হয়রানিমূলক ভিডিও ভীতিতে ভুগছেন চিকিৎসকরা, আগ্রহ হারাচ্ছেন সেবা দিতে

ঠাকুরগাঁও ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল ও শহরের বিভিন্ন প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসকরা হয়রানিমূলক ভিডিও ভীতিতে ভুগছেন। কখনও কখনও তারা হয়রানিরও শিকার হচ্ছেন। হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও তাদের স্বজনদের ভিড়ে কেউ একজন উদ্দেশ্যমূলকভাবে রোগী দেখার সময় চিকিৎসকের ভিডিওধারণ বা ফেসবুকে লাইভ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করছেন। এসব ভিডিওতে কোনো ধরনের যৌক্তিক বিষয় ছাড়াই অভিযোগ করা হচ্ছে অপচিকিৎসা চালাচ্ছেন চিকিৎসকরা। এতে করে জনমণে বিভ্রান্তকর তথ্য ছড়াচ্ছে এবং চিকিৎসকরা সামাজিকভাবে অবমূল্যায়নের শিকার হচ্ছেন। সম্প্রতি ঠাকুরগাঁওয়ে এমন বেশ কিছু ঘটনায় চিকিৎসক ও প্রাইভেট হাসপাতালের মালিকরা বিব্রত। পাশাপাশি চিকিৎসা সেবা দিতে বিব্রত বোধ করছেন চিকিৎসকরা।
সম্প্রতি এমনই একটি ঘটনা ঘটেছে ঠাকুরগাঁও ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের গাইনী ও স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আইরিশ রহমানের সঙ্গে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় কোনো এক রোগীর প্যাথলজির রিপোর্ট না দেখার। আর এ ঘটনাটি ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছাড়িয়ে দেন রোগীর কোনো এক স্বজন। এতে করে সমালোচনার ঝড় শুরু হয়। এতে করে সামাজিকভাবে বিব্রতকর এবং সমালোনার শিকার হন ওই চিকিৎসক।
জানা গেছে, রোগ নির্ণয়ের বিভিন্ন টেস্টে অতিরিক্ত কমিশন গ্রহণ ও নিম্নমানের রিপোর্ট সরবরাহের অভিযোগে নিউক্লিয়ার ল্যাবের রিপোর্ট বয়কট করেছে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ), ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশনসহ জেলার প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন। অভিযোগ রয়েছে, টিনশেড একটি মাত্র রুমে ৪৫ জন কর্মীর মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করছে নিউক্লিয়ার ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ল্যাব।
অভিযোগ রয়েছে, দালালদের মাধ্যমে গ্রামগঞ্জের রোগীদের এনে নিম্নমানের প্যাথলজিক্যাল উপকরণ দিয়ে রিপোর্ট তৈরি করা হচ্ছে এবং প্রয়োজনের চেয়ে বেশি টেস্ট করানো হচ্ছে। এছাড়া, এ বিষয়ে আপত্তি জানালে চিকিৎসকদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ, বহিরাগত লোকজন দিয়ে ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং জোরপূর্বক রিপোর্ট দেখাতে বাধ্য করার মতো কর্মকাণ্ড চালানো হচ্ছে। যা শহরের সেবা হাসপাতাল, নিরাপদ হাসপাতাল, রেইনবোসহ বেশকটি প্রাইভেট ক্লিনিক ও হাসপাতালে এবং ঠাকুরগাঁও ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালেও ল্যাবটির বিরুদ্ধে বয়কটের নোটিশ চিকিৎসকদের চেম্বারের দরজা ও দেয়ালে টানানো রয়েছে।
আরও পড়ুন
ঠাকুরগাঁও ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের গাইনী ও স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আইরিশ রহমান বলেন, ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন ও বিএমএ’র সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমি নিউক্লিয়ার ল্যাবের রিপোর্ট দেখি না। এ কারণে পরবর্তীতে আমিসহ অন্যান্য চিকিৎসকদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফেসবুকে হেয় প্রতিপন্নের শিকার হয়েছি। এভাবে চলতে থাকলে একদিন চিকিৎসকরা সেবা দিতে ভয় পাবে। রোগী দেখতে ভয় লাগবে। আগ্রহ নষ্ট হয়ে যাবে।
তিনি আরও বলেন, ওই প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে কথা বললেই তারা চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে বিশৃঙ্খলার পরিস্থিতি সৃষ্টি করে হয়রানি ও অপপ্রচার চালানো হয়।
এ বিষয়ে নিউক্লিয়ার ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ল্যাবের পরিচালক এস. এম. মুন এর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, যারা আমাদের ল্যাবের রিপোর্ট যারা ভুল বলছে তাদের কাছে কী প্রমাণ আছে। যারা রিপোর্টের ভুল ধরছেন তারা নিশ্চয়ই অভিজ্ঞ। এরইমধ্যে সমাজসেবা অফিস, ভোক্তা অধিকারের লোকজন এসে আমাদের আমাদের ল্যাব মেশিনগুলো পরিদর্শন করে গেছেন। তারা যদি কোনো ভুলভাল রিপোর্ট পেত তাহলে নিশ্চয়ই আমাদের অবগত করতো। তবে আমার প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো ভুল রিপোর্ট দেওয়া হয় না।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রাইভেট হাসপাতাল ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন ঠাকুরগাঁও জেলা শাখার প্রচার সম্পাদক নাজিম উদ্দীন মাহেল বলেন, আমি ইদানিং দেখছি কিছু ব্যক্তি এ জেলার কিছু প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও কিছু চিকিৎসকে নিয়ে অসত্য, বানোয়াট সংবাদ প্রচার করছেন এবং সেবা নিতে আসা রোগীর কিছু আত্মীয় স্বজন তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভিডিওধারণ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুলভালভাবে প্রচার করছেন। এটা খবুই দুঃখজনক। আমি মনে করি বর্তমানে ঠাকুরগাঁওয়ের স্বাস্থ্য সেবা সব থেকে ভালো অবস্থানে রয়েছে। এছাড়াও চিকিৎসকরা আন্তরিকতার সঙ্গে রোগীদের সেবা প্রদান করে আসছেন।
তিনি আরও বলেন, ডায়াগনস্টিকগুলোতে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি সংযুক্ত করা হয়েছে। সুক্ষভাবে পরীক্ষা-নীরিক্ষা করা হয়। কিন্তু কিছু ব্যক্তি ঘটনাটাকে ভিন্নখাতে নিয়ে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করে সাধারণ মানুষের মাঝে নৈতিবাচক প্রভাব ফেলার জন্য অপপ্রচার চালাচ্ছেন। এতে করে স্বাস্থ্যকর্মীরা হেয় হচ্ছেন।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন ও ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন ঠাকুরগাঁও জেলা শাখার সভাপতি ও ঠাকুরগাঁও ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপতালের সাবেক সিভিল সার্জন ডা. আবু মো. খায়রুল কবির ঢাকা পোস্টকে জানান, সংগঠনের পক্ষ থেকে কয়েকটি ল্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। যতদিন না তারা নিজেদের সমস্যাগুলো সমাধান করবে তাদের তৈরি করা রিপোর্ট দেখবেন না চিকিৎসকরা।
চিকিৎসা চলাবস্থায় রোগীর স্বজনদের ভিডিও করা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা একটা বড় সমস্যা। এখন প্রযুক্তির যুগ সবার হাতে স্মার্ট ফোন। অনেকেই ভিডিও করে বিভ্রান্ত কর লেখালিখে করে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করছে যা অত্যন্ত বিব্রতকর। তবে আগামীতে যাতে কেউ চিকিৎসা চলাকালীন ভিডিও করতে না পারে সেই ব্যাপারে আরও কঠোর হচ্ছি। চিকিৎসক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারদের চিকিৎসা সেবায় কোনো অভিযোগ থাকলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বা সংগঠন রয়েছে। আমাদের লিখিত অভিযোগ দিলে আমরা ব্যবস্থা নেব।
ঠাকুরগাঁও ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. ফিরোজ জামান বলেন, ওই চিকিৎসকের (আইরিশ রহমান) বিরুদ্ধে যে অভিযোগ এসেছিল, সেটা আমরা খতিয়ে দেখেছি, সেখানে কোনো অপচিকিৎসা হয়নি। এরপরেও যদি কোনো ল্যাবের রোগ নির্ণয়ের মান যাচাইয়ের পর খারাপ রিপোর্ট আসে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
রেদওয়ান মিলন/এমএএস