‘মা ফোনে কাঁদতেন, কিন্তু আমি জানতাম লড়াইয়ে পিছু হটার সুযোগ নেই’

‘পরিবারের একমাত্র ছেলে আমি। আন্দোলনের দিনগুলোতে মা-বাবা প্রতিদিন ফোন করতেন। মায়াভরা কণ্ঠে বোঝাতেন, যেন আন্দোলন ছেড়ে মায়ের কোলে ফিরে যাই। কখনো মা কাঁদতেন ফোনে, কখনো ছোট বোন। তাদের কান্না আমার মন ছিন্নভিন্ন করে দিত। কিন্তু আমি জানতাম, এই লড়াইয়ে পিছু হটার সুযোগ নেই।’
“৪ আগস্ট রাতে বাবা ফোন করে হু-হু করে কাঁদতে থাকে। ফোনে তখন অন্যদের কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। আমি নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম ‘আমার মৃত্যু যদি হয়—এখানেই হবে। আমি কোথাও যাচ্ছি না।’ অপরপ্রান্ত থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাগে ক্ষোভে বাবাও বলল ‘তুমি মারা গেলে লাশটাও যেন না আসে। আমরা লাশ নিতে যাব না।’ এরপর তিনি ফোন কেটে দেন।”
জুলাই আন্দোলনের বিভিন্ন সময় পরিবারের সঙ্গে মোবাইল ফোনে হওয়া কথোপকথনের স্মৃতিচারণ করছিলেন লিজেন আহম্মেদ প্রান্ত। ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার সময় প্রান্তর দুচোখ জলে টলমল করছিল। চোখের পাপড়িতে লেগে থাকা ক’ফোটা জল বেয়ে পড়তেই খানিকটা চুপ থাকেন তিনি। তারপর বলেন, ‘মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখেছি’।
লিজেন আহম্মেদ প্রান্ত রংপুরের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ডেল্টা কম্পিউটার সাইন্স কলেজের বিবিএ ৪র্থ সেমিস্টারের শিক্ষার্থী। নওগাঁ জেলা শহরের নিকটে শেখপুরা গ্রামে তার বাড়ি। পড়ালেখার কারণে থাকেন রংপুর নগরীর খামার মোড় এলাকার একটি ছাত্রাবাসে। জুলাই আন্দোলনের পুরোটা সময় ছিলেন রাজপথে। সহযোদ্ধাদের সাথে কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে দিতেন স্লোগান। কখনো বা প্ল্যাকার্ড হাতে হাত উঁচিয়ে ধরতেন প্রতিবাদের ভাষা।
প্রান্তর মতো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্কুল ও কলেজের হাজার হাজার শিক্ষার্থী রক্তাত্ত জুলাইয়ে মাঠে ছিল। তাদের সাহস আর মৃত্যুঞ্জয়ী দ্রোহের তোড়ে মোড় ঘুরে যায় আন্দোলনের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু হওয়া কোটা সংস্কার আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। আবু সাঈদের মৃত্যুতে জ্বলে ওঠা আন্দোলনের দাবানল শেষ পর্যন্ত গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। চব্বিশের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার তোপের মুখে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান ‘মাদার অব ফ্যাসিজম’ খ্যাত স্বৈরাচারশাসক শেখ হাসিনা।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে ঢাকা পোস্টের কথা হয় রংপুরের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে। যারা এই আন্দোলনে প্রয়োজনে মৃত্যুকে আলিঙ্গনের শপথে রাজপথে ছিলেন দিন-রাত। পুলিশি হয়রানি, গ্রেপ্তার আতঙ্ক, সরকারদলীয় ক্যাডার বাহিনীর নির্যাতন-নিপীড়ন, গুম-খুনের ভীতিসহ রাষ্ট্রযন্ত্রের রক্তচক্ষুকে উড়িয়ে দিয়ে তারা আওয়াজ তুলেছিলেন বৈষম্যহীন শোষণমুক্ত নতুন বাংলাদেশের জন্য।
ঢাকা পোস্টকে লিজেন আহম্মেদ প্রান্ত বলেন, ‘আবু সাঈদ ভাইয়ের আত্মত্যাগ আমাদেরকে সাহস আর অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। ১৬ জুলাই আবু সাঈদ ভাইকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করলে চারপাশ গর্জে ওঠে। আমাদের মতো শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদে প্রকম্পিত হয় পুরো শহর। ওইদিন কারমাইকেল কলেজের ভেতরে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী ঢুকেছিল। তারা আমাদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে, আমরা সবাই একসাথে ধাওয়া করি। তারা ক্যান্টিনের দিকে গেলে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা ক্যান্টিনে ভাঙচুর চালায়। আবু সাঈদ ভাইয়ের মৃত্যু শুধু শোক নয়, প্রতিবাদের আগুন ছড়িয়ে দেয় পুরো রংপুর জুড়ে।’
‘১৭ জুলাই বেরোবি ক্যাম্পাসে আবু সাঈদ ভাইয়ের গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। বহু চেষ্টা করেও চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি — সেদিন অঝোরে কেঁদেছিলাম। সেই মুহূর্তেই নিজেকে শক্ত করে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, শেষ পর্যন্ত ভাই-বোনদের সঙ্গে রাজপথে থাকব। যদি মৃত্যু আসে, যেন তা হাসিমুখে মেনে নিতে পারি’—যোগ করেন লিজেন আহম্মেদ।
প্রান্তর চোখে মৃত্যু এবং ১৮, ১৯ ও ৩৫ জুলাই
ঢাকা পোস্টকে এই তরুণ বলেন, ‘চব্বিশের ১৮ জুলাই ছিল বৃহস্পতিবার। ঘুম ভাঙতেই দেখি ফোনে ৩৭টি মিসড কল। পূর্বঘোষিত কর্মসূচিতে অংশ নিতে সহযোদ্ধারা বহুবার চেষ্টা করেও আমার সাড়া না পেয়ে আমাকে রেখেই রওনা দিয়েছে। উঠে তাড়াহুড়ো করে ব্যাগে একটা গামছা, টুথপেস্ট আর লাইটার ভরে নিই—এইটুকুই প্রস্তুতি। নাশতা না করেই বেরিয়ে পড়ি। পার্কের মোড়ে পৌঁছে দেখি, আস্তে আস্তে হাজার হাজার শিক্ষার্থী জমা হচ্ছে। তখনো পুলিশ ছিল না আশপাশে। সবাই মিলে একসাথে মডার্ন মোড়ের দিকে এগোতে থাকি। সেখানেও তখন কোনো পুলিশের উপস্থিতি নেই। বিক্ষুব্ধ ছাত্রজনতা ট্রাফিক বক্সে ভাঙচুর শুরু করে। এরপর আমরা রওনা হই তাজহাট থানার দিকে।’
‘মডার্ন মোড় তখন পুরোপুরি ছাত্র-জনতার নিয়ন্ত্রণে। ব্লকেডের কারণে সড়কে কোনো যানবাহন চলছিল না। আমরা মডার্ন মোড় ব্রিজ পার হয়ে পৌঁছে যাই তাজহাট থানার সামনে। সেখানে শিক্ষার্থীরা বাইরে থেকে থানার দিকে বৃষ্টির মতো ঢিল ছুড়তে শুরু করে। পুলিশ তখনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি, সম্ভবত সংখ্যায় কম থাকায় সাহস করেনি। আন্দোলনের তীব্রতা তখন আরও বেড়ে যায়।’
প্রান্ত বলেন, ‘সকাল থেকে কিছু না খেয়ে থাকায় প্রচণ্ড দুর্বলতা অনুভব করছিলাম। তাই মডার্ন ব্রিজের পাশে একটি দোকানে যাই—সেখানে একটাই দোকান খোলা ছিল। এক প্যাকেট বিস্কুট কিনে দুইটা খেয়েছি মাত্র, এমন সময় হঠাৎ বিকট শব্দ—সাউন্ড গ্রেনেড! রাস্তায় উঠে দৌড়াতে শুরু করি মডার্ন মোড়ের দিকে। ঠিক তখনই মডার্ন ব্রিজের ওপর একটি টিয়ারশেল আমার পায়ের নিচে এসে পড়ে। মুহূর্তেই নিঃশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে ঢুকে পড়ে গ্যাস, দম বন্ধ হয়ে আসে। দৌড়ানোর শক্তি আর থাকে না। কথা বলাও সম্ভব হচ্ছিল না। পেছন থেকে পুলিশ টানা রাবার বুলেট, টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে যাচ্ছিল। আমি ব্যাগ থেকে গামছা আর লাইটার বের করে, আগুন জ্বালিয়ে চোখ-মুখে তাপ দিই—টিয়ার গ্যাসের জ্বালা একটু কমে আসে। তারপর গামছা দিয়ে নাক-মুখ বেঁধে আবারও ঢিল ছুড়তে শুরু করি। মুহূর্তেই মডার্ন মোড় রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।’
‘অনেক সহযোদ্ধা সেদিন আহত হয়—অনেকেই গুরুতর। তবুও থেমে ছিল না লড়াই। একপর্যায়ে পুলিশ পিছু হটতে বাধ্য হয়। তাদের পিছু হটার পর আমিও সেখান থেকে সরে আসি। সেখান থেকে খামার মোড়ে আসার পর শুনি—বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা তাজহাট থানা জ্বালিয়ে দিয়েছে। এদিন পুলিশের গুলিতে মানিক মিয়া নামে এক অটোচালকের মৃত্যু হয়। পরের দিন শুক্রবার ১৯ জুলাই ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচিতে ফের উত্তপ্ত হয়ে ওঠে রংপুর। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সিটি বাজার এলাকাসহ বিভিন্নস্থানে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। গুলিবিদ্ধ হয়ে তাহির, মিলন, সাজ্জাদ ও মিরাজুল মারা যান। বহু মানুষ আহত হন।’
রংপুর নতুন করে স্বাধীন হয় ৪ আগস্ট
লিজান আহম্মেদ প্রান্ত বলেন, এর পরের দিনগুলো কেটে যায় ইন্টারনেট বিচ্ছিন্ন এক অন্ধকার সময়ের মধ্যে। কারফিউ জারি হয়, বন্ধ করে দেওয়া হয় রংপুর শহরের মেস, হোস্টেল ও বিশ্ববিদ্যালয়। সরকার কৌশলে আন্দোলনের গতিরোধ করার চেষ্টা করে। কিন্তু ছাত্র-জনতার জেগে ওঠা রুখতে পারেনি তারা। তখনো আন্দোলনের আগুন নিভে যায়নি—শুধু ছাইচাপা ছিল। ৩১ জুলাই থেকে আবারও আন্দোলন শুরু হয়। ৩ আগস্ট রাজপথে স্মরণকালের সর্ববৃহৎ বিক্ষোভ হয়। স্থানীয় ছাত্র-জনতা, তরুণ-তরুণীসহ নানা বয়সী মানুষ রাজপথে নেমে আসে আগের চেয়েও বেশি সাহস ও শক্তি নিয়ে।
পরের দিন ৪ আগস্ট আন্দোলন নতুন গতি পায়। পুলিশ সেদিন গুলি না চালালেও আওয়ামী লীগ এবং তাদের অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা দেশীয় অস্ত্র ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে আমাদের ওপর হামলা চালায়। তারা আমাদের দমন করতে চেয়েছিল সন্ত্রাস দিয়ে। কিন্তু সেদিন রংপুরের রাজপথে মাথা নোয়ায়নি ছাত্র-জনতা। বরং সম্মিলিতভাবে প্রতিহত করা হয় আওয়ামী সন্ত্রাসীদের। রক্ত, ঘাম, স্লোগান, প্রতিরোধ—সবকিছু মিশে গিয়েছিল এক মোহনায়। মূলত সেদিনই রংপুর স্বাধীন হয়। এর পরদিন হাসিনার পলায়নের মধ্যদিয়ে আসে আমাদের নতুন বাংলাদেশ।’
‘হাসিনা না পালানো পর্যন্ত বাড়ি ফিরব না’
কারমাইকেল কলেজের ইতিহাস বিভাগের (স্নাতকোত্তর) শিক্ষার্থী ইমরান আহমেদ। ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের মতো চব্বিশের জুলাই আন্দোলনেও ছিলেন সম্মুখ সারিতে। মৃত্যুকে হাতের মুঠোয় নিয়ে লড়ে গেছেন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। মায়ের সঙ্গে মশকরা করে বলেছিলেন, ‘হাসিনা না পালানো পর্যন্ত আর বাড়ি ফিরব না।’
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেষ পর্যন্ত যে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাবে, তা কখনো কল্পনাতেও আসেনি ইমরানের। কিন্তু মাকে ঠাট্টা করে বলা কথাটি তার জীবনে সত্যি হয়েছে। হাসিনার পলায়ন না হওয়া পর্যন্ত নিজের বাড়িতে ফেরা হয়নি ইমরানের। আন্দোলনে সবার কাছে পরিচিত মুখ হয়ে ওঠা ইমরানের বাড়িতে প্রতিদিন পুলিশ হানা দিতো সকাল দুপুর রাতে।
আন্দোলনের স্মৃতিময় দিনগুলো স্মরণ করে ইমরান আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘শুরুতে আমরা বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন করেছি। আমাদের মধ্যে আবু সাঈদের আন্দোলনের পরিকল্পনা ছিল সবার থেকে আলাদা। ওর কমিউনিকেশন স্কিল ছিল খুবই স্ট্রং। ১৬ জুলাই তাকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করে। আমি সেদিন সাঈদের পাশে ছিলাম।’
হাঁটতে হাঁটতে নেওয়া হতো আন্দোলনের পরিকল্পনা
ইমরান আহমেদ বলেন, আন্দোলনের সময়গুলোতে দিনের বেলা একটা প্রোগ্রাম শেষ করে রাতে কোথাও বসে যে পরের দিনের প্রোগ্রামের পরিকল্পনা করব সেই সাহসটা সবার ছিল না। আলী, পৃথিবী, আবু সাঈদ, খোকন, রাজ, সুমন, আরমানসহ আমরা আন্দোলনের পরিকল্পনা করতাম হেঁটে হেঁটে। কখনো মডার্ন থেকে খামার মোড়। কখনো বা অলিগলি হেঁটে হেঁটে কথা বলতে বলতেই সিদ্ধান্ত নিতে হতো।

মতিয়ার মতো হাসিনাও ‘রাজাকার’ বলে গালি দেন
২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের চাপে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরক্ত হয়েছিলেন। তখন কোটা পদ্ধতির সংস্কার না করে সুকৌশলে কোটা বাতিল করে দেন। ২০১৮-তে আন্দোলন চলাকালীন আওয়ামী লীগ নেত্রী মতিয়া চৌধুরী শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলে গালি দিয়েছিল। ছয় বছর পর চব্বিশের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে এসে শেখ হাসিনাও একই কায়দায় ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ বলে শিক্ষার্থীদের গালি দেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রংপুর জেলার সাবেক আহ্বায়ক ইমরান আহমেদের দাবি, ২০১৮ সালে শেখ হাসিনার পরামর্শে মতিয়া চৌধুরী রাজাকার বলে গালি দেন। এই গালিতেই পতনের বীজ হাসিনা নিজেই বপন করে রেখেছিল। ২০২৪ এ এসে যখন শুভঙ্করের ফাঁক রেখে বাতিল করা ‘কোটা পদ্ধতি’ পুনর্বহাল করা হলো, রাগে ক্ষোভে আমরা আবার আন্দোলনে ঝাঁপ দিই। খুনি শেখ হাসিনা এবারও রাজাকার তকমা লাগিয়ে আমাদের ক্ষেপিয়ে তোলে। যার কারণে রাতের আঁধারে সারা দেশে বিক্ষুদ্ধ শিক্ষার্থীদের উত্তাল বিক্ষোভে কেঁপে ওঠে হাসিনার মসনদ।
১৬ থেকে ১৯ জুলাই পর্যন্ত জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাঠে থাকা ইমরান নিজেকে বাঁচানোর যুদ্ধ শুরু করেন ২০ জুলাই থেকে। কারণ, ততক্ষণে শুরু হয় পুলিশের ধরপাকড়। গণগ্রেপ্তার এড়াতে নিরাপদস্থানে গা ঢাকা দেন তিনি এবং অন্য আন্দোলনকারীরা। তবে এক জায়গায় দুদিনের বেশি থাকার সুযোগ ছিল না তার। সারাদিন লুকিয়ে থেকে সন্ধ্যায় অপরিচিত লোকেশনে সহযোদ্ধাদের সাথে মিলিত হওয়া; ভয়ে ভয়ে আড্ডা দিয়ে সেখানেই ফোন বন্ধ করে আবার নতুন কোথাও গিয়ে রাত্রিযাপন করাটা ছিল আরেকটা যুদ্ধ। ৩১ জুলাই পর্যন্ত এভাবে লুকিয়ে থাকতে হয় তাদের। এরমধ্যে একবার ভাগ্যক্রমে অল্পের জন্য পুলিশের হাত থেকে বেঁচে যান ইমরান।
তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘কিছু মানুষের কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকব। তাদের ঋণ কোনোদিন শোধ হবে না। নিজেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমাকে আগলে রেখেছিলেন তারা। আমরা ১ আগস্ট থেকে ফের সরব হয়ে উঠি। সবার সাথে নতুন করে যোগাযোগ শুরু হয়। বৃষ্টিতে ভিজে ৩ আগস্ট শহরে বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। পরদিন ৪ আগস্ট আরেকটি সম্মুখ লড়াইয়ে আমরা বিজয় নিশ্চিতের সুঘ্রাণ ছড়িয়ে দিই। যদিও এই বিজয়ের সূর্য উঁকি দিয়েছিল পুলিশের গুলির সামনে বুক চিতিয়ে সাহস নিয়ে দাঁড়ানো আবু সাঈদের আত্মত্যাগের দিনটিতেই।’
সাবেক এই সমন্বয়কের চোখে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর বিপ্লবী সরকার গঠন করতে না পারা এই আন্দোলনের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। ইমরান আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এক বছরে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ওরা (সরকার) বিপ্লবী শক্তিগুলোর মধ্যে ফাটল ধরাতে অনেকটাই সফল। এভাবে চলতে থাকলে আগামী জুলাই হবে ব্যর্থতার। তারপরও আশার বাণী হচ্ছে সরকার জুলাই ঘোষণাপত্র উপস্থাপন করবে, এটা চূড়ান্তও হয়েছে।’
তরুণ এই শিক্ষার্থী বলেন, ‘আগামী জুলাইয়ে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা একটা বড় প্রত্যাশা। সংবাদপত্রে প্রায়ই দেখা যায় সংঘাত, আন্দোলন কিংবা মতবিরোধের খবর। তাই আশা থাকবে— রাজনীতি হবে শান্তিপূর্ণ, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ-ভিত্তিক, আর সাধারণ মানুষের জীবন ও জীবিকার উন্নয়নে কার্যকর।’
তিনি আরও বলেন, ‘অর্থনৈতিক দিক থেকেও মানুষ স্বস্তি চায়। মূল্যস্ফীতি, বেকারত্ব আর দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কার্যকর উদ্যোগই হবে খবরের শিরোনাম— এমনটিই প্রত্যাশা। পাশাপাশি রেমিট্যান্স প্রবাহ ও রপ্তানি আয় যেন ইতিবাচক ধারা বজায় থাকে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য নিয়ে যেন উঠে আসে ইতিবাচক গল্প, নতুন নিয়োগ, মানোন্নয়ন, চিকিৎসা সেবার অগ্রগতি। সেই সাথে তরুণ প্রজন্ম যেন আশার আলো দেখতে পায়, সেই প্রত্যাশা আমরা রাখি। আগামী জুলাই যেন আস্থা, আশা আর অগ্রগতির গল্পে ভরে ওঠে— এটাই স্বপ্ন। আমাদের গণমাধ্যমগুলো যেন হয়ে ওঠে জনগণের মুখপাত্র, দেশ ও সমাজ গঠনে সহায়ক।
আবু সাঈদের আত্মদান স্বাধীনতার আকাঙ্খাকে তীব্র করে
রংপুরের আরেক জুলাইযোদ্ধা মোতায়াক্কিল বিল্লাহ শাহ ফকির। যার স্লোগানে মুখরিত ছিল আন্দোলনের একেকটা দিন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রংপুর মহানগর কমিটির সাবেক এই যুগ্ম আহ্বায়ক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘মৃত্যুকে যে ডেকে নেয়া যায় তা আবু সাঈদ শিখিয়েছিল। আসলে আবু সাঈদের সাহস চব্বিশকে নিয়ে গেছে একটা নতুন বাংলাদেশের পথে। আওয়ামী লীগের হাতে অনেকের কঠিন মৃত্যু হয়েছে। তারা মানুষকে গুম খুন ছাড়াও নির্যাতন-নিপীড়ন করেছিল। ১৬ বছর পরে যখন আবু সাঈদ মৃত্যু আলিঙ্গন করেন তখন তা নাড়া দেয় সারা দেশকে।’
তিনি বলেন, ‘৩৬ জুলাইয়ের সময়টায় যেন আমরা মুক্তিযুদ্ধ পার করেছি। ঘর থেকে পালিয়ে থেকেছি, শ্যামাসুন্দরীর কাঁদা মাড়িয়ে গেরিলা লড়াইয়ের মতো লড়েছি। আমাদের ছাত্র ভাই-বোনদের নিরাপত্তার জন্য অনেক কঠিন ও কৌশলগত সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এসবের সাথে আমরা নতুন ছিলাম; স্বাধীনতার তীব্র আকাঙ্খা আমাদের এসব শিখিয়েছে।’
অর্জন নেই, আবু সাঈদকে নিয়ে হয়েছে ব্যবসা
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রংপুর মহানগর কমিটির সাবেক মুখপাত্র নাহিদ হাসান খন্দকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমাদের অর্জন শুধু একটাই, ‘আমরা রক্ত দিতে জানি’ তা দেখিয়েছি। আবু সাঈদ হত্যার পর তার কবর জিয়ারত নিয়ে ব্যবসা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা থেকে শুরু করে বেশ কয়েকজন উপদেষ্টা, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা তার কবর জিয়ারত করেছেন। প্রধান উপদেষ্টা আমাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, রংপুর এক নম্বর হবে। কিন্তু গত এক বছরে নূন্যতম ন্যায্যতা আমরা পাইনি। পুরো উত্তরবঙ্গকে পিছিয়ে রাখা হয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থানের পর রংপুরের মানুষ কিছুই পায়নি।’
বিপ্লবী এই যোদ্ধা বলেন, ‘আবু সাঈদের আত্মত্যাগে স্বৈরাচারের পতন হলেও আমাদের কোনো অর্জন নেই। পরের জুলাইয়ে আমাদের একটাই প্রত্যাশা, বৈষম্য দূর হোক। রংপুরের যে ন্যায্যতা তা যেন এই অঞ্চলের মানুষ পায়। সবার কাছে অনুরোধ আবু সাঈদকে নিয়ে কেউ ব্যবসা করবেন না। কারণ আবু সাঈদ এই আন্দোলনের অন্যতম যোদ্ধা এবং সে বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ। তাঁকে শুধু কবর জিয়ারত করে সম্মান দিলে হবে না। তার অঞ্চলের প্রতি যে বৈষম্য তা দূর করতে হবে। অধিকারের ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠিত হলেই আবু সাঈদের আত্মত্যাগের সার্থকতা মিলবে।’
আরকে