ভোলায় নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে এক মাসে ৪ শিশুর মৃত্যু

ভোলায় বাড়ছে নিউমোনিয়া আক্রান্ত শিশুদের মৃত্যু। চলতি বছর নিউমোনিয়া আক্রান্ত হয়ে ১৬ জন শিশুর মৃত্যু হয়েছে এবং গত একমাসে প্রাণ হারায় ৪ শিশু। বিভিন্ন উপজেলা থেকে এনে প্রতিদিনই ভোলার ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি কারানো হচ্ছে নিউমোনিয়া আক্রান্ত নতুন নতুন শিশুদের। হাসপাতালে প্রয়োজনীয় ওষুধ ও যথাযথ চিকিৎসা না পাওয়ার অভিযোগ স্বজনদের। তবে স্বল্প জনবলে ধারনক্ষমতার দ্বিগুন নিউমোনিয়াসহ অন্যান্য রোগে আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম অবস্থা বলে জানান হাসপাতাল কতৃপক্ষ। এদিকে শিশুদের নিউমোনিয়া থেকে রক্ষায় সচেতনতার ওপর জোর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের।
ভোলার ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতাল কতৃপক্ষের তথ্য মতে, চলতি বছরে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ১৬ জন শিশুর মৃত্যু হলেও গত এক মাসে মৃত্যু হয়েছে চারজনের। গত ১৫ আগস্ট থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর অর্থাৎ একমাসের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৫ আগস্ট মৃত্যু হয় এক শিশুর, ৭ সেপ্টেম্বর এক শিশুর, ৩ সেপ্টেম্বর এক শিশু এবং সর্বশেষ গতকাল ১৫ সেপ্টেম্বর মৃত্যু হয় এক শিশুর।
এ ছাড়া, চলতি বছরে নিউমোনিয়া আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেয় ৪ হাজার ৪৬৩ শিশু এবং গত একমাসে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেয় ৩৮০ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি নিউমোনিয়া আক্রান্ত শিশু ৪৩ জনসহ অন্যান্য রোগে আক্রান্ত ১০৭ শিশু।
সরেজমিনে হাসপাতালের ৫০ বেডের শিশু ওয়ার্ড ঘুরে দেখা যায়, হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডের বারান্দা ও একই বেডে একের অধিক শিশুকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ধারণক্ষমতার দ্বিগুন রোগীর চিকিৎসায় নিয়োজিত মাত্র একজন শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, তাও দুপুর ২টার পর তাকে আর ওয়ার্ডে পাওয়া যায়নি। ফলে ওয়ার্ডে ভর্তি যে কোনো শিশুসহ পুরো হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের জরুরি প্রয়োজনে ভরসা জরুরি বিভাগে কর্মরত একজন মেডিকেল অফিসার।
আরও পড়ুন
ভোলা সদর উপজেলার ইলিশা ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা সালমা বেগম। তার স্বামী রিপন মেঘনায় মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। এ দম্পতির তিনমাস বয়সী শিশু মো. হাসান। হাসপাতালে ভর্তির দুই দিন আগে তার তীব্র শ্বাসকষ্ট ও জ্বর ওঠে। পরে তাকে চিকিৎসার জন্য ভোলা সদরের জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করান শিশুটির বাবা-মা।
ওয়ার্ডের বারান্দায় সালমা বেগম তার ছেলেকে নেব্যুলাইজার দিচ্ছেন। জানতে চাইলে তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ, সরকারি হাসপাতালে পোলারে (ছেলে) নিয়ে আসছি বিনামূল্যে চিকিৎসা নিতে। গত ৫ দিন ধরে পোলাডা হাসপাতালে ভর্তি। প্রতিদিন সকালের দিকে একজন ডাক্তার ওয়ার্ডে রাউন্ডে আসেন। তিনি ওয়ার্ডে আসার পর ওষুধ লিখে দেন, হাসপাতালে চাইলে বলে, এসব ওষুধ নেই, বাহিরের থেকে কিনে আনেন। তিনি প্রশ্ন করে জানতে চাইলেন, হাসপাতালে ভর্তি হয়ে বাহিরের থেকে ওষুধ কিনে আনতে হলে সরকারি হাসপাতালে কেনো ছেলেকে ভর্তি করলাম?’
সদর উপজেলার শিবপুর ইউনিয়নের সুলতানা-ইসমাইল দম্পতির আড়াই বছরের নিউমোনিয়া আক্রান্ত কন্যাশিশু বুশরা হাসপাতালে ভর্তি। শিশুটির মা সুলতানা অভিযোগ করে বলেন, নেব্যুলাইজার ফেসমাস্ক ও ঠান্ডার ইনজেকশন বাহিরের থেকে কিনেছি। ওয়ার্ডে কর্তব্যরতরা বলেছে, হাসপাতালে নেই। এ ছাড়া, ১০ সিসি ইনজেকশন সিরিঞ্জ ও বাহিরের থেকে কিনেছি।
একই ইউনিয়নের বাসতলা ৯ নম্বর ওয়ার্ডের আয়েশা-জাহিদুর ইসলাম দম্পতির ছেলে শিশু আরাফ ইসলাম। এ শিশুটিও প্রায় ৫ দিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। আয়েশা বলেন, ‘হাসপাতাল থেকে দিয়েছে শুধু একটা এমব্রোক্স সিরাপ ও একটা স্যালাইন। ডাক্তার ইনজেকশন লিখে দিছে, বাহিরের থেকে কিনে এনেছি। এমনকি ক্যানোলা পর্যন্ত বাহিরের থেকে কিনে এনেছি। সরকারি হাসপাতালে এসে কী লাভ হলো? এতো বড় হাসপাতাল! অথচ দুপুরের পর শিশু ওয়ার্ডে কোনো ডাক্তার পাওয়া যায় না।’
হাতে ছোট্ট কাগজের টুকরো। দেড় বছরের শিশু মুনিয়াকে হাসপাতালের ওয়ার্ডে ভর্তির পরপরই দ্রুত ওয়ার্ড ত্যাগ করছিলেন শিশুটির বাবা। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ডাক্তার ৩টা ইনজেকশন লিখে দেওয়ার পর ওয়ার্ডের নার্সদের দেখিয়েছি। তারা বলেছেন, হাসপাতালে এসব ইনজেকশন নেই, কিনে আনুন, তাই যাচ্ছি। তিনি বলেন, হাসপাতাল থেকে দিলে আর বাহির থেকে এসব ইনজেকশন কেনা লাগতো না, আমাদের অনেক উপকার হতো। আমাদের অনেক টাকা থাকলে কি আর সরকারি হাসপাতালে মেয়েকে ভর্তি করাতাম?
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ভোলার ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. শেখ সুফিয়ান রুস্তম ঢাকা পোস্টকে বলেন, নিউমোনিয়া আক্রান্ত শিশু রোগীদের ওষুধ সংকটের বিষয়টি সঠিক নয়। তবে কিছু ওষুধের সংকট রয়েছে। কিছু ওষুধ ইজিপি টেন্ডারের মাধ্যমে কিনতে হয়, টেন্ডারটি এখনই দিতে পারছি না, আগামী মাসের মধ্যে টেন্ডার সম্পূর্ণ করলে বাকি ওষুধের ঘাটতি পূরণ হবে।
তিনি বলেন, এই মুহূর্তে শিশু ওয়ার্ডে ১০৭ শিশু চিকিৎসাধীন রয়েছে, এসব রোগীদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে রয়েছেন একজন সিনিয়র কনসালটেন্ট, তারপরও আমরা যথাযথ চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছি। যদি চিকিৎসক বাড়ানো না যায় তাহলে সেবা প্রদান কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
শিশুদের অভিভাবকদের সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানিয়ে এ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, আবহাওয়ার পরিবর্তনজনিত কারণে শিশুরা নিউমোনিয়া আক্রান্ত হচ্ছে। নিউমোনিয়া থেকে রক্ষায় শিশুদের সুরক্ষিত রাখতে সরাসরি ফ্যানের নিচে ও মল-মূত্র ত্যাগের স্থান থেকে সরিয়ে রাখতে হবে এবং শুকনো জায়গায় রাখতে হবে।
মো. খাইরুল ইসলাম/এএমকে