ডেঙ্গু চিকিৎসায় হাসপাতালের বারান্দাও শয্যা!

বরগুনায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। প্রতিদিন প্রায় শতাধিক রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তবে, হাসপাতালে ডেঙ্গু পরীক্ষার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় রোগীদের বাইরের ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গিয়ে পরীক্ষা করাতে হচ্ছে। এতে বাড়তি খরচ হওয়ায় চরম ভোগান্তিতে পড়ছেন তারা।
হাসপাতালে ভর্তি রোগী ও তাদের স্বজনদের অভিযোগ, নাপা ও স্যালাইন ছাড়া অন্য সব ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে।
অন্যদিকে, লোকবলসহ কিছু পরীক্ষার সংকট থাকায় হাসপাতালে সীমিত সংখ্যক পরীক্ষা হয় বলে জানিয়েছেন বরগুনা জেনারেল হাসপাতালের এক কর্মকর্তা। তবে আরেক কর্মকর্তা বলেন, ডেঙ্গুতে জরুরি বিবেচনায় আউটডোরের রোগীদের পরীক্ষা বন্ধ রাখা হলেও ইনডোরে ভর্তি সব রোগীর পরীক্ষা চলছে।
চলতি বছরের মাঝামাঝি সময়ে বরগুনায় ব্যাপক হারে বেড়েছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। সর্বশেষ গত ২৪ ঘণ্টায় শুধু বরগুনা হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৫৭ জন। জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে আরও ভর্তি রয়েছেন ১১ জন
ডেঙ্গু পরিস্থিতি : পরিসংখ্যান ও প্রবণতা
বরগুনা সিভিল সার্জন অফিসের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর (২০২৪) ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে মোট দুই হাজার ৪৩৪ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগী চিকিৎসা নিয়েছিলেন। ওই বছর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় চারজন মারা যান। তবে, চলতি বছরের মাঝামাঝি সময়ে বরগুনায় ব্যাপক হারে বেড়েছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। সর্বশেষ গত ২৪ ঘণ্টায় শুধু বরগুনা হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৫৭ জন। জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে আরও ভর্তি রয়েছেন ১১ জন।

বর্তমানে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন ১৮৫ জন। জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে আক্রান্ত রোগী ভর্তি আছেন ৪৯ জন।
চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে মোট দুই হাজার ৭৭৯ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে শুধু বরগুনা জেনারেল হাসপাতালেই চিকিৎসা নিয়েছেন দুই হাজার ৫২৩ জন রোগী। তাদের মধ্যে বরগুনা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয়েছে ছয়জনের। এছাড়া দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়ে জেলার আরও ১৯ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে আক্রান্তদের মধ্যে এখন পর্যন্ত দুই হাজার ৫৪৫ জন রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন।
বরগুনা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয়েছে ছয়জনের। এছাড়া দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়ে জেলার আরও ১৯ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে আক্রান্তদের মধ্যে এখন পর্যন্ত দুই হাজার ৫৪৫ জন রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন
সরেজমিনে চিত্র : শয্যা ও পরীক্ষা সংকট
সরেজমিনে বরগুনা জেনারেল হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, জ্বরে আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতিদিনই প্রায় শতাধিক রোগী আসছেন হাসপাতালে। তাদের মধ্যে চিকিৎসকের দেওয়া পরীক্ষায় কারও ডেঙ্গু শনাক্ত হলেই ভর্তি করা হচ্ছে হাসপাতালে। ফলে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য নির্ধারিত ৫৫টি শয্যার অনুকূলে ১৫০-২০০ জন রোগী ভর্তি থাকতে হচ্ছে হাসপাতালে। এতে শয্যা সংকটে পড়ে হাসপাতালের বারান্দার ফ্লোরসহ লিফটের সামনে পর্যন্ত বিছানা তৈরি করে চিকিৎসা নিচ্ছেন রোগীরা।

এদিকে, হাসপাতালে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করাতে না পেরে বাধ্য হয়ে রোগীদের বাইরের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যেতে হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। রোগী ও তাদের স্বজনরা বলছেন, হাসপাতাল থেকে তেমন কোনো ওষুধ দেওয়া হয় না। শুধু নাপা ও স্যালাইন দেওয়া হয়। প্রয়োজনীয় সব ওষুধ কিনতে হয় বাইরের ফার্মেসি থেকে।
জ্বরে আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতিদিনই প্রায় শতাধিক রোগী আসছেন হাসপাতালে। তাদের মধ্যে চিকিৎসকের দেওয়া পরীক্ষায় কারও ডেঙ্গু শনাক্ত হলেই ভর্তি করা হচ্ছে হাসপাতালে। ফলে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য নির্ধারিত ৫৫টি শয্যার অনুকূলে ১৫০-২০০ জন রোগী ভর্তি থাকতে হচ্ছে হাসপাতালে। এতে শয্যা সংকটে পড়ে হাসপাতালের বারান্দার ফ্লোরসহ লিফটের সামনে পর্যন্ত বিছানা তৈরি করে চিকিৎসা নিচ্ছেন রোগীরা
ভুক্তভোগীদের অভিজ্ঞতা
গৌরীচন্না ইউনিয়নের মনসাতলী এলাকার বাসিন্দা আব্বাস মল্লিক ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে তিনদিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি আছেন। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমাদের সব পরীক্ষাই বাইরে থেকে করতে হয়। গতকাল বৃষ্টির কারণে পরীক্ষা করাতে পারিনি। আজ ডাক্তার বলেছে, আপনি পরীক্ষা করাননি, এখানে থাকার দরকার নেই। বরিশাল চলে যান।’
খাদিজা নামে আরেক রোগী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমরা হাসপাতাল থেকে পরীক্ষা করাতে পারিনি। বাইরে থেকে এখন পর্যন্ত তিনটি পরীক্ষা করিয়েছি। বাইরে পরীক্ষা করালে আমাদের বাড়তি খরচ হয়। হাসপাতালে পরীক্ষা হলে আমাদের সুবিধা হয়, কম খরচে পরীক্ষা করাতে পারি।’

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে গত তিনদিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি থাকা মো. মাসুদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আজ তিনদিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি। এখান থেকে এখন পর্যন্ত শুধু স্যালাইন ও নাপা দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনীয় বাকি সব ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে। এছাড়া হাসপাতালে পরীক্ষা করাতে পারিনি, সব পরীক্ষাই বাইরে থেকে করাতে হয়েছে।’
নাগরিক সমাজ ও বিশেষজ্ঞের দাবি
হাসপাতালে সবধরনের পরীক্ষা চালু এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানিয়েছেন বরগুনা সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি মনির হোসেন কামাল। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ও সিভিল সার্জনের সঙ্গে কথা বলেছি। হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর প্রয়োজনীয় কয়েকটি পরীক্ষা হয় না। সংকটের কথা বলে রোগীদের বাইরে যেতে বাধ্য করা হয়। বর্তমানে সংকট না থাকায় রোগীদের পরীক্ষা হাসপাতালে করানোর দাবি জানাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘হাসপাতালে প্রতিদিন প্রায় ২০০ ডেঙ্গু রোগী ভর্তি থাকায় একসঙ্গে সবার পরীক্ষা করাও সম্ভব নয়। এ কারণে অনেকে বাধ্য হয়ে বাইরে থেকে পরীক্ষা করাচ্ছেন। তবে, বাইরের পরীক্ষায় ভুল রিপোর্ট দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। তার কিছু প্রমাণও আমরা পেয়েছি। বাইরে থেকে ভুল রিপোর্টের কারণে রোগীরা প্রতারিত হচ্ছেন এবং ভুল চিকিৎসারও শিকার হচ্ছেন।’
বরগুনা জেনারেল হাসপাতালের মেডিকেল টেকনোলজিস্ট কল্পনা রানী দত্ত ঢাকা পোস্টকে ডেঙ্গু পরীক্ষার সীমিত সক্ষমতার বিষয়ে বিস্তারিত জানান। তিনি বলেন, হাসপাতালে রোগীর চাপ বেশি থাকায় পরীক্ষার চাহিদা ব্যাপক হারে বেড়েছে। তবে, পর্যাপ্ত জনবল না থাকায় সব রোগীর পরীক্ষা সম্পন্ন করা যাচ্ছে না।
বর্তমানে তাদের ল্যাবে থাকা মেশিনটি থ্রি-পার্ট হওয়ায় প্রতিটি পরীক্ষা সম্পন্ন করতে তুলনামূলক বেশি সময় লাগে। তার মতে, যদি একটি ফাইভ-পার্ট মেশিন থাকত, তাহলে প্রতিদিন ১০০ থেকে ১৫০টি পরীক্ষা করা সম্ভব হতো।

তিনি আরও বলেন, বর্তমানে হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ৫০টি এনএস১ ও ৮০টি সিবিসি পরীক্ষা চলছে। তবে, চলমান সংকটের কারণে আইজিজি ও আইজিএম পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে।
বরগুনা ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. রেজওয়ানুর আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আগে আমাদের এখানে প্লাটিলেট ছাড়া সিবিসি পরীক্ষা চালু ছিল। ডেঙ্গু রোগীদের প্রয়োজনে এখন আবার প্লাটিলেট পরীক্ষা শুরু হয়েছে। দিনে গড়ে ৫০টি পরীক্ষা হচ্ছে, ধীরে ধীরে আরও বেশি করতে বলেছি। তবে, আমাদের মেশিন ছোট হওয়ায় একসঙ্গে বেশি চাপ নিতে পারে না। অতিরিক্ত পরীক্ষা করতে গেলে মেশিন গরম হয়ে নষ্ট হয়ে যেতে পারে।’
‘বর্তমানে ইনডোরে ভর্তি রোগীদের পরীক্ষা চালু রয়েছে। শুধু আউটডোরের রোগীদের পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে। আমরা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে আমাদের প্রয়োজনীয় চাহিদা দিয়েছে। এছাড়া ১৫ লাখ মানুষের জন্য জেলার একটি হাসপাতাল অথবা মেডিকেল কলেজ সব প্রয়োজন মেটাতে পারে না। এজন্য বেসরকারি সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে। তবে, বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর মান উন্নয়নে নজর দিতে হবে’— বলেন তিনি।
এমএ