চলনবিলের প্রত্যন্ত গ্রামে শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে পংখারুয়া বিদ্যালয়

সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম পংখারুয়া। চলনবিল অধ্যুষিত এই অঞ্চলে বর্ষাকালে চারদিকে শুধু জলরাশি, যোগাযোগের মাধ্যম একমাত্র নৌকা। অন্য মৌসুমেও চলাচল করতে হয় ভাঙাচোরা সড়ক দিয়ে। এই প্রতিকূল পরিবেশের মাঝেও শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে পংখারুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেছে বিদ্যালয়ের রূপ, বেড়েছে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ, জেগে উঠেছে স্বপ্নপূরণের আশা।
১৯৬৮ সালে আলহাজ ময়ান উদ্দিনের দানকৃত জমিতে ছনের ঘরে যাত্রা শুরু এই বিদ্যালয়ের। প্রথমদিকে ছাত্র ভর্তি করতে শিক্ষকরা বাড়ি বাড়ি যেতেন। বর্ষায় ডিঙি নৌকা, কলার ভেলা বা কখনো স্টিলের পাতিল ভাসিয়ে স্কুলে আসত শিক্ষার্থীরা। অদম্য সেই প্রচেষ্টা আজ বিদ্যালয়টিকে রূপ দিয়েছে আধুনিক শিক্ষার দৃষ্টান্তে।
বর্তমানে বিদ্যালয়ে রয়েছে মাল্টিমিডিয়া ক্লাস, আইসিটির ব্যবহার, সততা স্টোর, নিয়মিত সমাবেশ, শরীরচর্চা, খেলাধুলা, বার্ষিক বনভোজন, স্কাউটিংসহ নানা কার্যক্রম। সুন্দর পরিবেশ ও শৃঙ্খলা দেখে মনে হয় এটি শতভাগ আধুনিকতায় সাজানো একটি বিদ্যালয়।
বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী হুসনেয়ারা খাতুন বলেন, মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমে আমরা অনেক কিছু শিখতে পারছি। এর মধ্যে রয়েছে চিত্র, কবিতা, গল্প। আমাদের বিদ্যালয়ের শিক্ষক সংকট রয়েছে। এটির সমাধান হলে ভালো হবে।
আরেক শিক্ষার্থী জানায়, আমাদের স্কুলে যেতে নানা দুর্ভোগ হয়। বৃষ্টি হলে রাস্তা দিয়ে যেতে পারি না। আমাদের স্কুল ড্রেস ময়লা হয়ে যায়। ভালো একটি রাস্তা থাকলে আমাদের সুবিধা হতো। স্কুল ড্রেস অপরিষ্কার থাকায় ক্লাসে মনোযোগের ব্যাঘাত হয়।
বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আনোয়ার হোসেন বলেন, প্রত্যন্ত অঞ্চলে মাল্টিমিডিয়া পাঠদানে আমাদের সুবিধা হচ্ছে, শিক্ষার্থীদেরও সুবিধা হচ্ছে। দেখে দেখে লেখাপড়ায় শিক্ষার্থীরা উৎসাহিত হচ্ছে। নিয়মিত তারা আসছে। তারা খেলার ছলে শিখছে, তাই বাড়তি চাপ মনে হচ্ছে না।
বিদ্যালয়ের মান দেখতে উল্লাপাড়ার বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আসেন। হেমন্তবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সোহেল রানা বলেন, প্রত্যন্ত এলাকা অনুযায়ী যে মানের ক্লাস, ক্লাসের পরিচ্ছন্নতা রয়েছে তা অসাধারণ। আমাদের বাচ্চাদের থেকে এই বিদ্যালয়ের বাচ্চাদের সবচেয়ে বড় পার্থক্য শিক্ষক না থাকলেও ক্লাসে কোনো বিশৃঙ্খলা নেই, সবাই চুপচাপ। মাল্টিমিডিয়াতেও ক্লাস হচ্ছে। শিক্ষার পরিবেশ কতটা ভালো হতে পারে, এই বিদ্যালয়টি তার প্রমাণ।
বনবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জাহানারা খাতুন বলেন, আমার এই বিদ্যালয়টি দেখার খুব শখ ছিল। অ্যাসেম্বলিতে শিক্ষার্থীরা কত সুন্দরভাবে নিজেরাই শ্রেণিকক্ষ থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। আবার ছোট থেকে বড় ধারাবাহিকভাবে দাঁড়াচ্ছে। আমি এখান থেকে শৃঙ্খলার বিষয়টি মাথায় নিয়েছি। নিজ বিদ্যালয়ে এটি গড়ে তুলতে চাই।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কে. এম. রহমতুল বারী বলেন, প্রত্যন্ত অঞ্চল হওয়ায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক কম ছিল। ১২০০ ভোটারের এই গ্রামে শিক্ষার্থী ছিল মাত্র ৫০ জন। এখন শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে। যোগাযোগব্যবস্থা উন্নয়ন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও শিক্ষক সংকট দ্রুত সমাধান করা জরুরি।
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার ছানোয়ার হোসেন বলেন, এখন যে রাস্তা রয়েছে, আগে সেটিও ছিল না। বর্ষার ফলে রাস্তাটি ভেঙে গেছে। আমরা এই ইউনিয়নের প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলব, যেন রাস্তাটি সংস্কার করতে পারি। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকেও এই বিদ্যালয়ের এত ভালো অবস্থান অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় হবে।
বর্তমানে ৭ জন শিক্ষকের পরিবর্তে মাত্র ৪ জন শিক্ষক দিয়ে বিদ্যালয়টি চলছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা দুর্বল হলেও শিক্ষার মান তুলনামূলক অনেক ভালো। এরই স্বীকৃতি হিসেবে এখানকার প্রধান শিক্ষক সিরাজগঞ্জ জেলার শ্রেষ্ঠ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নির্বাচিত হয়েছেন।
অসংখ্য প্রতিকূলতা পেরিয়ে আজ বিলের মাঝেই দাঁড়িয়ে আছে পংখারুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এটি শুধু একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, বরং প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিশুদের স্বপ্নপূরণের সোপান ও আলোকিত ভবিষ্যতের প্রতীক।
নাজমুল হাসান/আরকে