গুলি লাগা গেঞ্জিটাই এখন ছেলের স্মৃতি

ছেলেটার জন্য দুধ, নারকেল, গুড়, আটা গুছিয়ে রেখেছিলাম। এগুলো নিয়ে আমার ঢাকা যাওয়ার কথা ছিল। আমি যদি সেদিন ঢাকায় চলে যেতাম তাহলে আমার সন্তান হয়তো আজ বেঁচে থাকতে। আমি কোনোভাবেই তাকে ঘর থেকে বের হতে দিতাম না।
কথাগুলো বলছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদ রাকিবুল হোসেনের (২৯) মা হাফিজা খাতুন। ছেলের মৃত্যুর পর বছর কেটে গেল। গতবছরের এই দিনে (১৯ জুলাই) ঢাকাতে গুলিবিদ্ধি হয়ে প্রাণ হারান ২৯ বছরের টগবগে তরুণ রাকিবুল। ছেলে হারিয়ে এই মা হারিয়েছেন তার জীবনের সব। গুলি লাগা ছেঁড়া গেঞ্জিতে এখনও ছেলের স্মৃতি খুঁজে ফেরেন এই মা।
রাকিবুলের পৈত্রিক বাড়ি ঝিনাইদহ জেলার হরিনাকুন্ডু উপজেলার চাঁদপুর ইউনিয়নের বাসুদেবপুর গ্রামে। তার বাবার নাম আবুবকর সিদ্দিক বিমান বাহিনীর সাবেক মাস্টার ওয়ারেন্ট অফিসার। রাকিবের মা ক্যান্সার আক্রান্ত। সাড়ে ৬ বছর তিনি ক্যান্সারের চিকিৎসা নিচ্ছেন। একমাত্র বড় ভাই ইকবাল হোসেন (৩৭) ব্যাংকার।
ঘুরেফিরে রাকিবুলের মা ছেলের কেনা ওয়াশিংমেশিনটার কাছে যান। হয়তো ছেলের হাতের স্পর্শ অনুভব করার চেষ্টা করেন তিনি। গুলি লাগা ছেড়া গেঞ্জি প্রতিদিন ছুঁয়ে দেখেন। ছেলের ব্যবহৃত হেলমেট হাতে নেন, ছুঁয়ে দেখেন। কখনও আনমনে বসে থাকেন, কখনও চোখ বেয়ে নেমে আসে ছেলে হারানোর শোক। আলমারি ভরা রাকিবুলের কাপড়ে ছেলের শরীরের গন্ধ নেওয়ার চেষ্টা করেন রাকিবুলের মা। রাকিবুলের জুতা, বই রেখে দিয়েছেন নিজের চোখের কাছাকাছি। রাকিবুলের বালিশটা এখন নিজেই ব্যবহার করছেন।
একটা মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারছি না। ঘুমাতে পারি না, খেতে পারি না। আমার ছেলের শখের শোওয়ার ঘরে সবকিছু পরিপাটি করে সাজানো রয়েছে। আমার ছেলেটাই কেবল নেই। পড়ার টেবিল, হেলমেট, বই-পত্র দেখলেই বুক ফেটে কান্না আসে। কান্না ছাড়া তো আর কোনো কিছুই নেই আমাদের। এসব কথাও কাঁদতে কাঁদতেই বলছিলেন রাকিবুলের বাবা আবুবকর সিদ্দিক।

বিমান বাহিনীর সাবেক মাস্টার ওয়ারেন্ট অফিসার আবু বকর সিদ্দিক আরও বলেন, আন্দোলনের সময় আমরা রাকিবকে ফোন করলে সে বলতো যে, সে বাসায় আছে। কিন্তু অফিস শেষ করে ছাত্রদের আন্দোলন দেখতে যেতো। ছাত্রদের পানি, বিস্কুট খাওয়াতো। রাকিবুল মারা যাওয়ার পর তার সহকর্মীরা এসব কথা আমাদের জানিয়েছে।
শহিদ রাকিবুলের মা হাফিজা খাতুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, রাকিবের বন্ধু পিয়াস প্রথম বাড়িতে খবর দেয়। পরে রাকিবের অফিসের কর্মকর্তারা পিয়াস, সালমান ও ফয়সালকে দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে মৃতদেহ ঢাকা থেকে ঝিনাইদহে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। সালমান ও পিয়াস রাকিবের সহকর্মী।
হরিণাকুন্ডু উপজেলার চাঁদপুর ইউনিয়নের বাসুদেবপুর গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে শহিদ রাকিবের দাফন করা হয়।
হাফিজা খাতুন বলেন, ২৮ জুলাই ঢাকায় যখন আন্দোলন শুরু হয়। তখন আমি খুব ভয়ে ছিলাম। শুধু ভাবতাম আমার রাকিব অফিসে যাবে কীভাবে? ১৯ জুলাই শুক্রবার রাকিবকে ফোন করে বললাম, আব্বু অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফেরা যাবে না? রাকিব বলেছিল, ফেরা যাবে না।
তিনি বলেন, ১৮ জুলাই রাত সাড়ে ৯টার সময় রাকিব আন্দোলনে গিয়েছে। ওইদিন তার বুকে রাবার বুলেট লাগে। রাতে বাসায় ফিরে আমার সঙ্গে কথাও বলেছে। কিন্তু আমাকে কিছুই বুঝতে দেয়নি। বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন রাকিবুলের মা।

তিনি জানান, শুক্রবার (১৯ জুলাই) রাত ৮টার দিকে একমাত্র ভাতিজির (বড় ভাইয়ের মেয়ে) সঙ্গে রাকিবের শেষ কথা হয়। রাকিবকে তার ভাতিজী ছোট আব্বু বলে ডাকত। ফোনে কথা বলার সময় রাকিবের ভাতিজী তাকে বলেছিল, ছোট আব্বু তুমি বাড়ি চলে আসো। গাড়ি না পেলে তোমার বাইক নিয়ে চলে আসো। না হয় তুমি অ্যাম্বুলেন্সে বাড়ি চলে আসো।
কে জানতো অবুঝ ছোট্ট ভাতিজীর সেই অস্পষ্ট ইঙ্গিত বাস্তবে পরিণতি পেয়ে যাবে! রাকিব তার বাড়ি ফিরেছে ঠিকই। প্রিয় বাইক কিংবা গাড়িতে নয়, বরং নিথর দেহে অ্যাম্বুলেন্সে।
রাকিবের গুলিবিদ্ধ হওয়ার প্রসঙ্গে তার মা হাফিজা খাতুন বলেন, ১৯ জুলাই মিরপুরে মেট্রোরেলের নিচে আন্দোলনকারীদের মাঝে আমার ছেলে পানি ও বিস্কুট বিতরণ করছিল। শিক্ষার্থীদের মাঝে সে যতক্ষণ ছিল, ততক্ষণ নিরাপদই ছিল। যখনই সে পানি বিতরণ শেষে শিক্ষার্থীদের থেকে কিছুটা আলাদা হয়ে যায়, তখনই তাকে টার্গেট করে গুলি করা হয়। মেট্রোরেলের ওপর থেকে তার গলায় গুলি করা হয়।
রাকিবের মা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার ছেলে কোনো রাজনীতি করতো না। সে শুধু আমাকে বলেছিল, মা ছোট ছোট ভাই-বোনেরা আন্দোলন করছে। আমরা যদি বড় ভাই হয়ে ওদের পাশে না দাঁড়াই, তাহলে ওরা সাহস পাবে কোথায়?
শহিদ রাকিবুলের বাবা বলেন, সরকার ও দলীয়ভাবে আমাদেরকে অনেকে সহযোগিতা করেছেন। সবাই নিয়মিত খোঁজ খবর রাখেন। জেলা প্রশাসক থেকে দুই বারে অর্থ অনুদান দিয়েছে। জুলাই ফাউন্ডেশন খুলনা থেকে ৫ লক্ষ টাকা অনুদান দিয়েছে। বিএনপির পক্ষ থেকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। জামায়াত ইসলামীও আর্থিক অনুদান দিয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররাও সহযোগিতা করেছে। সবাই আমাদের খোঁজখবর রাখে।
আরও পড়ুন
যে দেশের জন্য ছেলেটা জীবন দিয়েছে সেই দেশটা মানবিক, সহিষ্ণু ও বৈষম্যহীন হোক। তাদের মতো আরও যে বাবা-মায়ের বুক খালি হয়েছে তাদের আকাঙ্ক্ষাও যেন পূরণ হয়। রাষ্ট্র যেন নতুন স্বাধীনতার সুফল জনগণের মাঝে পৌঁছে দেয়— এটাই এখন চাওয়া এই বাবা-মায়ের।
আব্দুল্লাহ আল মামুন/এনএফ