিবুর রহমান জানিয়েছেন, চলতি বছর রংপুর জেলায় তিন হাজার ৩৫৯ হেক্টর জমিতে আম চাষ করা হচ্ছে। এর মধ্যে এক হাজার ৯১০ হেক্টরে চাষ করা হচ্ছে হাঁড়িভাঙা। আম উৎপাদনের লক্ষ্য ধরা হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার মেট্রিক টন।
এখনো হাড়িভাঙা আম পাড়া নিয়ে সুনির্দিষ্ট তারিখ নির্ধারণ করা হয়নি। তবে মুকুল দেরিতে আসায় পরিপক্ব আম পেতে কিছুটা বিলম্ব হতে পারে। মে মাসের শেষ সপ্তাহে পদাগঞ্জ হাটে জেলা প্রশাসন, কৃষি বিভাগ ও চাষিদের সমন্বয়ে আনুষ্ঠানিক বৈঠকে গাছ থেকে আম পারার ব্যাপারে তারিখ নির্ধারণ করা হবে।
রংপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রবিউল ফয়সাল বলেছেন, ‘জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পাওয়া হাঁড়িভাঙা আম বাজারজাত করতে এবার যাতে কোনো অসুবিধা না হয়, সে বিষয়ে মনিটরিং করা হবে। বিশেষ করে পরিবহনে যাতে ব্যবসায়ীদের কোনো হয়রানির শিকার হতে না হয়, সেজন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পাশাপাশি সরকারি পরিবহন সুবিধার বিষয়টিও দেখা হবে। নির্ধারিত সময়ের আগে হাঁড়িভাঙা আম বাজারজাত না করতে চাষিদের পরামর্শ দিয়েছেন জেলা প্রশাসক।
আরএআর