‘চারডে ভাত পাইলে আর ভিক্ষা করতাম না’

‘একদিন ভিক্ষা না করলে খাওন জোটে না। এখন আর আগের মতো হাঁটতে পারি না, খুব কষ্ট হয়। কেউ যদি চারডে ভাত তিন বেলা দিত, তাইলে আর গাঁও ঘুইরা ভিক্ষা করতাম না। শরীরে অনেক অসুখ, তাও কষ্ট কইরা চলাফেরা করি।’
এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার কাকিলাকুড়া ইউনিয়নের গেরামারা গ্রামের ৯৫ বছর বয়সী বৃদ্ধা তারা বেগম।
তিনি বলেন, ‘হাতে কী অসুখ হয়েছে তাও কবার পাই না, শুধু চুলকাই। ঘরে বিদ্যুৎ নেই, অন্ধকারে গরমের মধ্যে দিন পার করতে হয়।’
তারা বেগম বলেন, ‘আগে আমার বাড়ির সামনে সব জমি আমাগর ছিল। কত ধান আবাদ হইতো। এহন আমার স্বামীও নাই, জমিও নাই। কইডা ভাতের জন্য ভিক্ষা করতে হয়। চার ছেলেমেয়ের কেউ দেহে না। ঠিক মতো কতা কইতেও পারি না, কানেও শুনি না।’
তারই পাশের বাড়ির আরেক বৃদ্ধা জহুরা বেগমের (৯০) কণ্ঠেও একই হাহাকার। তিনি বলেন, ‘কেউ খোঁজ নেয় না, নাই-বা খুঁজলো। আল্লাহ যেই দিন নিবে, ওইদিন এই কষ্ট শেষ হইবো। তাও চাই, মরার আগে দুই বেলা পেট ভরে খাইতে পারি। এখন তো ভিক্ষা করতে গেলে খুব কষ্ট হয়, পা খুব ব্যথা করে। দুই ছেলে দুই মেয়ে কেও আমারে দেহে না। ঘরের মধ্যে কোনো রকমে দিন পার করি। এখন আর শরীর চলে না। কষ্ট করে ভিক্ষা করে দিন যায়। চোখে দেহি না, কানে শুনি না, মুখ দিয়ে ঠিক মতো কতাও বাইর হয় না।’
দুই বৃদ্ধার বাড়িতে গিয়ে জানা যায়, তারা বেগম ও জুহুরা বেগম কারও কাছে মা, কারও কাছে দাদি। কিন্তু জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী শুধু ক্ষুধা আর কষ্ট। পেটের দায়ে প্রতিদিন ভর দুপুরে বের হন তারা। কারও দরজায় দাঁড়িয়ে থাকেন নিঃশব্দে, কারও উঠানে বসে থাকেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কেউ এক মুঠো চাল দেন, কেউ কিছুই না বলে ফিরে যান। তবুও অভিমান নেই, কারণ তারা জানেন ক্ষুধার চেয়ে বড় কিছু নেই এই বয়সে।
এই দুই বৃদ্ধার জীবন যেন অবহেলা আর কষ্টের প্রতিচ্ছবি। সহায়-সম্পদ বলতে আছে শুধু টিনের এক টুকরা ঘর। জীবন চলে মানুষের দয়ার ওপর নির্ভর করে। হাঁটতে পারেন না ভালোভাবে, চোখে ঝাপসা দেখেন। কিন্তু তবুও লাঠি ভর করে এক ঘর থেকে আরেক ঘরে যান এক মুঠো চাল বা দুই টাকার আশায়।
জানা গেছে, তারা বেগম স্বামী ময়তুল্লাহকে হারিয়েছেন প্রায় ২২ বছর আগে। দুই ছেলে ও দুই মেয়ে থাকলেও কেউই দেখাশোনা করেন না। দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন অনেক আগে, দুই ছেলের মধ্যে এক ছেলে ঘটকের কাজ করেন। অপরজন ভ্যান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। তারা বেগমের ঘরে নেই বিদ্যুৎ। রাতে অন্ধকারেই থাকতে হয়। অসুস্থ শরীর নিয়েই প্রতিদিন ভিক্ষা করতে বের হন।
তারা বেগমের খাবারের বিষয়ে তার পুত্রবধূ বলেন, আমাদের নিজেদেরই খেতে কষ্ট হয়। আমরা কীভাবে তাকে খাবার দেব।
জহুরা বেগমের অবস্থা আরও শোচনীয়। স্বামী জরিপ উদ্দিন মারা গেছেন প্রায় ২০ বছর আগে। তারও দুই ছেলে দুই মেয়ে। দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। দুই ছেলের কেউ তাকে তেমন দেখাশোনা করেন না। তার দুই ছেলেই কৃষি কাজ করেন। জহুরা বেগম পায়ে ব্যথা, চোখে ঝাপসা, কানে কম শোনা— সব মিলিয়ে শরীর ভেঙে পড়লেও তিনি প্রতিদিন ভিক্ষা করতে বের হন। তার ভাষায়- মুখে কথাও বাইর হয় না, কিন্তু পেটের দায় বড় ভয়ংকর।
দুই বৃদ্ধা জানান, তারা সরকারিভাবে মাসে ৬০০ টাকা করে বয়স্ক ভাতা পান। এই টাকা দিয়ে চাল কিনবেন, না ওষুধ সেটাই ভাবেন। হাসপাতালে গেলে ওষুধ কেনার জন্য বাইরে পাঠানো হয়, কিন্তু সেই ওষুধ কেনার টাকা কোথা থেকে আসবে? শেষ জীবনে কষ্ট যেন কম হয়, শেষ জীবনে ভালো একটা ব্যবস্থা চান, যাতে করে আর ভিক্ষা না করতে হয়।
তারা বলেন, আমরাও চাই একবেলা ভালো তরকারি দিয়ে খাই, কিন্তু এখন তো মানুষ খাইতে দেয় না, আর শরীরও চলে না।
স্থানীয়রা বলেন, এই দুই বৃদ্ধা বছরের পর বছর একই কষ্টে দিন পার করছেন। বর্ষা হোক কিংবা রোদ, তাদের দেখা যায় রাস্তায় বসে থাকতে কিংবা কারও দরজায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে। কখনো কেউ চাল দেয়, কখনো খালি হাতে ফিরে আসেন। গ্রামের আরেক বাসিন্দা বলেন, এই দুই জন অনেক বছর ধইরা এমনি কষ্টে আছে। কেউ খোঁজ নেয় না। আমরা যা পারি ততটুকু দেই, কিন্তু সব সময় তো পারি না। সরকার যদি একটু সাহায্য করত, অন্তত দুই বেলা ভাত আর ওষুধ পাইলে এই মানুষগুলোকে আর ভিক্ষা করতে হইত না। খুবই কষ্ট লাগে এমন দশা দেখে।
কাকিলাকুড়া চৌরাস্তা এলাকায় শাহাদাত বলেন, একজন জহুরুলের মা অন্যজন বুচার মা। তারা শেষ বয়সে এসে যে কষ্ট করতাছে এইডা একমাত্র আল্লাহ ভালো জানেন। প্রতিদিন গ্রামে গ্রামে ভিক্ষা শেষ করে আমাদের এই বাজারে ঘুরে কিছু টাকা উঠে ওইডা দিয়ে দুইজন ভাগাভাগি করে বাজার করে কোনো রকম দিন পাড় করতাছে। এই শেষ জীবনে তাদের ছেলেমেয়েদের দায়িত্ব আছিল তাদের দেখাশোনা করার। কিন্তু তাদের নিজেদের ভিক্ষা করে দিন পার করতে হচ্ছে। আমরা এলাকাবাসী কিছু কিছু সহযোগিতা করি তাদেরকে।
একই গ্রামের রশিদ মিয়া বলেন, তারা দুইজন বয়স্ক মানুষ। এই বয়সে এসে ভিক্ষা করে দিন পার করছে। জীবনে শেষ বয়সটাও তাদের জন্য কষ্ট করে যতে হবে। আমরা চাই সরকারিভাবে তাদের জন্য কোনো ব্যবস্থা যাতে করা হয়।
শ্রীবরদী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ জাবের আহামেদ বলেন, এ বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। আমার হোয়াটসঅ্যাপে তাদের তথ্য দিন। আমরা খোঁজখবর নিয়ে আমাদের জায়গা থেকে তাদের জন্য সার্বিক সহযোগিতার ব্যবস্থা করবো।
নাইমুর রহমান তালুকদার/আরএআর