এখনো ছেলের কবরের পাশে বসে কাঁদেন শহীদ এমদাদুলের মা

জীবিকার তাগিদে ঢাকায় ২০ হাজার টাকা বেতনে প্রাইভেট কার চালাতেন পিরোজপুরের ভান্ডারিয়ার মো. এমদাদুল হক (২৭)। এই বেতনে বাবা-মা ও পুরো পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়েছিলেন তিনি।
নিয়মিত ওষুধ কিনে পাঠাতেন মায়ের জন্য। সংসারের স্বপ্নগুলো তার হাত ধরেই এগোচ্ছিল। কিন্তু ২০২৪ সালের ২০ জুলাই বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ঢাকার উত্তর বাড্ডা এলাকায় পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়ে পরিবারের সব স্বপ্ন যেন থমকে গেছে।
মো. এমদাদুল হক পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া উপজেলার ধাওয়া ইউনিয়নের আব্দুস সোবহান হাওলাদারের ছেলে। মা তাকে আন্দোলনে যেতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু মায়ের কথা না শুনে পরদিন সকালে রাস্তায় নেমে আসেন। মৃত্যুর আগের রাতে মায়ের সাথে কথা হয়েছিল এমদাদুলের।
প্রতিদিন সকালে মা তাকে মোবাইলে ফোন করে ঘুম থেকে তুলতেন। সেদিন মা ইচ্ছে করেই কল দেননি, ভেবেছিলেন ছেলে ঘুমিয়ে থাকলে হয়তো আন্দোলনে যাবে না। কে জানত, ঘুম ভেঙে বেরিয়ে যাওয়া সেই ছেলেটি আর কোনোদিন ঘরে ফিরবে না, ঘুমিয়ে যাবে চিরকালের জন্য।
কপালের ঠিক মাঝ বরাবর গুলি লাগে এমদাদুলের। মূহূর্তেই লুটিয়ে পড়েন মাটিতে। বন্ধুদের মাধ্যমে খবর পেয়ে এমদাদুলের মামা ছুটে আসেন। পরে পরিবারের সদস্যরা ঢাকা থেকে লাশ এনে গ্রামে দাফন করেন তাকে।

মিশুক স্বভাবের এমদাদুলকে ভালোবাসতেন এলাকার সবাই। সবার সঙ্গে মিশতেন, ফুটবল খেলতেন। তার অকাল মৃত্যুতে গ্রামজুড়ে নেমে আসে শোকের ছায়া।
আরও পড়ুন
সরেজমিনে এমদাদুলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ছেলের মৃত্যুর প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও শোকে কাতর হয়ে আছেন তার বাবা। কর্মহীন হয়ে নিঃশব্দে দিন কাটে তার। বড় ভাই চট্টগ্রামে গার্মেন্টস কর্মীর চাকরি ছেড়ে ফিরে এসেছেন গ্রামের বাড়িতে। এখন মাঝে মধ্যে দিনমজুরির কাজ করেন।
এমদাদুলের মা যেন শোকের অতলে ডুবে গেছেন। ছেলের স্মৃতি মনে হলেই অঝোরে কাঁদেন। প্রতিদিন একবার ছেলের কবরের পাশে গিয়ে বসে থাকেন। সেখানেই যেন খুঁজে ফেরেন হারিয়ে যাওয়া বুকের মানিককে।
পরিবার সূত্রে জানা যায়, জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে পাঁচ লাখ টাকা, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি থেকে এক লাখ টাকা, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী থেকে দুই লাখ টাকা, পিরোজপুর জেলা পরিষদ থেকে দুই লাখ টাকা, ভান্ডারিয়া উপজেলা পরিষদ থেকে ১৫ হাজার টাকা-সহ বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে সহায়তা হিসেবে মোট ১১ লাখ টাকা দেওয়া হয় এমদাদুলের পরিবারকে। সেই অর্থ দিয়ে এমদাদুলের নামে দোয়া অনুষ্ঠান, বাবা-মায়ের চিকিৎসা খরচ করা হয়েছে। বাকি টাকা ব্যাংকে সঞ্চয় করে রাখা হয়েছে। সেখান থেকে মাসিক কিছু মুনাফা পেয়ে চলছে তাদের সংসার।
তবে এই সাময়িক সহায়তার বাইরে এমদাদুলের পরিবার তার বড় ভাইয়ের জন্য সরকারের কাছে একটি চাকরির দাবি করেছেন। এতে পরিবারটি ভালোভাবে সম্মানের সাথে বেঁচে থাকতে পারবে বলে তাদের প্রত্যাশা।
শহীদ এমদাদুলের মা হাসিনা বেগম ছেলের মৃত্যুর বর্ণনা দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আমার ছেলে তো আর ফিরবে না। যে ছেলেটা বেঁচে আছে, সরকার যদি তার একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিত, তাহলে আমাদের বাকি জীবনটা একটু শান্তিতে কাটাতে পারতাম।

শহিদ এমদাদুলের বাবা আব্দুস সোবাহান হাওলাদার বলেন, আমার যে ছেলে কাজ-বাজ করে আমাদের সংসার চালাতো সে তো মারা গেছে। তারপর থেকে আমিও কোন কাজ বাজ করতে পারি না। আগে ঢাকায় রিকশা চালাতাম। এখন আর কিছু করতে পারি না। আমার আর একটা ছেলে আছে তার জন্য সরকার যদি কোন ব্যবস্থা করে দিতো। তাহলে আমাদের অনেক উপকার হইতো।
শহিদ এমদাদুলের মামা বলেন, এমদাদুল মারা যাওয়ার পর থেকে পরিবারটি অসহায় হয়ে পরেছে। এই ছেলেটাই এই সংসারের ভরণপোষণ দিতো। এই ছেলের মৃত্যুর পরে সংসার চালানো খুব কষ্টকর হয়ে পড়েছিলো। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সরকার যে সহায়তা করেছে তা দিয়ে এখন তাদের সংসার চলছে। তার বড় ভাই দিনমজুরির কাজ করে। তাকে সরকার কোন কাজের সুযোগ করে দিলে সংসারটা একটু ভালো চলতে পারে।
স্থানীয় বাসিন্দা মো. মাসুম বিল্লাহ বলেন, শহীদ পরিবারটির প্রতি মানবিক দৃষ্টি দেওয়া এখন জরুরি। দেশের জন্য আত্মত্যাগকারী পরিবারের দায়িত্ব রাষ্ট্রের নেওয়া উচিত। এমদাদুল দেশের জন্য জীবন দিয়েছে এখন তার পরিবার কষ্টে আছে। সরকারের কাছে দাবি তাদের একটি স্থায়ী সমাধান করে দেওয়া হোক।
শাফিউল মিল্লাত/এনটি