‘কোনো চেতনা ব্যবসা চাই না, নিরাপদ সমাজ গড়ে উঠুক’

চব্বিশের ফ্যাসিবাদবিরোধী উত্তাল দিনগুলোতে বরিশালে সামনের সারিতে থেকে যে কয়জন নারী লড়াই করেছেন লামিয়া সায়মন তাদের মধ্যে অন্যতম। প্রতিদিন সায়মনের স্লোগানে মুখর হয়ে উঠতো ছাত্র-জনতার কর্মসূচি। পালিয়ে বেড়ানো, পুলিশি নির্যাতন, আটক হওয়ার পরও তাকে সেই আন্দোলন থেকে সরানো যায়নি।
‘একটা ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। আমি ব্যক্তিচিন্তায় স্বাধীন মানুষ। পরমত গ্রহণ, অধিকার নিশ্চিত করা এবং গণতন্ত্রের জন্য কাজ করি। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার দিনে দিনে ফ্যাসিবাদী সরকারে পরিণত হয়।’ বলছিলেন লামিয়া সায়মন।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী মত নিতে পারছিল না। আমাদের আন্দোলনটি একটি অধিকার আদায়ের আন্দোলন হিসেবে শুরু হয়েছিল। লাখো লাখো মানুষ কোটা পদ্ধতির বিরুদ্ধে কণ্ঠ তুলল। হাসিনা সরকার আমাদের কঠোর হাতে দমনের চেষ্টা করলো। এখান থেকেই মূলত সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়।
ওই সময়ে পটুয়াখালী জেলার সুবিদখালী মহিলা কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী ছিলেন লামিয়া সায়মন। পরিবারের সাথে থাকতেন বরিশালের কাউনিয়ার একটি ভাড়া বাসায়। অনুমতি নিয়ে ক্লাস করতেন, সরকারি ব্রজমোহন কলেজে।
সায়মন বলেন, তখন আমি শব্দাবলী গ্রুপ থিয়েটারের নাট্যকর্মী। এছাড়া সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের রাজনীতিতে সক্রিয়। এসব কাজের মধ্য দিয়ে একটা বন্ধু সার্কেল গড়ে ওঠে। আন্দোলনে ওদের যেতে উদ্বুদ্ধ করতাম। শুরুর দিন থেকে বিভিন্ন মানুষের সাথে আন্দোলনের পক্ষে কথা বলেছি। ছাত্রদের আন্দোলনটি যেন গণআন্দোলনে রূপ নেয় সেজন্য অসংখ্য মানুষের সাথে কথা বলতাম।
তিনি বলেন, দিন যত যাচ্ছিল ঝুঁকি বাড়ছিল। প্রশাসনের কাছে আমরা শনাক্ত হয়ে যাই। বিভিন্নভাবে আমাদের হুমকি-ভয় দেখানো শুরু হয়। তবে আমার সিদ্ধান্তে আমি অনড় ছিলাম। রাজপথে যেহেতু নেমে গেছি জীবন গেলেও পিঁছু হটবো না।

সায়মন বলেন, ৩১ জুলাই আমরা বরিশাল আদালত চত্বরের সামনে অবরোধ কর্মসূচি শুরু করি। চারদিকে মানুষের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছিল। দুপুরে পুলিশ এসে আমাদের কর্মসূচিতে হামলা চালায়। হামলা বলতে বর্বর হামলা। আমাকে পিটিয়ে মাটিতে ফেলে দেয়। মাটিতে ফেলে দেওয়া অবস্থায় পেটায়। আমার গলায় ওড়না পেঁচিয়ে টানতে টানতে গাড়িতে নিয়ে তোলে। আরও ৬/৭ জনকে এভাবে মারধর করে আটক করা হয়। কোতোয়ালি থানা থেকে সন্ধ্যায় আমাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। মুচলেকা নেওয়া হয় কোনো আন্দোলন, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যেন অংশ না নেই। সেদিন থানা থেকে বের হয়ে আবারো আন্দোলনে যোগ দেই।
তিনি বলেন, আমরা যারা সাধারণ আন্দোলনকর্মী আমাদের স্বপ্ন ছিল দেশে বৈষম্যহীন সমাজ গড়ে উঠবে। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর সেই আশা আরও তীব্র হয়। তবে এক বছর পরে মনে হচ্ছে স্বপ্ন হয়তো আর পূরণ হবে না। আমি জুলাইযোদ্ধার স্বীকৃতি পাইনি। আমাকে নিয়ে আমার বন্ধুরা ফেসবুকে লেখালেখি করেছে। এখন হতাশা সব জায়গায়।
লামিয়া সায়মন বলেন, অ্যানিমেল ফার্ম মুভিতে আমরা দেখি শেষ পর্যায়ে সাধারণ পশুরা পশুরা মারামারি করে। আমার কাছে কেন যেন মনে হচ্ছে সেদিকেই যাচ্ছি। আওয়ামী লীগের সময়ে কথায় কথায় দল নিষিদ্ধ, মামলা-হামলা করা হতো। এখনোতো একই চর্চা চলছে। তাহলে বদলালো কি? আমরা লড়াই করলাম, আমার ভাইয়েরা প্রাণ দিলো কি সেই পুরোনো পদ্ধতি বহাল রাখার জন্য?
তিনি বলেন, আমার মনে হয় না দেশে কেউ নিরাপদে আছে। বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা ফেস করতে হচ্ছে এখন। আমি কোন চেতনা ব্যবসা চাই না, চাইবো নিরাপদ একটা সমাজ গড়ে উঠুক। যেখানে পরমত গ্রহণ, অধিকার নিশ্চিত এবং গণতন্ত্র থাকবে।
সৈয়দ মেহেদী হাসান/আরএআর