জুলাই আন্দোলনে এক দিনেই শহীদ হন ভোলার ১৩ যুবক

২০২৪ সালের ১৯ জুলাই আজকের এই দিনে রাজধানী ঢাকার রাজপথে ঘাতকদের নির্মম বুলেটে কেড়ে নেয় ভোলার ১২টি তাজা প্রাণ। এছাড়া সংঘর্ষ চলাকালে পদদলিত হয়ে নিহত হন আরও একজন।
নিহতদের মধ্যে কেউ ছিলেন ছাত্র, মসজিদের মুয়াজ্জিন, দিনমজুর, রিকশাভ্যান চালক, হোটেল কর্মচারী। তাদের মৃত্যুবার্ষিকীতে স্বজনদের আহাজারির সঙ্গে যেন কাঁদছে ভোলার মাটি।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে ১৯ জুলাই নিহত ১৩ জনের মধ্যে রয়েছেন, ভোলা সদর উপজেলার ইলিশা ইউনিয়নের আবুল কাশেমের ছেলে ড্রাইভার বাবুল (৪০), বোরহানউদ্দিন উপজেলার বড় মানিকা ইউনিয়নের জলিল মাতুব্বরের ছেলে ও ভোলা সরকারি কলেজের ছাত্র নাহিদ (২১), দেউলা ইউনিয়নের লালু মিয়ার ছেলে রাজমিস্ত্রী ইয়াছিন (২৩) ও পদদলিত হয়ে নিহত হন একই ইউনিয়নের আবু ইমাদ্দির ছেলে রিকশাচালক জামাল উদ্দিন (৩৫)।
লালমোহন উপজেলার চাঁদপুর ইউনিয়নের মো.ইউসুফের ছেলে হোটেল কর্মচারী আরিফ (১৭),পাঙ্গাসিয়া গ্রামের হানিফ মিয়ার ছেলে লন্ড্রি দোকানি মোছলেহ উদ্দিন (৩৫), কালমা ইউনিয়নের বজলুর রহমানের ছেলে রিকশা চালক আক্তার হোসেন (৩৫), লেজছকিনা গ্রামের খলিল রদ্দির ছেলে মুফতি শিহাবউদ্দিন (৩২), বদরপুর ইউনিয়নের জলিল উদ্দিনের ছেলে মিষ্টি দোকানের কর্মচারী শাকিল (২০), একই উপজেলার আকবর হোসেনের ছেলে হোটেল কর্মচারী সাইদুল (১৪)।
চরফ্যাশন উপজেলার শশিভূষণ থানাধীন হাজারীগঞ্জ ইউনিয়নের সালাউদ্দিন ফরাজির ছেলে বেকারির সেলসম্যান মো. সোহাগ (১৮), রসুলপুর ইউনিয়নের আবু জাহের জাফরের ছেলে রাজমিস্ত্রী বাহাদুর হোসেন মনির (১৮) ও দুলারহাট থানার চরনুরুল গ্রামের মৃত জাফরের ছেলে ট্রাক ড্রাইভার মো. হোসেন (২৫)।
শহীদদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা সকলেই পরিবারের সদস্যদের মুখে দ ‘বেলা দুমোঠো ভাত তুলে দেওয়ার আশায় কাজের খোঁজে পাড়ি জমিয়েছিলেন রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামে। কে জানতো, তারা ঘরে ফিরবেন নিথরদেহে কফিনবন্দি হয়ে।
তাদেরই একজন বোরহানউদ্দিন উপজেলার বড় মানিকা ইউনিয়নের জলিল মাতুব্বর ও বিবি ফাতেমা দম্পতির একমাত্র ছেলে ছিলেন শহীদ নাহিদ (২১)। পড়াশোনা করতেন ভোলা সরকারি কলেজে। বৃদ্ধ বাবার হাড়ভাঙা খাটুনি সহ্য করতে না পেরে চেয়েছিলেন নিজেই সংসারের হাল কাঁধে তুলে নিতে,ভাবনা অনুযায়ী পাড়ি জমান স্বপ্নের শহর ঢাকায়। যোগদান করেন বিকাশের মাঠকর্মী হিসেবে, থাকতেন মিরপুরে। ১৯ জুলাই বিকেলে মিরপুর ১০ নম্বর গোল চত্বরে বুকে গুলি লেগে গুরুতর আহত হন নাহিদ,পরে তাকে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
ছেলের কথা জিজ্ঞেস করতেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন বাবা জলিল মাতুব্বর। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার দুই মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে নাহিদ সবার ছোট ও একমাত্র ছেলে ছিল। সে ভোলা সরকারি কলেজে অনার্সে পড়াশোনা করতো, আমি নদীর কাজ করতাম। ছেলেটা আমার কষ্ট সইতে না পেরে আন্দোলন শুরু হওয়ার দুই মাস আগে পড়াশোনার পাশাপাশি কাজের উদ্দেশ্য ঢাকায় যায়। ১৯ জুলাই বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে মিরপুর গোল চত্ত্বরে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় নাহিদ। পরে খবর পেয়ে মরদেহটি পরের দিন নিজ গ্রামে এনে দাফন করি।
জলিল মাতুব্বর বলে, নাহিদ আমার একমাত্র ছেলে ছিল,ওকে গুল্লি কইররা মাইররা ফালাইসে,বংশের বাতি নিভিয়ে দিয়েছে,যারা আমার ছেলেকে মারছে আমি তাদের বিচার চাই। আজ আমার প্রথম ছেলের মৃত্যু বার্ষিকী। জুলাই মাস এলেও ছেলে ফিরে এলো না, বলেই ফের কান্না শুরু করলেন তিনি।
শহীদ ইয়াছিনের বাবা লালু মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন,১৯ জুলাই বিকেল ৫টার দিকে আন্দোলন চলাকালে নারায়নগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় ইয়াছিন। ইয়াছিন মারা যাওয়ার পর লাশ ওই এলাকার একটি বালুর মাঠের পাশে ফেলে রাখা হয়। খবর পেয়ে আমার ছেলের লাশ উদ্ধার করতে গেলেও পুলিশ বাধা দেয়। একপর্যায়ে তার দুইদিন পরে লাশ ভোলায় নিজ গ্রামে এনে দাফন করি।
শহীদ শাকিলের মা শাকিনুর বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন,আমার চার ছেলের মধ্যে সবার ছোট ছিল শাকিল। ঢাকায় মাদরাসায় পড়াশোনায় করতো। অন্যান্য ছাত্রদের সাথে শাকিলও আন্দোলনে গিয়েছিল। সংঘর্ষ চলাকালে শাকিল গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। তিনি প্রশ্ন করে জানতে চাইলেন 'কেন আমার ছেলেকে গুল্লি কইররা মারা হইছে',আন্দোলনে গিয়ে অন্যায় করেছে'? আমি আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই।
শহীদ মো. হোসেনের মা রিনা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, হোসেন ট্রাক চালাতো। বেশ কয়েক বছর আগে ওর বাবা মারা যায়। পরে দুই ছেলে নিয়ে ঢাকা যাই। দুই ছেলের মধ্যে হোসেন ছিল বড়,ওর উপার্জনে আমার সংসার চলতো, আরেক ছেলে প্রতিবন্ধী। ১৯ জুলাই মধ্যরাতে হোসেনের খালাতো ভাইয়ের মাধ্যমে খবর পাই আমার ছেলে গুলিবিদ্ধ হইছে, 'হইন্না দৌড়াইতে দৌড়াইতে গিয়ে দেখি আমার ছেলে আর নাই, গুল্লি কইররা মাইরা ফালাইসে।
শুধু নাহিদ, ইয়াছিন, শাকিল ও হোসেন নয়, কমবেশি একই আর্তনাদ সব শহীদ পরিবারে। সংসারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে চরম বিপাকে রয়েছে শহীদ পরিবারগুলো। এসব নিহতের ঘটনায় বিচারের দাবিতে সাবেক ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রধান আসামি করে মামলা করেছেন নিহতের স্বজনরা। তাদের দাবি গণহত্যায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমুলক বিচার। এছাড়া রুহের মাগফেরাত কামনায় দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছেন স্বজনরা।
ভোলার শহীদ পরিবারের সদস্যরা দুর্বিষহ দিন পার করছেন বলে জানান জুলাই যোদ্ধা সংসদের ভোলার আহ্বায়ক মো. রাকিব। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, একদিনে এতো মৃত্যু অন্য কোনো জেলার মানুষ দেখেনি। ২৪’র গণঅভ্যুত্থানে সর্বোচ্চ ৪৮ জন শহীদ হয়েছে ভোলার। ১৯ জুলাই পুলিশ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের গুলিতে ১২ জন শহীদ হন এবং একজন পদদলিত হয়ে শহীদ হন। ইতোমধ্যে কোনো কোনো শহীদ পরিবারকে অর্ন্তবর্তী সরকার কিছুটা সহযোগিতা করলেও তা পর্যাপ্ত নয়। অতিদ্রুত সব শহীদ পরিবারকে সঞ্চয়পত্র প্রদান, জুলাই ঘোষণাপত্রসহ গণহত্যায় জড়িতদের বিচারের দাবি জানান তিনি।
খাইরুল ইসলাম/আরকে