৫ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে শুরু, রাজিয়ার পণ্য আজ রপ্তানি হচ্ছে ৯ দেশে

নীলফামারীর রাজিয়া সুলতানা এক সময় অনেক চেষ্টা করেও একটি চাকরি জোগাড় করতে পারেননি। তবে হতাশ না হয়ে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে শুরু করেছিলেন অনলাইন ব্যবসা। তার সেই ছোট্ট উদ্যোগই এখন রূপ নিয়েছে ‘নান্দনিক ক্রাফট’ নামে একটি কারখানায়।
তার সেই কারখানায় তৈরি পাট ও সুতার পণ্য এখন বাংলাদেশের গণ্ডি পেরিয়ে রপ্তানি হচ্ছে সৌদি আরব, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, জাপানসহ বিশ্বের ৯টি দেশে।
নীলফামারীর সৈয়দপুর শহরের নিয়ামতপুর মুন্সিপাড়ার বাসিন্দা রাজিয়া সুলতানা। দুই সন্তানের জননী রাজিয়া সংসার চালানোর পাশাপাশি নিজে উপার্জনক্ষম হতে চেয়েছিলেন। উদ্যোক্তা হিসেবে তিনি তিনবার জয়িতা নির্বাচিত হয়েছেন।
রাজিয়ার উদ্যোক্তা হওয়ার পথ সহজ ছিল না। শুরুতে উপায় খুঁজে পাননি। পরে এক বন্ধুর পরামর্শে যুক্ত হন অনলাইনে উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণের একটি প্ল্যাটফর্মে। সেখানকার সফল নারীদের গল্প তাকে অনুপ্রাণিত করে। পরে ইউটিউব থেকে শেখেন নানা পণ্য তৈরির কৌশল। অংশ নিয়েছেন যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর ও মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণেও।
২০২০ সালে সন্তানের জমানো মাত্র পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে শুরু করেন অনলাইন ব্যবসা। ফেসবুকে খোলেন ‘নান্দনিক ক্রাফট’ নামে একটি পেজ। এরপর মেলায় অংশ নিয়ে পণ্যের পরিচিতি ও বিক্রি বাড়ে। এখন তার কারখানায় কাজ করছেন প্রায় ১০ জন নারী শ্রমিক। তারা মাসে ৫ হাজার থেকে ১২ হাজার টাকা পর্যন্ত বেতন পান।
কারখানার নারী শ্রমিক রোজিনা বেগম বলেন, আমি আগে অভাবের মধ্যে ছিলাম। তারপর ৪ বছর আগে নান্দনিক ক্রাফট কারখানায় কাজ শুরু করি। এখানে কাজ করে মাসে ৮ হাজার থেকে ১২ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় হয়। সমাজের পিছিয়ে পড়া নারী ছিলাম আমি। এখন এখানে কাজ করে সাবলম্বী হয়েছি। আমি সংসারে সহায়তা করার পাশাপাশি সন্তানের পড়ালেখা চালাচ্ছি।

আরেক শ্রমিক তানজিলা আক্তার বলেন, আমি একটি কলেজে পড়ালেখা করি, সেটার পাশাপাশি এখানে কাজ করি। আমরা বাবা নিম্নআয়ের মানুষ, আমাদের পড়ালেখা চালাতে তার কষ্ট হয়। পরে আমি নান্দনিক ক্রাফটের খোঁজ পেয়ে এখানে যুক্ত হই। এখানে যুক্ত হয়ে আমি মাসে ১২ হাজার টাকার মতো বেতন পাই। এটা দিয়ে নিজের পড়ালেখা চালানোর পাশাপাশি পরিবারকে সহায়তা করছি।
রাহেদা বেগম নামে আরেক শ্রমিক বলেন, আমি অভাবের সংসারে বড় হয়েছি। এরপর আমার বিয়ে হয়, বিয়ের পর স্বামীর সংসার কিছু দিন ভালো চললেও পরে অভাব শুরু হয়। পরে রাজিয়া আপার নান্দনিক ক্রাফটের কথা শুনে এখানে এসে কাজ শুরু। এখানে কাজ শুরু করার পর থেকে আমি পরিবার নিয়ে খুব ভালোই আছি।
নারী উদ্যোক্তা রাজিয়া সুলতানা বলেন, আমি দীর্ঘদিন ধরে চিন্তা করছিলাম কি করা যায়। পরে মাস্টার্স শেষ করে বিভিন্ন জায়গায় চাকরির চেষ্টা করলেও হয়নি। পরে অনেক চেষ্টা করে ফেসবুকে পরিচিত এক বন্ধুর মাধ্যম উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স নামে একটি গ্রুপে যুক্ত হই। ওখান থেকে অনুপ্রেরণা পাই। সেখান থেকে সন্তানের জমানো ৫ হাজার টাকা দিয়ে পাটসুতা দিয়ে পণ্য তৈরি করে অনলাইনে বিক্রি শুরু করি। পরে একটি মেলায় অংশগ্রহণ করে আমার পরিচিত বাড়ে সেখান থেকে আমার বিক্রি আরও বেড়ে যায়। পরে আমি নান্দনিক ক্রাফট নামে একটি কারখানা দেই। আমার কারখানায় ১০ জন নারী শ্রমিক দৈনিক কাজ করছে। আমার এটির পিছনে আমার স্বামী বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছে। আমি সবকিছু মিলিয়ে মাসে প্রায় ৬০ টাকা আয় করি। আমার তৈরি পণ্য সৌদি আরব, কাতার, জাপানসহ ৯টি দেশে যাচ্ছে। আমি উদ্যোক্তা হিসেবে তিনবার শ্রেষ্ঠ জয়িতা হয়েছি। আমি চাই সমাজের পিছিয়ে পড়া নারীরা এগিয়ে যাক তারা ভালো কিছু করুক। সমাজের বিভিন্ন নারীকে আমিও ব্যাক্তিগতভাবে সহায়তা করার চেষ্টা করি।
নারী সংগঠক ও সৈয়দপুর মহিলা মহাবিদ্যালয়ের প্রভাষক শিউলী বেগম বলেন, আমি একজন নারী সংগঠক হিসেবে সমাজের নারীদের দিয়ে কাজ করি। সমাজের পিছিয়ে নারীরা যাতে কিছু করতে পারে সেটার দিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। রাজিয়া সুলতানা নামে একজন উদ্যোক্তা তার বিভিন্ন পণ্য তৈরি করে দেশের বিভিন্ন জায়গাসহ বিশ্বের কয়েকটি দেশে বিক্রি করছেন। আমি প্রতি বছরে নারী উদ্যোক্তা মেলা করার চেষ্টা করি যাতে নারীরা অনুপ্রেরণা পায়।
সৈয়দপুর উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা নূরনাহার শাহজাদী বলেন, আমরা উদ্যোক্তা নারীদের বিভিন্ন ভাবে সহায়তা করছি। আমরা নারীদের এগিয়ে নিতে প্রশিক্ষকসহ বিভিন্ন ধরনের আয়োজনের মাধ্যমে আমরা নারীদের উদ্যোক্তা বা আত্মনির্ভরশীল হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ করছি। শহরে রাজিয়া সুলতানা একজন নারী উদ্যোক্তা আছেন, তিনি আমাদের অধিদপ্তর থেকে তিনবার জয়িতা নির্বাচিত হয়েছেন।
আরকে