অন্ধ হলেও বন্ধ নেই তার কোনো কাজ

ইচ্ছাশক্তির জোরে প্রতিবন্ধিতাকে জয় করেছেন যশোরের নাসির উদ্দিন। অন্ধ হয়েও আর দশজন স্বাভাবিক মানুষের মতোই কাজ করছেন তিনি। ধান কাটা, বাঁধাই, ঝাড়াই, পালা দেওয়া, এমনকি বিচালিও কাটছেন নিমেষেই। দেখে বোঝার উপায় নেই তিনি অন্ধ। হাসিখুশি ও কাজের প্রতি আগ্রহের কারণে সবাই তাকে কাজে নেন।
৪৫ বছর বয়সী নাসিরের আক্ষেপ, সব কাজ করতে পারলেও অন্ধ হওয়ায় তাকে পারিশ্রমিক দেওয়া হয় কম। প্রবল ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন নাসিরকে সরকারি সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।
২০০০ সালে রস পাড়তে খেজুরগাছে ওঠেন। এ সময় চোখে একটি পোকা পড়ে। এতে তার দৃষ্টিশক্তিতে সমস্যা দেখা দেয়। তারপর বিভিন্ন জেলায় সব ধরনের চিকিৎসা নিয়ে কোনো সুফল না পাওয়ায় শেষে ভারতে গিয়েও চিকিৎসা নিয়েছেন। কিন্তু আর ফিরে পাননি দৃষ্টি। সে বছর থেকেই চোখে কিছু দেখতে পান না।
নাসির উদ্দিনের বাড়ি যশোরের শার্শা উপজেলার লক্ষ্মণপুর গ্রামে। তার বাবার নাম মোহর আলী। ৮ ভাইয়ের মধ্যে বয়সী নাসির দ্বিতীয়। বছর বিশেক আগে এক দুর্ঘটনায় দৃষ্টিশক্তি হারান তিনি। দেশ-বিদেশে চিকিৎসা নিয়েও ফল মেলেনি। তিন ছেলেমেয়েসহ পাঁচজনের সংসার। এক কাঠা জমির ওপর ভাঙাচোরা খুপরিতে বসবাস। জীবিকার তাগিদে বাধ্য হয়ে শিখে নিয়েছেন সব কাজই। সারা দিনে যে পারিশ্রমিক পান, তাতে নুন আনতে পানতা ফোরায়। তবু আত্মসম্মানবোধ থেকে হাত পাতেননি কোনো সময়, কারও কাছে। এখন দুশ্চিন্তা ছেলেমেয়েকে নিয়ে। কীভাবে তাদের ভবিষ্যৎ চলবে?
শুরুর গল্পটা নাসির উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০০০ সালে রস পাড়তে খেজুরগাছে ওঠেন। এ সময় চোখে একটি পোকা পড়ে। এতে তার দৃষ্টিশক্তিতে সমস্যা দেখা দেয়। তারপর বিভিন্ন জেলায় সব ধরনের চিকিৎসা নিয়ে কোনো সুফল না পাওয়ায় শেষে ভারতে গিয়েও চিকিৎসা নিয়েছেন। কিন্তু আর ফিরে পাননি দৃষ্টি। সে বছর থেকেই চোখে কিছু দেখতে পান না।
একে তো অভাবের সংসার, তার ওপর একজন উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। কিন্তু অসুস্থ হওয়ায় সংসারের চাকা আর চলে না। একসময় অভাব গ্রাস করে। তবে আত্মসম্মানবোধ থেকে হাত পাতেননি কারও কাছে। নাসির বলেন, ছোটবেলা থেকে কৃষিকাজে অভ্যস্ত থাকায় এখন অন্ধ হয়েও সব ধরনের কৃষিকাজ করতে পারি। প্রথম প্রথম একটু সমস্যা হলেও এখন আল্লাহর রহমতে সুস্থ মানুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কাজ করতে পারি। তিনি আরও বলেন, অন্ধ হলেও আমার বয়স প্রায় শেষের দিকে। কত দিন আর বাঁচব? কিন্তু দুশ্চিন্তা হয় আমার তিন সন্তানকে নিয়ে। বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। দুই সন্তান অনেক ছোট। পরিবার নিয়ে খুপরির মধ্যে বাস করি। শীতে ঠান্ডা আর বর্ষায় পানি ঢোকে। থাকার মতো কোনো জায়গাজমি নেই। সরকারের কাছে আমার দাবি, আমাকে কিছু না দিলেও মরার আগে আমার ছোট এই সন্তানদের জন্য একটু থাকার মতো কোনো বাড়ি করতে পারলেও মরেও শান্তি পেতাম।
নাসিরের এমন দশা থেকে উত্তরণের জন্য সরকারি সহায়তা চান তার বাবা মোহর আলী। তিনি বলেন, নাসির ছোটবেলায় সুস্থ ছিল। সেই সঙ্গে সে খুব কাজেরও। ২০০০ সালে একদিকে বন্যা, অন্যদিকে নাসিরের দৃষ্টিরোগে ভুগতে লাগল। অর্থের অভাবে তাকে ঠিকমতো চিকিৎসা করাতে পারিনি। এখন অন্ধ হয়েও সে ভালো কাজ করতে পারে। শুধু কৃষিকাজ নয়। বাড়িতে ধানমাড়াই করা, গরু-ছাগলকে খাবার দেওয়াসহ তার দৈনন্দিন সব কাজ সে নিজেই করে। অনেক কষ্ট করে পরেও কাজ করলেও সে সঠিক মূল্যায়ন পায় না। তার অভাবের সংসার দেখে আমি দুচিন্তায় থাকি। তার একটা গতি হলে আমিও অন্তত মরার আগে হলেও একটু শান্তি পেতাম।
এলাকার বাসিন্দা রহমত হোসেন বলেন, সুস্থ মানুষ যে কাজ করতে পারে না। নাসির তাদের চেয়ে ভালো কাজ করতে পারে। এ লোকের সাথে আমাদের মহল্লার কেউ কাজ করে পারে না। তার ধান বাঁধা দেখলে আপনারা অবাক হয়ে যাবেন।
রহমত হোসেন নামের স্থানীয় এক কৃষক বলেন, নাসির কাজে ফাঁকি না দেওয়া আর বেশি কাজ করায় খুশি হয় গৃহস্থরা। চোখে না দেখলেও নাসিরের কাজের গতির কাছে হার মানে তার সহকর্মীরা। ভিক্ষা না করে নাসির ইচ্ছাশক্তির জোরে সব ধরনের কাজ করে। তাই সরকারের উচিত নাসির ও তার পরিবারের ওপর সুদৃষ্টি দেওয়া।
বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে অন্ধ হয়েও মানুষের দ্বারে দ্বারে হাত না পেতে সব ধরনের কাজ করায় হতদরিদ্র নাসিরকে আমি সাধুবাদ জানাই। উপজেলা প্রশাসন থেকে সব ধরনের সরকারি সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে তাকে।
পুলক কুমার মন্ডল, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, শার্শা
নাসিরের বড় ভাই আলাউদ্দিন বলেন, নাসিরকে তার ৮ বছর বয়সী এক ছেলে মাঠে নিয়ে যায়। কাজ শেষ হলে আবার সেই মাঠ থেকে নিয়ে আসে। নাসির আমাদের সাথে মাঠে দলে কাজ করে। আমাদের মতো সুস্থ মানুষের মতো একই তালে তালে কাজ শেষ করে। তবে তার কাজের সঠিক মূল্য দেয় না। আমরা তাকে নিয়ে অনেক দুশ্চিন্তা রয়েছি। ইউনিয়ন থেকে একটি প্রতিবন্ধী কার্ড পেয়েছে। তাতে তার সংসার চলে না। ভাঙাচোরা খুপরিঘরে তার তিন সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, উপজেলায় অনেক বড়লোক ঘর পাচ্ছে। কিন্তু নাসিরের মতো লোক ঘর পাওয়ার যোগ্য হয়ে ওঠেনি এই সরকার বা জনপ্রতিনিধিদের কাছে!
লক্ষণপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আনোয়ারা খাতুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি নাসির অন্ধ হলেও সে সুস্থ মানুষের মতো সব কাজ করতে পারেন। শুরুতে কিছুটা সমস্যা হলেও গেল প্রায় দুই দশক ধরে সব কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। প্রবল ইচ্ছাশক্তি দিয়ে তার অভাবের সংসার চালাচ্ছেন। কারও দয়ায় বাঁচতে চায় না সে। ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে তার পাশে দাঁড়ানো হয়েছে। তবে সরকারিভাবে আরও সহযোগিতা প্রয়োজন।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পুলক কুমার মন্ডল ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে অন্ধ হয়েও মানুষের দ্বারে দ্বারে হাত না পেতে সব ধরনের কাজ করায় হতদরিদ্র নাসিরকে আমি সাধুবাদ জানাই। উপজেলা প্রশাসন থেকে সব ধরনের সরকারি সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে তাকে।
এনএ