শহীদ ওমরের পোষা ময়নার মুখে ‘আম্মা’ ডাক শুনে বুক ফেটে যায় মায়ের

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর, পার হয়ে গেছে প্রায় ১১ মাস। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেশের পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে। কিন্তু এখনো বইছে জুলাই আন্দোলনে শহীদ ওমর ফারুকের গর্ভধারিনী মা কুলসুম আক্তারের মনের ভেতর ঝড়। ১৯ জুলাই শুক্রবার জুম্মার নামাজ শেষে মাকে ফোন করে তার ছেলে বলেছিলেন, আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না মা। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! এখন চিন্তা করার জন্য তার ছেলেটাই আর বেঁচে নেই।
জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের তথ্যানুযায়ী সারাদেশে নিহতের সংখ্যা ৮২০ এর উপরে এবং ১১ হাজার ৮৫০ এর ওপরে মানুষ আহত হয়েছেন। এর মধ্যে নেত্রকোণা জেলায় নিহত হয়েছেন ১৭ জন এবং আহত ১৪১ জন। এর মধ্যে শহীদ ৬৮৬ জনকে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে আর্থিক সহায়তা করা হয়েছে। তাদেরই একজন জেলার দুর্গাপুর উপজেলার ওমর ফারুক।
শহীদ ওমর ফারুকের বাড়ি নেত্রকোণা জেলার দুর্গাপুর উপজেলার বাকলজোড়া ইউনিয়নের সিংহা গ্রামে। যদিও গ্রামের বাড়িতে তারা বসবাস করতেন না। দুর্গাপুর উপজেলা শহরের দক্ষিণপাড়া এলাকায় বসবাস করতেন তারা। বাবা আব্দুল খালেক ও মা কুসুম আক্তারের দুই ছেলে সন্তানের মধ্যে বড় ছেলে ওমর ফারুক ও ছোট ছেলে আব্দুল্লাহ অনিক। জীবনের তাগিদে ওমর ফারুকের বাবা আব্দুল খালেক সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে বসবাস করেন।
তার মায়ের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওমর ফারুক ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে অবস্থিত কবি নজরুল কলেজে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। তার ছোট ভাই আব্দুল্লাহ অনিক সুসং দুর্গাপুর ডিগ্রি কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে পড়াশোনা করেন। কবি নজরুল কলেজে পড়াশোনা সুবাদে ওমর ফারুক বসবাস করতেন পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজার এলাকায়।
১৯ জুলাই শুক্রবার শেষ কথা হয় সন্তান ওমর ফারুকের সঙ্গে শেষ কথা হয় কুলসুম আক্তারের। ওই দিন বায়তুল মোকাররম মসজিদে জুমার নামাজ শেষে মাকে ফোন দিয়ে ওমর জানিয়েছিল, আমি খাওয়া-দাওয়া করছি বন্ধুদের নিয়ে, এখন বাসায় আছি। আমাকে নিয়ে তুমি চিন্তা করো না, আমি ভালো আছি। এই ছিল ওমর ফারুকের সঙ্গে তার মায়ের শেষ কথা।
আন্দোলন চলাকালীন লক্ষ্মীবাজার এলাকায় বন্ধুদের সঙ্গে থাকাকালীন পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটলে সেখানে প্রথমে ওমরের পেটে গুলি লাগে। গুলি লাগার পর তার বন্ধুরা তাকে উদ্ধার করে স্থানীয় একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিলে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। অবস্থা গুরুতর হওয়ায় পরবর্তীতে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজের নেওয়ার পথেই ওমর মারা যায়। পরিস্থিতি উত্তপ্ত থাকায় ওমরের মরদেহ শনাক্ত করে বাড়িতে নিয়ে আসতে তিন দিন সময় লাগে।
কুলসুম আক্তার আক্ষেপ করে বলেন, আল্লাহর কাছে একটাই চাওয়া। আমার সন্তান চলে গেছে যাক, আর কোন মায়ের বুক যেন খালি না হয়। পরিস্থিতি তখন এতটাই উত্তপ্ত ছিল যে, আমার ছেলেকে আমি শেষ দেখা দেখতে পারিনি। দুর্গাপুর শহরে আমার ছেলেকে আনতে দেয়নি প্রশাসন। আমাদের গ্রামের বাড়িতে তাকে দাফন করা হয়েছে।
ওমরের মা আরও বলেন, আমার ছেলেটা ছোটবেলা থেকেই খুব দয়ালু ও মানবিক প্রকৃতির। সে দুর্গাপুরে একটি ব্লাড ডোনার সোসাইটি পরিচালনা করতো। যে ছেলেটা মানুষকে রক্ত দেওয়ার জন্য দিন-রাত দৌড়ঝাপ করতো, তার রক্তেই রাজপথ ভিজে গেছে।
মারা যাবার কিছুদিন আগে ওমর কোথা থেকে যেন একটি ময়না পাখির বাচ্চা নিয়ে আসে। তখন তার মা বলেছিল কোথা থেকে এসব আপদ নিয়ে এসেছিস! তখন ওমর বলেছিল, মা এই বাচ্চাটা ঝড়ের কারণে পরিবারহারা হয়ে গিয়েছে, তাই আমি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই ময়না পাখিটি কথা বলতে শিখেছে। ওমর যেহেতু ওকে আদর যত্ন করত তাই, ওমরের মতো পাখির বাচ্চাটি তখন আমাকে আম্মা আম্মা বলে ডাকতো। এখন ওমর আম্মা না ডাকলেও, তার পোষা ময়না পাখিটি ‘আম্মা’ বলে ডাকে।
ছেলেকে বিয়ে করিয়ে ঘরে বউ আনতে চেয়েছিলেন কুলসুম আক্তার। কিন্তু তার ছেলে সব সময় বলতো, মা আগে প্রতিষ্ঠিত হয়ে নেই, তারপর বিয়ের চিন্তা করব। তার ইচ্ছে ছিল বিসিএস ক্যাডার হয়ে ভালো একটি চাকরি করার, মানুষের পাশে দাঁড়াবার। কিন্তু সেই সুযোগ আর পেল না ওমর।
ওমরের মা আরও জানান, বিভিন্ন মাধ্যম থেকে সাহায্য-সহযোগিতা আসছে শহীদ ওমর ফারুকের নামে, যার একটি টাকাও তার পরিবার খরচ করছেন না। তারা অনুদান হিসেবে যা পাচ্ছেন, তাই বিলিয়ে দিচ্ছেন গরিব, হতদরিদ্র ও অসহায় মানুষদের মাঝে। পাশাপাশি ওমর ফারুকের স্বপ্নের সংগঠন ‘শহীদ ওমর ফারুক ব্লাড ডোনার সোসাইটি’র জন্য বেশ ভালো একটা পরিমান টাকা সহযোগিতা করা হবে। যেন এই প্রতিষ্ঠানটি অসহায় মানুষের পাশে থাকতে পারে।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুর্গাপুরের ছাত্র প্রতিনিধি রাতুল খান রুদ্র ঢাকা পোস্টকে বলেন, শহীদ ওমর ফারুক আমার ছোটবেলার বন্ধু। সে ছোটবেলা থেকেই খুব মানবিক ও দেশপ্রেমিক ছিল। যখন আন্দোলন চলছিল সবাইকে সে আন্দোলনে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানাতো। আমি যখন দুর্গাপুরে আন্দোলন করি তখন সে সবসময় আমার সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছে এবং বলেছে, তোমরা ঘরে বসে থেকো না, আমরা যদি বসে থাকি তাহলে কিভাবে দেশকে ফ্যাসিস্ট মুক্ত করব। যেদিন ওমর মারা গেল সেদিন তার সঙ্গে জুমার নামাজের পর আমার কথা হয়েছে। তখন সে বলেছিল, বন্ধু আমাদের এদিকে গোলাগুলি শুরু হয়েছে। আমার জন্য একটু দোয়া করিস। কিন্তু বিকেলের দিকেই আমরা তার মৃত্যুর খবর পাই। তার একটি রক্তদান ফাউন্ডেশন ছিল, সেটি এখনো চলমান আছে। আমাদের বন্ধু রাজু ও কয়েকজন বন্ধু মিলে সেটির দায়িত্ব নিয়ে চালিয়ে যাচ্ছে মানুষের মাঝে ওমরকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য।
চয়ন দেবনাথ মুন্না/আরকে