গণআন্দোলনের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন গাইবান্ধার মেহজাবিন

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট, বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। ছাত্র-জনতার স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের মুখে দেশের তৎকালীন সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয় এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করেন। এই ঐতিহাসিক পটভূমিতে দেশের প্রতিটি প্রান্ত থেকে উঠে আসে অসংখ্য সাহসী মুখ, যারা নিজেদের জীবনবাজি রেখে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। এমনই এক আন্দোলনের কেন্দ্র ছিল উত্তরাঞ্চলের গাইবান্ধা জেলা, যেখানে হাজারো শিক্ষার্থীর ভিড়ে এক তরুণীর নেতৃত্ব সমগ্র জাতিকে অনুপ্রাণিত করেছিল।
এই অসামান্য সাহস ও দৃঢ়তার প্রতিচ্ছবি হলেন মেহজাবিন। উত্তরবঙ্গ ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটের তৃতীয় সেমিস্টারের এই ছাত্রী কেবল একজন শিক্ষার্থী ছিলেন না, বরং এক গণআন্দোলনের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। রংপুরে শহীদ আবু সাঈদের মৃত্যুর খবর এবং মায়ের অনুপ্রেরণা তাকে ঘরে বসে থাকতে দেয়নি। ১৭ জুলাই গাইবান্ধার রাজপথে প্রথম মিছিলে অংশ নেওয়ার মধ্য দিয়ে তিনি একটি নতুন ইতিহাসের সাক্ষী হন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সহ-সমন্বয়ক থেকে শুরু করে বর্তমানে ‘দ্য রেড জুলাই গাইবান্ধা’ জেলা শাখার সদস্য সচিব হিসেবে তিনি সেই সংগ্রামের মশাল এখনো হাতে রেখেছেন। এটি শুধু একজন তরুণীর গল্প নয়, বরং শত সহস্র মেহজাবিনের দৃঢ়তার প্রতিচ্ছবি, যারা একটি নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন।
সাংগঠনিক শক্তি ও নেতৃত্বে উত্থান
আন্দোলনের শুরুর দিকে কোনো সংগঠন বা কমিটির অংশ না হয়েও মেহজাবিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সংগঠনের কাজ চালিয়ে যান। ২৮ জুলাই গঠিত হয় একটি সংগঠক দল, যার নেতৃত্বে ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফাহিম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সালেকিন। মেহজাবিনসহ গাইবান্ধার বিভিন্ন এলাকার শিক্ষার্থীরা ওই টিমে যুক্ত হয়ে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মাধ্যমে আন্দোলনের পরিকল্পনা, প্রচার ও সমন্বয় করেন।

সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয় থাকার কারণে তাকে হুমকি-ধামকির শিকার হতে হয়। প্রতিবেশী রাকিব নামের এক যুবক তার মাকে এসে হুমকি দিয়ে যায়। এমনকি একাধিকবার তার ফেসবুক আইডি রিপোর্ট করে বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে, কোনো কিছুই তাকে দমাতে পারেনি।
৪ আগস্ট, গাইবান্ধায় জনতার উত্তাল ঢল
রোববার, ৪ আগস্ট। সারা দেশের মতো গাইবান্ধায়ও উত্তাল ছিল রাজপথ। সকাল থেকেই শহরের ডিসি অফিস এলাকাসহ বিভিন্ন সড়কে খণ্ড খণ্ড মিছিল জমায়েত হতে থাকে। পরে তা এক কিলোমিটারেরও বেশি দীর্ঘ মিছিলে রূপ নেয়। শহরের প্রধান প্রধান সড়কে যখন হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়ে সরকার পতনের দাবিতে স্লোগান দিচ্ছে, তখন পুলিশের ভূমিকা ছিল নিষ্ক্রিয়। তবে, দুপুর ২টার দিকে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের সামনে ছাত্র-জনতার সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ বাধে। পুলিশ আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ারশেল, শটগানের গুলি ও রাবার বুলেট ছুড়ে। এ ঘটনায় আহত হন দুই শতাধিক আন্দোলনকারী এবং গুলিবিদ্ধ হন তিন সাংবাদিক।
মেহজাবিন বলেন, ওই সময় চরম আতঙ্কে দিনাতিপাত করতে হয়েছে। বাড়িতে থাকতে পারিনি, পালিয়েছিলাম। আমরা তথ্য পেয়েছিলাম পুলিশ আমাদেরকে মার্ক করেছে এবং আমাদের খুঁজতেছে। যেখানে পাবে সেখান থেকেই গ্রেপ্তার করবে। আমার বন্ধুবান্ধব, সহপাঠী ও টিম মেম্বাররা সবাই নিজ নিজ বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র লুকিয়ে ছিলাম।

অবশেষে আসে ৫ আগস্ট। চরম উত্তেজনাকর মুহূর্ত। আমরা নিজেদের মধ্যে কমিউনিকেশন করছিলাম, অন্যদিকে গাইবান্ধার পুলিশ প্রশাসনও খুব তৎপর ছিল আমাদের গ্রেপ্তার করতে। সবকিছু ছাপিয়ে আমরা গাইবান্ধা শহরের দিকে আসতে থাকি। পুলিশ প্রত্যেকটি অটো সার্চ করছিল। আমরা সার্চিং পয়েন্টগুলো হেঁটেই পার হয়েছি। আমি নিজেও পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের সামনে অটো থেকে নেমে বাসস্ট্যান্ডের দিকে হেঁটে গিয়েছিলাম, বান্ধবীর বাসায়।
আরও পড়ুন
এদিন আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ কথা হচ্ছিল। মনের মধ্যে থাকা ভয় এবং পুলিশি আতঙ্কের কথা গ্রুপে বলাবলি করছিলাম। গ্রুপের সিদ্ধান্ত মোতাবেক, আমাদের ভয় করলে চলবে না, বের হতে হবে। তখনো শহরে থমথমে পরিস্থিতি। হঠাৎ একটি খবর আসে। আমরা বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে জানতে পারি স্বৈরাচার শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। বিজয়ের পতাকা নিয়ে আমরা রাস্তায় নেমে আসি। সারা গাইবান্ধা শহরে অন্য একটা চিত্র দেখতে পাই।
আন্দোলনে নারীদের বলিষ্ঠ অংশগ্রহণ
মেহজাবিন বলেন, গাইবান্ধার আন্দোলনে তার পাশে ছিলেন বান্ধবী আদিবা ও মৌটুসী। যারা আন্দোলনের জন্য নিজের এক সেমিস্টার পেছনে ফেলেছেন। আদিবা কম্পিউটার সায়েন্স ও মৌটুসী ছিল টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষার্থী। এছাড়া গাইবান্ধা সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী জেরিন ও জয়িতা আপাও সরাসরি আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন।
‘আমরা রক্ত দিয়েছি, নতুন বাংলাদেশ কি সেই স্বপ্ন পূরণ করেছে’— এমন প্রশ্ন রেখে তিনি আরও বলেন, এক বছর পেরিয়ে এলেও আন্দোলনের দাবিগুলোর বাস্তবায়ন নিয়ে আমরা হতাশ। তার ভাষায়, ‘আমরা রক্ত দিয়েছি, চোখ হারিয়েছি, পঙ্গু হয়েছি, হাজার হাজার শিক্ষার্থী-জনতা জীবন দিয়েছেন। কিন্তু এখনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দিলে হুমকি আসে। এখনো রাষ্ট্রযন্ত্রে অনিয়ম, দুর্নীতি ও বৈষম্য বিরাজমান।’
‘এজন্য আবু সাঈদ শহীদ হননি, এজন্য আমরা রাজপথে রক্ত ঝরাইনি। নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নে নামলেও আজও সেই স্বপ্ন অধরা রয়ে গেছে।’

মেহজাবিনের সহযোদ্ধা আদিবা বলেন, জুলাই আন্দোলনের আজ এক বছর পূর্তি। স্বৈরাচার সরকারের পতন হয়েছে, তারা পালিয়েছে কিন্তু আমাদের প্রত্যাশা এখনো পূরণ হয়নি। সর্বসাধারণ যে প্রত্যাশা নিয়ে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করছিল, তা ব্যর্থ হয়েছে। আমরা দেখি এখনো সেই আগের বাংলাদেশ। মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরগুলোতে কোনো পরিবর্তন আসেনি। মানুষের পাঁচটি মৌলিক চাহিদার কোনোটিরই পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন হয়নি। যে বৈষম্যের বিরুদ্ধে আমরা আন্দোলন করেছি সেটি আজও বিরাজমান।
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘আন্দোলনের সময় আমরা নারীরা যে সম্মান পেয়েছি, যেভাবে আমাদের বরণ করে নেওয়া হয়েছিল, সময়ের পরিবর্তনে সেই সম্মানটুকু আজ কোথায়?’
জুলাইযোদ্ধা সংগঠনের গাইবান্ধা শাখার সভাপতি আমিনুল ইসলাম বলেন, গাইবান্ধায় জুলাই অভ্যুত্থানে সকল স্তরের মানুষ অংশ নিয়েছিলেন। এখানে নারীদের ভূমিকাও ছিল উল্লেখযোগ্য। তাদের মধ্যে মেহজাবিন, আবিদা, মৌটুসি, জেরিন ও জয়িতাদের নাম সবার সামনে চলে আসে। নারী হয়েও আন্দোলনে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ, সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। তাদেরকে স্যালুট জানাই।
নারীদের পাশাপাশি গাইবান্ধার শত শত শিশুও আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিল। তিনজন গুরুতর আহত হয়েছিল। তারা জুলাইযোদ্ধা হিসেবে সরকারি গেজেটে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
‘স্বৈরাচার পতনের এক বছর পূর্ণ হলো, কিন্তু আজও জুলাইযোদ্ধারা পদে পদে অবহেলিত’ উল্লেখ করে আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘একটি মহল ও কয়েকটি রাজনৈতিক দল জুলাইকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করছে। আমি মনে করি তাদের হীন প্রচেষ্টা কখনো সফল হবে না। সামনের দিনগুলোতে জুলাইয়ের আদর্শকে ধারণ করে দেশ বিনির্মাণে সকল জুলাইযোদ্ধা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করবে— এই প্রত্যাশা রইল।’
এমএএস/