১৪টি বাটুল ও ৮০০ মার্বেল গুলি নিয়ে বের হয়েছিলাম সেদিন

৪ আগস্ট ফজরের নামাজের পর আওয়ামী লীগের লোকজনকে প্রতিহত করার পরিকল্পনা হিসেবে ১৪টি বাটুল ও ৮০০ মার্বেল গুলি নিয়ে বের হই। কয়েকটি গ্রুপ করে বেশ কিছু স্পটে অবস্থান করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। যাতে এক গ্রুপ আটক হলে আরেক গ্রুপ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। এরপর বেলা ১১টার পর যখন সন্ত্রাসীরা আমাদের ওপর অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলি করে তখন এসব বাটুল ও মার্বেল গুলি তাদের প্রতিহত করতে ব্যবহার করা হয়।
সোমবার (৪ আগস্ট) বিকেলে পাবনার বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে সম্মুখ সারির জুলাই যোদ্ধা পাবনা ইসলামীয়া কলেজের শিক্ষার্থী মঈনুল ইসলাম বৃত্ত বিষয়টি জানান।
তিনি বলেন, ৪ আগস্ট রোববার ফজরের আযানের সঙ্গে সঙ্গে আমার মোবাইল নম্বরে ফোন আসে যে আজকে রণ প্রস্তুতি নিতে হবে। ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়ে কয়েকজনকে কল দেই। ভাই কি করবো কীভাবে শহরে ঢুকতে হবে আজকে। আমাকে কল দিয়ে বলা হয় আজকে সর্বোচ্চ ছেলেপেলে আনার চেষ্টা করবে। অনেক ভাইকে গয়েসপুর রোডের ভেতর দিয়ে শহরে পাঠিয়ে দিলাম। ১৪টি বাটুল ও ৮০০ গুলি নিয়ে আমরা প্রথমে পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ গেটে যাই। পরিবেশ এমন ছিল কোনো ব্যাগ বা সেই ধরনের কিছু কেউ দেখলেই বিপদ। তখন শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নয় আওয়ামীপন্থী মানুষও হিংসুক কুকুরের মতো হয়েছিল। এসব বাটুল তিন জন তিন জন করে টিম করে বের করে দিচ্ছিলাম এডওয়ার্ড কলেজের আশপাশে।

তিনি আরও বলেন, তবে এখানে টিমের রাস্তার অবস্থান একাধিক দিয়ে দিচ্ছিলাম যাতে করে এক টিম ধরা পরলে আরেকটা টিম চলে যায় জায়গা মতো। কিছু সময় পরেই ফিরোজ হোসেন ভাই কল দেয় বৃত্ত ভাই সব পাইছো জ্বী ইনশাআল্লাহ ভাই সব পেলাম এবং সবাইকে পাঠিয়ে দিলাম সবাই যাচ্ছেন। ফিরোজ ভাইয়ের কিছু নির্দেশন ছিল সেদিন সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার আহ্বান জানায় আমাকে, কারণ হয়তো-বা যুদ্ধ অনেক দীর্ঘ হতে যাচ্ছে। আমরা বের হওয়ার সময় কল দেয় আতাইকুলার আকরাম মন্ডল আমাকে বললো কনে তুই, ভাই বাসায়, বের হচ্ছি তখন-ই আকরাম মন্ডল ভাই আমাকে সতর্ক করে বললো আজকে গুলি করবে ওরা বিশেষ করে সাঈদ এবং শিবলী ওরা সবাই প্রস্তুতি নিয়ে বসে আছে।
সম্মুখসারির আরেকজন অনিক নামের আরেকজন সমন্বয়ক বলেন, ১৮ জুলাইয়ের পর থেকে আমরা বেশ কয়েকটি টিম একযোগে আন্দোলনের জন্য বুদ্ধি পরামর্শ করতাম। গাজনার বিল বা বিভিন্ন পর্যটন এলাকায় গিয়ে নৌকা ভ্রমণের নামে আমরা আন্দোলনের প্ল্যান করতাম। সেদিন দুপুর ১২টা ২০ মিনিটের দিকে ভাঁড়ারার সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ খান থানা পাড়া এলাকা থেকে পার্টি অফিসে আসার পথে গুলি করে দুজনকে হত্যা করে। এমপি প্রিন্সের ফোন পেয়েই তিনি রাস্তা পরিষ্কার করতেই কয়েকজন সন্ত্রাসী নিয়ে সে গুলি চালায়। আওয়ামী সন্ত্রাসীরা সেদিন একযোগে অবৈধ বন্দুক নিয়ে হামলা করে অসংখ্য শিক্ষার্থীকে আহত করে।
তিনি আরও বলেন, এডওয়ার্ড কলেজের গেট থেকে মিছিল নিয়ে আব্দুল হামিদ সড়কে অবস্থান করলে সন্ত্রাসীরা গুলি করে। আমরাও সেদিন পাল্টা প্রতিরোধের ব্যবস্থা করছিলাম। সেদিনের কথা আজও ভুলতে পারিনি। চোখের সামনে তাজা প্রাণ ঝড়ে গেলো। আমরা সেদিন জেনারেল হাসপাতালে গিয়েও চিকিৎসা পাইনি। বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। আওয়ামী সন্ত্রাসীরা হাসপাতালেও হামলা করেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পাবনার দুজন সাংবাদিক বলেন, ৪ আগস্ট আওয়ামী লীগের অবৈধ অস্ত্রের মহড়ার ছবি তুলতে গিয়েও আমরা নাজেহালের শিকার হয়েছি। প্রেসক্লাবের ওপর থেকে ছবি ভিডিও করতে গেলে প্রেসক্লাবকে লক্ষ করেই কয়েকবার গুলি করেছে। অল্পের জন্য আমরা সাংবাদিকরা রক্ষা পেয়েছি। দুঃখজনক হলেও সত্য যে পাবনার প্রশাসন এসব অস্ত্র একটিও উদ্ধার করতে উদ্যোগে নেয়নি। আসামিও ধরতে পারেনি। ঊর্ধ্বতন কিছু পুলিশ কর্মকর্তার ইন্দনে খুনিরা সেইফ এক্সিট নিয়ে আরাম আয়েশে আছেন।
মোহনা টেলিভিশনের পাবনা জেলা প্রতিনিধি হুজ্জাতুল্লাহ হিরা বলেন, সেদিন আমরা হামলার ভিডিও সংগ্রহ করতে গেলে আওয়ামী লীগের লোকজন হামলা করে বেধরক মারধর করে পা ভেঙে দেয়। এখনো হাটতে চলতে পারি না। আজকে শুনতেছি আন্দোলনে ভূমিকা রাখা সাংবাদিকদের পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। আসলে কাদেরকে পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে বুঝে আসছে না।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন পাবনার সাবেক সমন্বয়ক ও জুলাই রেভ্যুলেশনারি এলায়েন্স পাবনার আহ্বায়ক রাসেল আহমেদ বলেন, সেদিন যেভাবে আমাদের ওপর আওয়ামী লীগের লোকজন অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলি করেছিল। সেটি এখনো আমরা ভুলে যায়নি। এখনেও রক্তের ওপর আমরা দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু এখনও আমরা সঠিক বিচার পাইনি। খুনিদের গ্রেপ্তার করা হয়নি। সেদিন দিনে দুজনকে হত্যা করে রাতে আন্দোলনকারীদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সন্ত্রাসীরা খোঁজাখুঁজি করেছে। কিন্তু সকালে ঘুম থেকে উঠেই শুনি যে হাসিনা আর থাকছে না। দুপুর ১২টার দিকে আমরা সুখবর পাই। পাবনার রাজপথে নেমে আনন্দ উদযাপন করি।
আন্দোলনে আমরা দুই শিক্ষার্থীকে হারিয়েছি। তারা হলো, সদর উপজেলার চর বলরামপুর গ্রামের দুলাল উদ্দিনের ছেলে ও পাবনা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্র জাহিদুল ইসলাম (১৮) এবং হাজিরহাট বেতেপাড়া এলাকার আবুল কালামের ছেলে ও শহরের সিদ্দিক মেমোরিয়াল স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র মাহবুব হাসান নিলয় (১৪)।
এমএএস