জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ঠাকুরগাঁও হয়ে উঠেছিল এক প্রতিরোধের নাম

শ্রাবণের ঝিরিঝিরি জলের ফোটা উপেক্ষা করে সেদিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে ঠাকুরগাঁওয়ের রাজপথে নেমেছিল স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ছোড়া টিয়ারশেল ও রাবার বুলেটকে তোয়াক্কা না করে আন্দোলনের পিছু হটেননি কেউ। বরং পুলিশের উদ্দেশ্যে তাদের প্রতিবাদের ভাষা ছিল বৃষ্টির মতো। গুলি ছুড়লেও রাজপথ ছেড়ে যাবে না কেউ।
ঠাকুরগাঁও জেলা স্কুল বড়মাঠ থেকে যখন ছাত্ররা প্রতিবাদ মিছিল নিয়ে চৌরাস্তার দিকে যাচ্ছিলেন তখনই পুলিশের সাহায্যে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ একজোট হয়ে লাঠিশোঠা নিয়ে শিক্ষার্থীদের পিটিয়ে ছত্র-ভঙ্গ করে দেয়। ছোট-ছোট বাচ্চাদের ছোটাছুটি দেখে সেদিন আর ঘরে বসে থাকতে পারেননি টিকাপাড়া এলাকার বাসিন্দা রিকশাচালক মুনসুর আলী। তাই রিকশা চালানো বাদ দিয়ে রাস্তায় নেমে ছাত্রদের সঙ্গে আন্দোলনে যুক্ত হন তিনি। গত বছর জুলাই আন্দোলনের সময় ঠাকুরগাঁওয়ে স্বৈরাচার হাসিনা ও তার সন্ত্রাসী বাহিনীর বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন ছাত্র-জনতার সঙ্গে তিনিও।
প্রতিরোধের আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল ঠাকুরগাঁও জেলা স্কুল বড়মাঠ থেকে চৌরাস্তা ও বাসস্ট্যান্ড গোলচত্বর এলাকায়। বিশেষ করে বড়মাঠ, চৌরাস্তা এলাকা ছিল ছাত্র-জনতার দখলে। গত বছরের ১৪ জুলাইয়ের পর থেকে প্রায় প্রত্যেক দিন ছাত্র-জনতার সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ হতো। ঠাকুরগাঁওয়ের সাধারণ মানুষ এখনো কল্পনায় শুনতে পান মুহুর্মুহু গুলি, টিয়ারশেল ও রাবার বুলেটের শব্দ। চোখ বুঝলেই দেখতে পান রক্তমাখা শরীরের ছবি।
শুনতে পান ছোট-বড় সকল বয়সী মানুষের বজ্র কণ্ঠের স্লোগান তুমি কে, আমি কে, রাজাকার, রাজাকার, কে বলেছে, কে বলেছে, স্বৈরাচার, স্বৈরাচার, এক দফা, এক দাবি, হাসিনা তুই কবে যাবি। এ যেন এক যুদ্ধ ক্ষেত্র পার করে এসেছে তারা। স্লোগানে স্লোগানে কাঁপিয়ে দিয়েছিল সরকারের ভিত।
‘স্বৈরাচারের পা চাটছে; পুলিশ, এমন স্লোগানে আগুন ঝরেছে ঠাকুরগাঁওয়ের কন্যা রিফা তামান্নার কণ্ঠে।
শুধু মুনসুর আলী নয়, জেলার সাধারণ মানুষ এখনও সেই অভিজ্ঞতার কথা ভুলতে পারেননি। পুলিশের গুলি ও বুলেটের কাছে ছাত্র-জনতার মাথা নত করেনি সেদিন। এতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ঠাকুরগাঁও হয়ে উঠেছিল এক প্রতিরোধের নাম। তবে সেদিন ছাত্র-জনতাকে দেখে ঘরে বসে থাকতে পারেনি অভিভাবকরাও। রাজপথে সহযোগিতা করেছিলেন খাবার ও পানি দিয়ে।
ছাত্রদের আন্দোলনের গতি যখন বাড়তে থাকে তখনেই সরকার কৌশলে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়। যা বাংলাদেশের ইতিহাসে ভয়াবহ ও বেদনাবিধুর এক দিন। সারাদেশ ছিল ইন্টারনেটবিহীন এক অদ্ভুত নৈঃশব্দ্যে। ইন্টারনেট বন্ধ রেখে জনগণকে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। এর মাঝেই শহরের প্রতিটি বাসা, ছাত্রবাস, ও ম্যাসগুলোতে চিরুনি অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। পাশাপাশি ছিল ধরপাকড়।
তবে ইন্টারনেট না থাকায় সবার মাঝে অস্থিরতা বিরাজ করছিল। সবাই তখন মোবাইল ছেড়ে টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রেখেছিল নতুন কোনো খবরের আশায়। আন্দোলন হবে কিনা সেটা জানার জন্য শিক্ষার্থীরা ইন্টারনেটবিহীন দিনগুলোতে প্রতিদিন জেলাস্কুল বড়মাঠে জড়ো হতো। এভাবে পার হয়েছিল ইন্টারনেটবিহীন দিনগুলো। পরবর্তীতে স্বল্প পরিসরে ব্রডব্যান্ড চালু হলে জনজীবনের কাছে এ যেন মরুভূমিতে কয়েক ফোঁটা জল!
৩১ জুলাই আন্দোলন আরও তীব্র আকার ধারণ করে। সেদিন ঠাকুরগাঁওয়ের রাজপথে নারীদের নেতৃত্বে একটি বিশাল বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। মিছিলটি শহরের আর্টগ্যালারি মোড় থেকে আদালতের প্রধান ফটকের সামনে আসলে পুলিশ তাদের বাধা দেয়, তখনই রিফা তামান্না নামে এক শিক্ষার্থী পুলিশকে উদ্দেশ্যে করে স্লোগান দেয় -কে এসেছে, কে এসেছে, পুলিশ এসেছে, পুলিশ এসেছে, কি করছে, কি করছে, স্বৈরাচারের পা চাটছে। পরে পুলিশ তাদের লাঠিচার্জ করলে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন স্কুলছাত্রী অরিন তাসনিম অনন্যাসহ আরো কয়েকজন। মেসেঞ্জার গ্রুপ খুলে নারীদের একত্রিত করে আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন সোহানা ইসলাম সমাপ্তি রিফা তামান্না ও সুজানা।
তবে আন্দোলনে হলগুলো বন্ধ থাকায় হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র মেহেদী হাসান হিমেলসহ আরও কয়েকজনের নেতৃত্বে আন্দোলন আরও চাঙ্গা হয়ে ওঠে। ঘুরে যায় ঠাকুরগাঁওয়ের আন্দোলনের চিত্রপট। তাদের সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দেন নানান শ্রেণির পেশার মানুষ। শ্রমিকরাও রাস্তায় নেমেছিলেন ছাত্র-জনতাকে সমর্থন করতে। গুলির প্রতিবাদে তারা পুলিশের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। এক বছর হয়ে গেলেও সেই দিনগুলো এখনো ঠাকুরগাঁও মানুষের চোখে তাজা স্মৃতি। এই প্রতিরোধে অনেক মানুষকে পঙ্গু করেছে। ছররা গুলিতে অনেকেই অন্ধ হয়ে গেছেন। অনেকে হাত ও পা হারিয়েছেন। এখনও অনেকে আহত হয়ে হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছেন।
অন্যদিকে, খেলতে যাওয়ার কথা বলে স্কুলছাত্র লামিম অংশ নেন আন্দোলনে। পুলিশের সঙ্গে চলে দফায় দফায় সংঘর্ষ। গুলিবিদ্ধ হয় বাম চোখ। রক্তাক্ত শরীরসহ হাসপাতালে নিয়ে যায় সহযোদ্ধারা। একাধিকবার চিকিৎসা নিয়ে স্বাভাবিক হয়নি লামিমের চোখ। তবে চোখ হারিয়ে আফসোস নেই তার। দেখছেন নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন।
লামিম হাসান বলেন, আমার চোখটা এখন আরও ছোট হয়ে যাচ্ছে। ওই চোখ দিয়ে কিছুই দেখতে পারি না আমি। তবে এখন পানি পড়ে চোখ দিয়ে, আর ঘেমে যায়। এতে আমার সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু আমার তাতেও কোনো আফসোস নেই। আমার তো চোখ নেই শুধু কিন্তু অনেকেই তো বেঁচে নেই। শহীদ হয়েছে আমার অনেক ভাই। আমি তাদের জন্য দোয়া করি।
লামিম আরও বলেন, আন্দোলনের ১ বছর হয়ে গেছে। আমি চাই নতুন এক বাংলাদেশ। যে বাংলাদেশে থাকবে না কোনো অন্যায়, দুর্নীতি, হানাহানি ও বিভেদ। এখনও তেমন বাংলাদেশ আমরা পাই নাই। আমার যেসব ভাই এখনো অসুস্থ তাদের চিকিৎসা যেন ভালোভাবে হয়। যারা দেশের জন্য নিজেদের শরীরের অঙ্গ হারিয়েছে তাদের যেন বিদেশে নিয়ে গিয়ে উন্নত চিকিৎসা করা হয় এটাই আমার চাওয়া।
আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী কলেজছাত্র আরমান হোসেন তারেক ঢাকাপোস্টকে বলেন, আমাদের দমনে পুলিশ সমানতালে গুলি ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করেন। কিন্তু বিক্ষুব্ধ জনতা ভয় না করে তারা সড়কে অবস্থান নেন। সড়কে অবস্থান নিয়ে তারা বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন। ছাত্র-জনতার সাহস আর প্রত্যয়ের ইতিহাসও গাঁথা আছে জেলাস্কুল বড় মাঠ ও শহরের প্রতিটি সড়কে সড়কে। আমরা এক স্বৈরাচারকে হটিয়েছি। এটাই আমাদের বড় সাফল্য।
ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী রিফা তামান্না ঢাকাপোস্টকে বলেন, বাসা থেকে বাধা দিয়েছিল যে, তোমার যাওয়া হবে না। আমি বাসা থেকে পালিয়ে আন্দোলনে যুক্ত হই। আসলে আমাকে ঠাকুরগাঁওয়ের বাঘিনী বলা হয়েছে, আমি ঠাকুওগাঁওয়ের বাঘিনী নই। আমি মনে করি রাজপথে যারা এসেছে, আমাদের ছোট-বড় ভাই-বোনেরা, সবাই একেকজন বাঘ ও বাঘিনী ছিল।
ঠাকুরগাঁও বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সোনিয়া জানান, জুলাই আন্দোলনে আমাদের ভাইয়েরা যখন রক্তাক্ত হয়েছিল তখন কেউ বসে থাকতে পারেনি। আমাদের অনেক সহপাঠী ক্লাস থেকে যোগ দিয়েছিল আন্দোলনে। আওয়ামী লীগের লোকজন আমাদের ওপর হামলা করেছিল। তারপরেও হাল ছাড়িনি। আমরা জানি আমাদের বিজয় আসবেই। আরেক শিক্ষার্থী মনির হোসেন বলেন, জুলাইয়ের অধ্যায় একটি রক্তাক্ত অধ্যায়। কত রক্তে এই শহরের সড়ক লাল হয়েছে তার কোনো হিসেব নেই। যারা এই হামলার সঙ্গে জড়িত তাদের সবাইকে বিচারের আওতায় আনা দাবি করে মনির।
পুলিশের লাঠিচার্জে সড়কে পরে যাওয়া অরিন তাসনিম অনন্যা ঢাকা পোস্টকে বলেন, শুরুতে একদমই পরিবার থেকে সাপোর্ট ছিল না। স্কুল ও কোচিংয়ের নাম করে আন্দোলনে যেতাম। আমাদের আগের দিন জানিয়ে দেওয়া হতো কবে কখন আন্দোলন। পরে তাদের সঙ্গেই আন্দোলনে যেতা। তবে আমাদের স্কুল থেকে শুরুতে তেমন কেউ ছিল না, আমরাই কয়েকজন ছিলাম। প্রথমে স্কুলের স্যার-ম্যাডামরা চাপ দিতো আন্দোলনে না যাওয়ার জন্য। তবুও গিয়েছিলাম।
সোহানি ইসলাম সমাপ্তি ও ফারিহা নিশা ঢাকা পোস্টকে বলেন, মার্চ ফর জাস্টিস যেদিন ছিল, সেদিন আর্টগ্যালারি মোড় থেকে আমরা কোর্টের দিকে যাচ্ছিলাম। তখন কোর্টের সামনে পুলিশ বাধা দেয়। এরপর আমরা সামনে এগোতে চাইলে পুলিশ লাঠিচার্জ করে। আমরা মেয়েরা সামনের সারিতে ছিলাম। পুলিশ যখন লাঠিচার্জ করে, তখন আমরা পড়ে যাই। সে সময় একটা পুলিশ আমাদের ওপর হামলা করে। পরিবারের সবাই মারধরের ভিডিও দেখে বকা দিলেও পরে আর মানা করেননি। পরে প্রত্যেকটি আন্দোলনে মা-বাবা সঙ্গে এসেছিল সাপোর্ট করার জন্য।
তারা আরও বলেন, আমরা একটি সুন্দর বাংলাদেশ চাই। যেখানে কোনো বৈষম্য থাকবে না, কোনো ভেদাভেদ থাকবে না। অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ করতে হবে তবেই একটি সুন্দর বাংলাদেশ সম্ভব। কিন্তু আজ আফসোস হয়। আন্দোলনের সময় যে পুলিশগুলো আমাদের গায়ে হাত তুলেছিল তারা এখনো ঠাকুরগাঁওয়ে দাপটের সঙ্গে চাকরি করছে।
অথচ স্কুলের শিক্ষার্থীদের লাঠিচার্জের অপরাধে তাদের শাস্তি হওয়ার কথা ছিল। এমন বাংলাদেশ কি আমরা চেয়েছিলাম। ঠাকুরগাঁওয়ে এখনও অনেক প্রশাসনের কর্মকর্তা আছেন যারা ছাত্র আন্দোলনের বিপক্ষে ছিল। এজন্যই কি আমরা আন্দোলন করেছিলাম। আমরা কিছুই চাই না। তবে যারা আমাদের পিটিয়েছিল, রাত-দিন মানসিকভাবে চাপ প্রয়োগ করেছিল। তাদের বিচার চাই। একটা সুন্দর বাংলাদেশ চাই, যেখানে কোনো বৈষম্য থাকবে না।
মেহেদী হাসান হিমেল বলেন, আন্দোলনে সকল শ্রেণিপেশার মানুষ অংশ নিয়ে খুনি হাসিনাকে সরিয়েছি। এখানে কারও একক অবদান নেই। তবে হাসিনার বাংলাদেশ থেকে বের হয়ে একটা নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি, যে বাংলাদেশ সবাই কথা বলবে। আর যাতে কোনো স্বৈরাচারের জন্ম না হয় এদেশের এই প্রত্যাশা আমাদের।
এমএএস