আত্মীয়তার বন্ধনে বাধা কাঁটাতার

মেহেরপুর জেলার সঙ্গে ভারতের সীমানা রয়েছে প্রায় ৯০ কিলোমিটার। সীমান্তের ওপারে নদীয়া জেলা। ওই পারে স্বজন, প্রিয়জন আছে অনেকেরই। কিন্তু দেখা হয়, কথা হয় না শুধু কাঁটাতারের বাধায়।
কয়েক যুগ আগেও মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার বিভিন্ন সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া ছিল না। তখন স্বাচ্ছন্দে দুই বাংলার মানুষ একে অপরের সঙ্গে দেখা, সাক্ষাৎ ও যোগাযোগ করতে পারতেন।
দুই দেশ হলেও তারকাঁটা না থাকায় প্রতিবেশী গ্রাম হিসেবে তখন অনেকের মধ্যে ঘনিষ্ট সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। দুই দেশের সীমান্ত জেলার অনেক পরিবারই বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু সীমান্তে কাঁটাতার নিমার্ণের পর এই আত্মীয়তার বন্ধনগুলো আটকা পড়েছে তারকাঁটার বেড়াজালে। অনেকের সঙ্গে চোখের দেখাও হয় না বছরের পর বছর।
সীমান্তের ওপারে ভারতের নদিয়া জেলায় আছে কারো বাবা কিংবা শ্বশুরবাড়ি। মাত্র কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে একান্ত আপনজনের বাড়ি হলেও সম্পর্কে কাটা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সীমান্তের কাঁটাতার।

কাঁটাতারের কারণে ধর্মীয়, পারিবারিক অনুষ্ঠান কিংবা কেউ মারা গেলেও ভালোবাসার মানুষগুলোকে এক পলক দেখতে পাড়ি দিতে হয় শত শত কিলোমিটার। আবার পাসপোর্ট ভিসা না পাওয়ায় অনেকে মৃত মা-বাবা, ভাই-বোনের মুখ পর্যন্ত দেখতে পান না।
একেবারে কাছাকাছি থেকেও স্বজনদের থেকে যোজন যোজনের দূরত্ব ঘোচাতে বছরে অন্তত ২ বার সরকারিভাবে সীমান্তে দেখা করার ব্যবস্থা করতে সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন তারা।
মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার সীমান্তবর্তী একটি গ্রাম রংমহল। এই গ্রামের ৫০টি পরিবারের আত্মীয় রয়েছে ওপার বাংলায়। এক সময় সীমান্তে পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে বিজিবি-বিএসএফ দেখা করার সুযোগ করে দিলেও সীমান্তে নজরদারি বৃদ্ধি পাওয়ায় দীর্ঘ দিন তা বন্ধ রয়েছে।
৩০ বছর আগে রংমহল গ্রামে বিয়ে হয়েছিল ভারতের দুঃখী শেখের মেয়ে রোজিফা খাতুনের। স্বামী আব্দুল নকিবকে নিয়ে সুখের সংসার হলেও মন পড়ে থাকে ওপার বাংলার মা-বাবা, ভাই-বোনের কাছে। দেখা হয় না বছরের পর বছর। তাই দিন কাটে মনে গেঁথে রাখা স্বজনদের স্মৃতি হাতড়িয়ে।
রোজিফার মতই কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের আগে ভারতের ইউনুস আলীর মেয়ে হারিসার বিয়ে হয়েছিল বাংলাদেশে। সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের পর পাসপোর্ট করে একবার স্বামী শরিফুল ইসলামকে নিয়ে ঘুরে এসেছেন বাবার দেশ থেকে। স্বামীর বাড়ি থেকে বাবার বাড়ির দূরত্ব মাত্র ২০ মিনিটের। কিন্তু দুই দেশের সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়াজালে আটকে আছে তাদের আত্মার বন্ধন।
বাংলাদেশে বসবাসরত তজিবুর বলেন, ভারতে আমাদের জমি আছে। ভারতের নাগরিকরা বিএসএফের কাছে একটি কার্ড জমা দিয়ে বাংলাদেশে চাষাবাদ করে। কিন্তু আমাদের তেমন কোনো সুযোগ নেই। এমন কার্ডের ব্যবস্থা থাকলে বা এমন সুযোগ থাকলে আমরাও আমাদের জমিতে চাষবাদ করতে পারতাম। তিনি জানান, তার ভাই বড় ভাই ভারতে থাকেন, কিন্তু তার সঙ্গে দেখা হয় না দীর্ঘ দিন।
কাথুলী ইউপি প্যানেল চেয়ারম্যান হুসাইন মোহাম্মদ বলেন, কেউ মারা গেলে আমরা বিজিবিকে অবগত করলে কোনো কোনো সময় লাশ দেখার সুযোগ পাওয়া যায়। এর বাইরে স্বজনদের সঙ্গে দেখা, সাক্ষাতের কোনো সুযোগ নেই।
৪৭ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুরশেদ আলী বলেন, ঈদ কিংবা বড় অনুষ্ঠান নয় শুধু কেউ মারা গেলে বিএসএফকে জানালে তারা কখনো কখনো পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে দেখা করার সুযোগ করে দেয়।
রোজিফা ও হারিসার মতো এপার বাংলার অনেকের বিয়ে হয়েছে ওপার বাংলায়। তারা চাইলেও আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করতে পারেন না। ঈদ, আনন্দ, উৎসব বা মৃত্যুর মতো শোকে স্বজনদের পাশে থেকে সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেওয়ার সুযোগ চান সাজেদা, আবুল কালাম, তজিবুর ও শরিফুল।
এনটি/আরকে