ফয়সালের পাকিস্তানে থাকার খবর জানতো না পরিবার

‘হঠাৎ এক দিন রাতে দুবাই যাওয়ার কথা বলে তাড়াহুড়ো করে ঢাকার বাসা থেকে বিদায় নেয় ফয়সাল হোসেন। সঙ্গে নেয় পোশাক ভর্তি একটি ব্যাগ। কার সঙ্গে কিভাবে যাচ্ছে কিছুই জানায়নি। কিছুদিন পর ভারতে পৌঁছে ফোন দেয় ফয়সাল। পরে বাংলাদেশ থেকে নিলো না কেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে ভারত থেকে গেলে ১ লাখ টাকা কম লাগবে বলে জানায় সে। এরপর ধিরে ধিরে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ কমে যেতে থাকে।’
‘এরপর মাসের পর মাস যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল ফয়সালের। দীর্ঘদিন পর শেষবারের মতো গত কোরবানি ঈদের আগে ফোন দিলে কথা হয়। এরপর আর কোনো কথা হয়নি। আর ফয়সাল ফোন না দিলে যোগাযোগ করা সম্ভব হতো না। গতকাল জানতে পারি আমার ভাই মারা গেছে। ছবি দেখে মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হয়েছি। এখন একটাই দাবি, আমার ভাইয়ের মরদেহটা যেন দেশে আনার ব্যবস্থা করা হয় এবং যারা এই পথে নিয়েছে তাদের যেন বিচার করা হয়।’
বুকে চাপা কষ্ট নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন পাকিস্তানের ‘খাইবার পাখতুনখোয়ার কারাক জেলায়’ পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনীর এক অভিযানে গুলিতে নিহত বাংলাদেশি যুবক ফয়সাল হোসেনের বড় ভাই আরমান হোসেন। সোমবার (২৯ সেপ্টেম্বর) তিনি জানান, ফয়সাল পাকিস্তানে গিয়ে যোগ দিয়েছিল ‘তেহরিক-ই-তালিবান' নামে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনে।
নিহত ফয়সালের বাড়ি মাদারীপুর সদর উপজেলার কালিকাপুর ইউনিয়নের ছোট দুধখালী গ্রামে। বাবা আব্দুল আউয়াল মোড়ল পল্লী বিদ্যুৎ অফিসের ইলেক্ট্রিশিয়ান। মা চায়না বেগম গৃহিনী। বড় ভাই আরমান হোসেন দারাজের ডেলিভারিম্যান হিসেবে কাজ করেন। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে সবার ছোট ফয়সাল। জন্মসূত্রেই পরিবারের সঙ্গে রাজধানীর নর্দ্দা বসুন্ধরার আজিজ সড়কে বসবাস করতেন। আদরের সন্তানের মৃত্যুতে পরিবারে চলছে শোকের মাতম। তবে মাস খানেক আগে গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তের মাধ্যমে ফয়সাল পাকিস্তানে আছে এবং জঙ্গি সংগঠনে যোগ দিয়েছে বলে জানতে পারেন পরিবারের সদস্যরা।
আরও পড়ুন
পরিবার, স্বজন ও স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, অভাবের সংসার হলেও ২০২০ সালে রাজধানী ঢাকার একটি স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করেন ফয়সাল। এরপর সংসার খরচে সহযোগিতা করতে একটি বইয়ের লাইব্রেরিতে বছরখানেক চাকরি করেন। পরে নিজ উদ্যোগে শুরু করেন তসবিহ-আতর বিক্রির ব্যবসা। ঢাকার বিভিন্ন মসজিদের সামনে হাতে করে নিয়ে বিক্রি করতেন এসব। পরে সততা ও নম্র-ভদ্র দেখে ফয়সালকে ওষুধ ফার্মেসিতে চাকরি দেন ঢাকাইয়া এক প্রতিবেশী ব্যবসায়ী। কিন্তু সেখানে মাত্র দুই মাস কাজ করেন। এরপর হঠাৎ করে ২০২৪ সালের মার্চ মাসে রাতে তাড়াহুড়ো করে কিছু পোশাক নিয়ে বাড়ি ছাড়েন ফয়সাল। পরিবারকে জানান, হিজামা সেন্টারে চাকরির জন্য দুবাই যাচ্ছেন তিনি।
গত কোরবানির ঈদের আগে তার সঙ্গে পরিবারের সর্বশেষ যোগাযোগ হয়। এরপর ফয়সালের আর কোনো খোঁজ পায়নি পরিবার। গত শুক্রবার (২৬ সেপ্টেম্বর) রাতে ‘খাইবার পাখতুনখোয়ার কারাক জেলায়’ পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনীর এক অভিযানে ১৭ টিটিপি সদস্য নিহত হন। এর মধ্যে মারা যান বাংলাদেশি যুবক ফয়সালও। তার পড়নের পোষাক থেকে আইডি কার্ড, টাকা এবং অন্যান্য ডকুমেন্ট উদ্ধার করে সেখানকার নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। পরে পাকিস্তানের গণমাধ্যমে প্রকাশ হয় নিহতদের ছবি। সেই ছবি দেখে ফয়সালের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হয় পরিবার।
নিহত ফয়সালের বাবা আব্দুল আউয়াল মোড়ল বলেন, গত রমজানের মধ্যে রাতের বেলা ফোন করে আমাকে বলেছিল, আমি দুবাই যাচ্ছি। কার সঙ্গে যাচ্ছো এবং কে নিচ্ছে জানতে চাইলে বলে, 'আপনি চিনবেন না, আমার জন্য দোয়া করবেন'। এই বলে চলে যায়। এরপর প্রায় মাসখানেক আগে আমাদের বাড়িতে ফয়সালের বিষয় খোঁজ নিতে আসে গোয়েন্দা অফিসাররা। তখন তাদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, আমার ছেলে দুবাই না, পাকিস্তান আছে। এখন খবর পেলাম আমার ছেলে মারা গেছে। যারা আমার ছেলেকে এই পথে নেছে তাদের বিচার চাই। আমার ছেলে যদি অপরাধী হয়, তাহলে এখন তো সে মারা গেছে। সরকারের কাছে দাবি আমার ছেলের মরদেহটা যেন দেশে আনার ব্যবস্থা করেন এবং শেষ দেখাটা দেখে বাড়িতে মাটি দিতে পারি।
তিনি আরও বলেন, আমার ছেলে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ কালাম পড়তো। কারো সঙ্গে বাজে কোনো আড্ডায় ছিল না। আমরা ৪০ বছর যাবত নর্দ্দা বসুন্ধরায় বসবাস করে আসছি। খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন আমার ছেলে ফয়সাল বা আমাদের পরিবারের কারোর নামে কোনো খারাপ রেকর্ড নাই।
এ সময় শেষবারের মতো আদরের সন্তানকে এক নজর দেখার আকুতি জানান মা চায়না বেগম। সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছেন তিনিও।
মাদারীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম এন্ড অবস) জাহাঙ্গীর আলম বলেন, পরিবার চাইলে নিহতের মরদেহ দেশে ফেরত আনতে সহযোগিতা করা হবে। আর কেউ যাতে এমন সংগঠনে আর যুক্ত হতে না পারে সে ব্যাপারে সতর্ক পরিবারের পাশে সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে সচেতন থাকার আহ্বান জানান জেলা পুলিশের এই কর্মকর্তা।
আকাশ আহম্মেদ সোহেল/এএমকে