‘অনেক কাছ থেকে গুলি করে বলে দৌড় দে’

‘আমি সিসি ক্যামেরায় দেখেছি- ছায়াদকে অনেক কাছ থেকে গুলি করে বলে দৌড় দে। তখন ছায়াদ মাটিতে ছেঁচরে প্রায় ৫০ মিটার গিয়েছিল। এখানে পুলিশও গুলি করে এবং পুলিশের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের হেলমেট বাহিনীও ছিল।’
এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদ শিক্ষার্থী ছায়াদ মাহমুদ খানের বাবা বাহাদুর খান।
সাভার পৌর এলাকার ব্যাংক কলোনী মহল্লার আব্দুর সালাম খানের বাড়িতে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় শহীদ ছায়াদ মাহমুদের বাবা বাহাদুর খানের সঙ্গে। দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে ছায়াদ ছিল দ্বিতীয়। সে সাভারের জাবাল ই-নূর দাখিল মাদরাসার ৬ষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল।
শহীদ সায়াদ মাহমুদ খানের বাবা বাহাদুর খান সেই দিনের স্মৃতি মনে করে বলছিলেন, ছায়াদের মৃত্যুর আগের দিন ১৯ জুলাই দুইজন একসঙ্গে জুমার নামাজ পড়েছি। পরে নামাজ শেষ করে এসে ছায়াদ মোবাইলে দেখছিল ১৮ জুলাই সাভারের ইয়ামিনকে পুলিশের সাঁজোয়া যানের ওপর থেকে নিচে ফেলে কীভাবে হত্যা করা হয়েছে, সেই দৃশ্য। সেদিন আমাকে বলছিল, আব্বু দেখো কীভাবে আমাদের ভাই-ব্রাদারদের হত্যা করা হচ্ছে, আমি আন্দোলনে যাব। আমি তখন ছায়াদকে বললাম, তুমি কীভাবে যাবে? তুমি তো অনেক ছোট।
পরের দিন ২০ জুলাই দুপুরে ছায়াদসহ আমার দুই মেয়েকে নিয়ে একসঙ্গে দুপুরের খাবার খেয়েছি। পরে খাবার শেষে আমি বাসা থেকে বের হই ওষুধ নেওয়ার জন্য। তখন ছায়াদ ও আমার ছোট মেয়ে বাড়ির ছাদে উঠে আন্দোলনের ভিডিও করছিল। সেসময় সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডের নিউ মার্কেটের সামনে থেকে ধুয়া উড়তে দেখতে পায়। তখন ছায়াদ বাড়ির ছাদ থেকে নেমে নিউ মার্কেটের দিকে যায়। সেসময় ছায়েদ জাবাল ই-নূর মাদরাসার সামনে গেলে তার আরও সহপাঠীর সঙ্গে দেখা হয় এবং মিছিলে যোগ দেয় তারা। সেই মিছিলে ছায়াদরা স্লোগান দিচ্ছিল ‘কোটা না মেধা, চেয়ে ছিলাম অধিকার হয়ে গেলাম রাজাকার’। এভাবে স্লোগান দিয়ে মহাসড়কের দিকে এগিয়ে আসছিল। তখনকার পুলিশ ও ফ্যাসিবাদী সরকারের হেলমেট বাহিনী ওদের লক্ষ্য করে গুলি করতে করতে যাচ্ছিল।
তিনি বলেন, সেদিন সন্ধ্যা ৬টার পরে আমি জানতে পারি এক মাদরাসা শিক্ষার্থীর শরীরে গুলি লেগেছে। আমি সিসি ক্যামেরায় দেখেছি- ছায়াদকে অনেক কাছ থেকে গুলি করে বলে দৌড় দে। তখন ছায়াদ মাটিতে ছেঁচরে প্রায় ৫০ মিটার গিয়েছিল। এখানে পুলিশও গুলি করে এবং পুলিশের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের হেলমেট বাহিনীও অংশ নিয়েছিল ছাত্রদের দমনে। সেদিন মাদরাসার হুজুর ছায়াদের মায়ের মোবাইল নম্বরে ফোন করে বলে, এখানে অনেক গন্ডগোল হচ্ছে, পুলিশে ধাওয়া দিয়েছে। দেখেন ছায়াদ কোথায় আছে? এদিক ওদিক গিয়েছে কিনা। তখনো বলে নাই ছায়াদের শরীরে গুলি লেগেছে। সেসময় বাড়ির নিচে এসে অনেক খোঁজাখুঁজি করলাম আমি ও ছায়াদের মা। তখন হঠাৎ জানতে পারলাম এক মাদরাসা শিক্ষার্থীর গুলি লেগেছে পায়ে। সেসময় ছায়াদের খোঁজ করছিলাম আমরা। এক পথচারী ছায়াদের পায়ের রক্ত মাখা জুতার ছবি দেখায় আমাকে। তখন আমি নিশ্চিত হই, আমার ছায়াদ গুলিবিদ্ধ হয়েছে। সেই পথচারী জানায় সাভারের শাহীবাগে প্রজন্ম স্কয়ার হাসপাতালে ছায়াদ আছে। কিন্তু সেই হাসপাতালে গেলে চিকিৎসকরা জানান ছায়াদকে এনাম মেডিকলে কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। তখন এনাম মেডিকেলে যাওয়ার জন্য রওনা হই।
কন্নাজড়িত কণ্ঠে বাহাদুর বলেন, সাভারের পাকিজার সামনে আসলে পুলিশ আমাদের দিকে বন্দুক তাক করে বলে, কোথায় যাচ্ছিস তোরা? একই সঙ্গে খারাপ ভাষায় গালি দেয়। সেসময় টিয়ারশেল মারে, এতে আমি চোখে অন্ধকার দেখছিলাম। তারপরও পুলিশ আমাকে বলে গুলি করে দেবো, সে সময় আমি বলি- আপনারা গুলি করেন, আমার ছেলের গুলি লাগছে, আমাদের হাসপাতালে যাইতে হইবো। আমার ছেলের গুলি লাগছে কী অবস্থায় আছে জানি না। আমাদের গুলি করে দেন, আমি মরলে সমস্যা নাই বলে সড়কের উঁচু বিভাজনের কাছে গেলাম। আমার স্ত্রীকে বললাম আমার কাঁধে পা দিয়ে রাস্তা পার হওয়ার জন্য। পরে সে রাজি না হলেও আমার কথায় কাঁধে পা দিয়ে সড়ক পাড় হয়ে এনাম হাসপাতালে গিয়েছি। তখন হাসপাতালে ছায়াদকে অনেক খুঁজা-খুজি করি। কিন্তু ছায়াদের খোঁজ মিলছিল না। আমরা যাওয়ার আগেই হাসপাতালের লোকজন ছায়াদকে নিয়ে মর্গে রেখেছিল। সে সময় এক সাংবাদিক ছিল, তাকে আমি জিজ্ঞাসা করলাম কোনো ছেলে আসছে নাকি ১২ বছরের। পরে সেই সাংবাদিক বললো এক ছেলে এসেছে। পরে মর্গে গিয়ে দেখি বেডে ছায়াদ শুয়ে আছে। আমি ছায়াদের কাছে গিয়ে বলি, ছায়াদ বাবা তুমি কোনো চিন্তা কইরো না ,আমি তোমার চিকিৎসা করাবো। তখন ডাক্তার বলে, ছায়াদ মাহমুদ খান আর নেই।
বাহাদুর খান বলেন, পরে ছায়াদের মরদেহ গ্রামের বাড়ি সিংগাইরের ধল্লায় নিয়ে যাই। তখন রাতে স্থানীয় আওয়ামী লীগের লোকজন এসে বলে রাতেই লাশ দাফন করতে হবে। কিন্তু আমার ছোট মেয়ে তখন সাভারে, সে সকালে আসবে। তাই আমি লাশ দাফন করতে রাজি হইনি। তারা আমাকে এসে অনেক হুমকি দিয়েছে। পরে মধ্যরাতে সিংগাইর থানা পুলিশ আমার বাড়িতে এসে বলে , ওকে (ছায়াদকে) তারাতারি দাফন করতে হবে। অন্যথায় আমাকে থানায় ধরে নিয়ে যাবে। তখন আমি বলি, আমিতো শেষ, আমার কোনো কিছু নাই। পুলিশ অনেক চেষ্টা করছে রাতে মাটি দেওয়ানোর জন্য। কিন্তু আমি দিতে দেইনি। পরদিন সকাল সাড়ে ৯টার সময় ধল্লা কেন্দ্রীয় কবর স্থানে ছায়াদকে দাফন করি।
ছেলে হত্যার বিচার চেয়ে তিনি বলেন, সূক্ষ্ম বিচার চাই। জনগণের সামনে তাদের বিচার করা হোক। একটি পশু পাখিকে গুলি করে মারলেও আমরা মহব্বত করি। কিন্তু তাদের মধ্যে কোনো মায়া ছিল না। যারা আমার ছেলেকে মেরেছে তাদের বিচার আমি রাষ্ট্রের কাছে চাই।
লোটন আচার্য্য/আরএআর