সুন্দরবনের রাজা বাড়ছে, মানুষের মৃত্যু কমছে কি?

তিন দশকেরও বেশি সময় আগে সুন্দরবনের গহীনে কাঠ সংগ্রহ করতে গিয়ে বাঘের ভয়ঙ্কর আক্রমণের শিকার হন বাগেরহাটের শরণখোলার মো. আব্দুস সামাদ হাওলাদার। দুপুরে খেতে বসার আগমুহূর্তে বাঘের আক্রমণের মুখে পড়েন তিনি। বাঘটি গলার নিচে কামড়ে ধরে তাকে। তিনিও শুরু করেন জীবন-মরণ যুদ্ধ। একপর্যায়ে অন্য কাঠ সংগ্রহকারীরা এগিয়ে এলে চলে যায় বাঘ, প্রাণে রক্ষা পান তিনি। তবে, দুই চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সারা জীবনের জন্য হারিয়ে ফেলেন আলো। এতটুকুই সান্ত্বনা, তিনি বেঁচে ফিরেছিলেন।
সুন্দরবনে বিভিন্ন সময় এভাবে বাঘের আক্রমণের শিকার হন বৈধ বা অবৈধভাবে প্রবেশকারীরা। ২০২৩ সালের ১ অক্টোবর সকালে মাছ ধরতে গিয়ে নিখোঁজ হওয়ার চারদিন পর শরণখোলা রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনের তুলাতলা বন থেকে শিপার হাওলাদার (২২) নামের এক জেলের বিচ্ছিন্ন দেহ, মাথা ও প্যান্ট উদ্ধার করে স্থানীয়রা।
বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৫ বছরে (২০০১-২০২৫) সুন্দরবনে বাঘের আক্রমণে ৪২৫ জন মারা গেছেন। এ সময়ে আহত হয়েছেন ৯৫ জন। তবে, এর বাইরেও আহত-নিহতদের একটি বড় সংখ্যা রয়েছে, যারা বন বিভাগের তালিকায় আসেননি
স্থানীয়দের ধারণা, বাঘ তাকে খেয়ে মাথা ফেলে রেখে চলে যায়। শিপারের মৃত্যু নিয়ে তখন হইচই হলেও বন বিভাগের অনুমতি ছাড়া মাছ ধরতে যাওয়ায় সরকারি কোনো সুযোগ-সুবিধা পাননি শিপারের পরিবার। শরণখোলা উপজেলার পশ্চিম রাজাপুর গ্রামের বাসিন্দা শিপারের মৃত্যুতে তার পরিবারে বৃদ্ধ বাবা-মা, স্ত্রী মোরশেদা বেগম ও পাঁচ বছরের মেয়ে সিনথিয়ার দিন কাটছে অভাব আর অনটনে।
শুধু শিপার বা শরণখোলা উপজেলা নয়; বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা জেলার অনেক মানুষই সুন্দরবনে গিয়ে বাঘের আক্রমণে নিহত হয়েছেন।
বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৫ বছরে (২০০১-২০২৫) সুন্দরবনে বাঘের আক্রমণে ৪২৫ জন মারা গেছেন। এ সময়ে আহত হয়েছেন ৯৫ জন। তবে, এর বাইরেও আহত-নিহতদের একটি বড় সংখ্যা রয়েছে, যারা বন বিভাগের তালিকায় আসেননি। ২০১১ সালে ক্ষতিপূরণ প্রদানের নীতিমালা হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত সুন্দরবন পূর্ব ও পশ্চিম বন বিভাগ ৬৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়েছে আহত ও নিহতদের পরিবারকে।
বন-সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, বাঘের আক্রমণে আহত ও নিহতদের পরিবারগুলো খুবই অসহায় হয়ে পড়ে। নানা নিয়ম-কানুনের বেড়াজালে তারা সরকারি সহযোগিতাও পায় না। আর সরকার যে সহযোগিতা করে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। আহত-নিহতের পরিবারগুলোর স্বাভাবিক জীবনের জন্য মাসিক ভাতা প্রদানের দাবি জানান তারা।
বন্যপ্রাণী আইনে মানুষের জানমালের ক্ষতিপূরণ নীতিমালা অনুযায়ী, বন্যপ্রাণীর আক্রমণে কেউ মারা গেলে এক লাখ, আহত হলে ৫০ হাজার এবং বাড়ি-ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হলে ২৫ হাজার টাকা পান। এ বিষয়ে সুন্দরবন খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক ইমরান আহমেদ বলেন, ‘২০১১ সালে নীতিমালা করে সুন্দরবনে যেকোনো প্রাণীর আক্রমণে আহত, নিহত বা ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সরকার সহযোগিতা শুরু করে। তবে, এর অন্যতম শর্ত বৈধ পাস-পার্মিট নিয়ে নিয়ম মেনে বনে প্রবেশ করতে হবে। এছাড়া যেসব নারীর স্বামীরা বাঘের আক্রমণে নিহত হয়েছেন, তাদের জন্য সামাজিক সুরক্ষার আওতায় বিশেষ সহায়তার চেষ্টা করা হচ্ছে।’
‘সুন্দরবনে তিনটি খাল রয়েছে, যেখানে শুধু বাঘ-বিধবারাই মাছ আহরণ করতে পারেন’— যোগ করেন এ কর্মকর্তা।
বন বিভাগের তথ্য বলছে, ২০১৮ সালের জরিপে সুন্দরবনে ১১৪টি বাঘের সংখ্যা পাওয়া যায়। ২০২৩ সালে সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট রেঞ্জের ৬৩৯টি গ্রিডে ক্যামেরা বসিয়ে ফের গণনা করা হয়। ২০২৪ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, বাঘের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছ ১২৫-এ
আরও পড়ুন
সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বাড়ছে
বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, পাঁচ বছরের ব্যবধানে করা দুটি জরিপের মধ্যে প্রায় ১০ শতাংশ বাঘ বেড়েছে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে। প্রকল্পের মাধ্যমে নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগ, নিরাপত্তা জোরদার, অপরাধীদের ছাড় না দেওয়াসহ বিভিন্ন কারণে বনে বাঘ বাড়ছে বলে দাবি বন বিভাগের। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি এর সুরক্ষা, প্রজনন সক্ষমতা বৃদ্ধি, বাঘের শিকার প্রাণীর সংখ্যা বাড়ানোসহ সার্বিক নিরাপত্তায় কাজ করতে হবে বন বিভাগকে।
বন বিভাগের তথ্য বলছে, ২০১৮ সালের জরিপে সুন্দরবনে ১১৪টি বাঘের সংখ্যা পাওয়া যায়। ২০২৩ সালে সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট রেঞ্জের ৬৩৯টি গ্রিডে ক্যামেরা বসিয়ে ফের গণনা করা হয়। ২০২৪ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, বাঘের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছ ১২৫-এ।
এ বিষয়ে বন সংরক্ষক ইমরান আহমেদ বলেন, বাঘ-মানুষের দ্বন্দ্ব নিরসনে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিম করা হয়েছে। এছাড়া খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরায় বনের ৭৪ কিলোমিটার এলাকা ফেন্সিং (বেড়া নির্মাণ) করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ৬০ কিলোমিটারের কাজ শেষ হয়েছে।
‘আগের চেয়ে বনের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে’— জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘অপরাধীদের ক্ষেত্রে আমরা জিরো টলারেন্স নীতিতে আছি। বন-অপরাধে জড়িতদের কোনো ছাড় নেই। সুপেয় পানি, আবাসস্থলসহ বাঘের সুরক্ষায় নেওয়াসহ বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে বাঘের সংখ্যা বাড়ছে।’
সুন্দরবন রক্ষায় আমরা-এর সমন্বয়কারী নূর আলম শেখ বলেন, ‘বন বিভাগ বাঘ বাড়ার কথা বললেও এই সংখ্যা কোনোভাবেই আশানুরূপ নয়। ২০১০ সালে সেন্ট পিটার্সবার্গে অনুষ্ঠিত বাঘ অভিবর্তনে বলা হয়, ১২ বছরের মধ্যে এর সংখ্যা দ্বিগুণ করতে হবে। সেই হিসাবে সুন্দরবনের বাঘ বাড়ার সংখ্যা নগণ্য।’
বাঘের আবাসস্থল নিরাপদ নয়— এমন দাবি করে তিনি আরও বলেন, ‘একদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত, অপরদিকে বিষ দিয়ে অনবরত মাছ নিধন হচ্ছে। এই পানি পান করে বাঘ যেমন অসুস্থ হচ্ছে, তেমনি বনের জীববৈচিত্র্য নষ্ট হচ্ছে। এছাড়া, আন্তর্জাতিক চোরাচালান সিন্ডিকেট সুন্দরবনে সক্রিয় আছে। তারা বাঘের দেহাংশসহ বিভিন্ন প্রাণী পাচারে জড়িত। তাদের হাত থেকে বন রক্ষা করতে না পারলে বন্যপ্রাণীসহ সুন্দরবনের সংকট দিন দিন বাড়বে।’
শেখ আবু তালেব/এমএআর