সেদিন শ্রাবণের পড়ন্ত বিকেলে তাদের বুক ঝাঁঝরা করেছিল পুলিশের বুলেট

১৯ জুলাই, ২০২৪। শ্রাবণের এক পড়ন্ত বিকেল। মাথার ওপরে লাল সূর্যটা প্রায় অস্ত গিয়েছিল। রংপুর সিটি কর্পোরেশনের সামনে রাজপথে দাঁড়িয়ে ছাত্র-জনতার মিছিল। কণ্ঠে ছিল বৈষম্যের বিরুদ্ধে জোরালো স্লোগান, চোখে ছিল সমতার স্বপ্ন।
এদিন সাজ্জাদ হোসেন (২৯), মোসলেম উদ্দিন মিলন (৩৫), মেরাজুল ইসলাম (৩৭) আর আব্দুল্লাহ আল তাহির (২৮) ছিল নিরস্ত্র নিরীহ। মিছিলে থাকা অনেকেই লাল-সবুজে আঁকা বাংলাদেশের পতাকা হাতে এসেছিল। কেউ অস্ত্র হাতে নেয়নি। ছিল অসীম সাহস আর কিছু প্রশ্ন।
সেই বিকেলে হঠাৎ গর্জে উঠে রাষ্ট্রযন্ত্রের বন্দুক। একের পর এক বুলেট থামিয়ে দেয় একেকটি জীবনের গল্প। কয়েক ঘণ্টার প্রতিবাদের পর নেমে আসে স্তব্ধতা, বাতাসে ভাসে বারুদের গন্ধ। শহরটা থমকে দাঁড়ায়। প্রিয় মুখের নিথর দেহ থেকে রাজপথে ঝড়ছিল উষ্ণ রক্ত। আর প্রতিবাদীদের চোখের জল যেন হয়েছিল শ্রাবণের বৃষ্টি। সড়কে পড়ে থাকা জুতা-স্যান্ডেল সাক্ষী দিয়েছিল বৈষম্যের বিরুদ্ধে তাদের বজ্রকণ্ঠের উচ্চারণ।
রক্তের ললাট জমাট বেঁধে শ্রাবণের মেঘ সেদিন লালচে রঙে রঙিন হয়েছিল। অশ্রুসিক্ত নয়ন বেয়ে পানিও যেন রক্তের রঙ পেয়েছিল। দেখতে দেখতে আজ সেই রক্তাক্ত বিকেলের বছরপূর্তি। প্রিয়জন হারানো সেই সব শহীদ পরিবারের হৃদয়ে এখনো তীব্র বেদনায় কাতর। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিদের হারিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন এসব শহীদের পরিবার।
১৯ জুলাই ১৮তম বিবাহ বার্ষিকীর দিনে স্বামী হারা হন নাজমিন ইসলাম। রংপুর নগরীর জুম্মাপাড়ার বাবার বাড়িতে দুই ছেলে সন্তানকে নিয়ে বসবাস করছেন ফল বিক্রেতা শহীদ মেরাজুল ইসলামের স্ত্রী নাজমিন। স্বামীর স্মৃতি নিয়ে জানতে চাইলে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ১৯ জুলাই আমাদের ১৮তম বিবাহবার্ষিকী ছিল। উনি আমার জন্য থ্রি পিস নিয়ে এসে বলেছিলেন পরবা। আমি সেই থ্রি পিস পরতে পারি নাই। পুলিশের গুলিতে আমার স্বামী সেদিন মারা যান।
তিনি আরও বলেন, প্রতিদিন দুপুর বেলা আমার দুই ছেলে ও স্বামীসহ ভাত খেতাম। রাতে স্বামী না আসা পর্যন্ত আমরা কেউ ভাত খেতাম না। এসব কথা এখন সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে। আমি বাচ্চাদের নিয়ে ভাত খেতে পারি না। বারবার স্বামীর কথা মনে পড়ে। আমার স্বামী চলে গেছে, এই শূন্যতা কেউ পূরণ করতে পারবে না। আমার ছেলেরা দুইটা ঈদ তাদের বাবা ছাড়া করেছে। তারা বাবার আদর থেকে বঞ্চিত।
আর্থিক সহযোগিতার ব্যাপারে নাজমিন ইসলাম বলেন, ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে দুই লাখ, বিএনপি নেতা হাবীব-উন-নবী খান সোহেল ৪০ হাজার, সিটি কর্পোরেশন থেকে ৫০ হাজার, সরকার থেকে ৪ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কিনে দিয়েছে সরকার। কিন্তু সেই টাকাগুলোর ভাগ আমার শাশুড়িকে দিতে হয়। এতে করে আমার সংসার চালানো ও বাচ্চাদের লেখাপড়া করাতে সমস্যা হচ্ছে। সরকারের দেওয়া টাকা দিয়ে আমি আমার জীবন সাজাতে পারছি না।
স্বর্ণকার মোসলেম উদ্দিনের স্ত্রী দিলরুবা আক্তার বলেন, আমার স্বামীর শহীদ হওয়ার বছর পেরিয়ে গেছে। সব সময় তার কথা মনে পড়ে। তিনি আমাদের মাথার উপরে ছাদ হয়ে ছিলেন। এখন আমার সন্তানকে নিয়ে কীভাবে জীবন পার করবো সেই চিন্তায় রয়েছি। অনেকদিন ধরে শুনতেছি শহীদ পরিবারের জন্য সরকার ভাতা চালু করবে। কিন্তু সেটি এখন পর্যন্ত চালু করা হয়নি। সরকার যদি শহীদ পরিবারের দিকে খেয়াল না রাখে, তাহলে কীভাবে সেই পরিবারগুলো চলবে। সেই সাথে আমি স্বামী হত্যার বিচার চাই।
আরও পড়ুন
সবজি বিক্রেতা শহীদ সাজ্জাদের মা ময়না বেগম বলেন, আমার ছেলে পুরো সংসার খরচ চালাতো। ছেলে হারানোর শোক আমরা ভুলতে পারি না। সরকারসহ বিভিন্ন মানুষ আমাদের অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করেছে। কিন্তু ছেলে হারানোর শূন্যতা কেউ পূরণ করতে পারবে না।
রংপুর নগরীর জুম্মাপাড়ার শহীদ আব্দুল্লাহ আল তাহিরের বাবা আব্দুর রহমান ছেলে হারানোর কষ্টে দিন পার করছেন। তিনি ছেলের হত্যাকারীদের বিচার দাবি করেছেন।
এ ব্যাপারে রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আতাউর রহমান জানান, জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদদের মামলাগুলো গুরুত্ব সহকারে দেখে তদন্ত ও বিভিন্ন সাক্ষীর জবানবন্দিসহ নানা কার্যক্রম চলছে। প্রতিটি মামলায় অনেক আসামি হওয়ায় আমাদের তদন্ত কার্যক্রম করতে একটু বেগ পেতে হচ্ছে।
যা ঘটেছিল ১৯ জুলাই
২০২৪ সালের ১৯ জুলাই ছিল শুক্রবার। স্বাভাবিক দিনের মতো সকাল হলেও গত দিনের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের চিহ্ন জায়গায় জায়গায়। বিকেল ৩টায় নগরীর গ্র্যান্ড হোটেল মোড়স্থ বিএনপির দলীয় কার্যালয়ে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে জেলা ও মহানগর বিএনপি। এরপর কয়েক হাজার নেতাকর্মী মিছিলে যোগ দেন। তাদের মিছিলের সঙ্গে নগরীর বিভিন্ন এলাকার হাজার হাজার ছাত্র-জনতা অংশ নেন। বিকেলে মিছিলটি সিটি কর্পোরেশনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলে সেখানে পুলিশের সাথে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ বেঁধে যায়। পুলিশ ও বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সেদিন ছিল বেশ ক্ষুধার্ত। তাদের ছোড়া রাবার বুলেট, সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ারশেলে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় পুরো এলাকা। চলে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। পুলিশের অস্ত্রের সামনে ইটপাটকেল নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে ছাত্র-জনতা। এরই একপর্যায়ে পুলিশ সদস্যরা মারমুখী হয়ে দফায় দফায় গুলি ছোড়ে।
এতে ঘটনাস্থলে নগরীর পূর্বশালবন এলাকার সবজি বিক্রেতা সাজ্জাদ হোসেন, পূর্ব গণেশপুরের স্বর্ণ শ্রমিক মোসলেম উদ্দিন, ফল বিক্রেতা নিউ জুম্মাপাড়ার মেরাজুল ইসলাম ও পূর্ব শালবনের বাসিন্দা ঢাকার বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব গ্লাস অ্যান্ড সিরামিকসের অষ্টম সেমিস্টারের ছাত্র আব্দুল্লাহ আল তাহিরের মৃত্যু হয়। এ সময় শতাধিক আহতকে উদ্ধার করে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আহত অনেকে পুলিশি ঝামেলা এড়াতে হাসপাতালে না গিয়ে বাড়ি ফিরে যান। এ সংঘর্ষে নগরীর জুম্মপাড়ার আবেদ আলী চোখ হারান। সেই সাথে অসংখ্য ছাত্র-জনতার শরীরে গুলি লাগে।
এদিন রাজধানী ঢাকার গ্রীন রোডে বিকেল ৫টার দিকে পুলিশের গুলিতে নির্মমভাবে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন সাংবাদিক তাহির জামান প্রিয়। ফ্রিল্যান্সিং সাংবাদিক প্রিয় রংপুরের গুপ্তপাড়া এলাকার বাসিন্দা। আজ তার স্মরণে রংপুর শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে প্রিয়কে নিয়ে স্মৃতিচারণ, তথ্যচিত্র প্রদর্শনী, প্রদ্বীপ প্রজ্জলনসহ বেশ কিছু কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে।
এর আগের দিন ১৮ জুলাই বিকেলে নগরীর মডার্ণ মোড়ে ছাত্র-জনতার সাথে পুলিশের তুমুল সংঘর্ষ হয়। এতে অটোরিকশা চালক ঘাঘট পূর্ব পাড়ার মানিক মিয়া শহীদ হন। ওইদিন জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ অফিস, জাতীয় শ্রমিক লীগ অফিস, মেট্রোপলিটন পুলিশের ডিবি কার্যালয়, তাজহাট থানা, নবাবগঞ্জ পুলিশ ফাঁড়িতে ভাঙচুর ও আগুন দেয় বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরএআর