মেলায় র্যাফেল ড্র, লোভে নিঃস্ব মানুষ

* মেলা বন্ধে ডিসি-এসপিকে নোটিশ
* প্রতিদিন লুটে নেওয়া হচ্ছে কোটি টাকা
* লোকসানের মুখে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা
রংপুরের বদরগঞ্জে খোলাহাটি ক্ষুদ্র কুঠির শিল্প ও বাণিজ্য মেলার নামে চলছে রমরমা র্যাফেল ড্র। রংপুর ও দিনাজপুরের কয়েকটি উপজেলায় তিনশ রিকশা ও অটোরিকশায় পথে-ঘাটে, হাটে-বাজারে, গ্রামগঞ্জের অলিগলিতে র্যাফেল ড্রর টিকেট বিক্রি হচ্ছে দেদারসে। এতে করে প্রতিদিন কমপক্ষে কোটি টাকারও বেশি লুটে নিচ্ছে মেলার আয়োজকরা। যার প্রভাব পড়েছে গ্রামীণ অর্থনীতিতে। লোভে পড়ে নিঃস্ব প্রতিদিন টিকেট কিনে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলছে সাধারণ মানুষ।
অভিযোগ উঠেছে, র্যাফেল ড্রর পাশাপাশি মেলা ঘিরে বেড়েছে চুরি-ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধ। মেলার আড়ালে অনৈতিক কর্মকাণ্ড চলছে বলেও দাবি স্থানীয় বাসিন্দাদের। সম্প্রতি মেলায় র্যাফেল ড্র বন্ধে রংপুরের জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে উকিল নোটিশ পাঠিয়েছেন লাভলু মিয়া নামে স্থানীয় একজন।

বদরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী (ইউএনও) কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, খোলাহাটি ক্ষুদ্র কুঠির শিল্প ও বাণিজ্য মেলা আয়োজনে আমাদের কোনো অনুমোদন নেই। আমরা বিভিন্নজনের অভিযোগের প্রেক্ষিতে বেশ কয়েকবার সেখানে অভিযান চালিয়েছি। ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ৯ জনকে সাজাও দেওয়া হয়েছে। র্যাফেল ড্র বন্ধে যার যার অবস্থান থেকে প্রতিবাদ করা উচিত।
খোলাহাটি ক্ষুদ্র কুঠির শিল্প ও বাণিজ্য মেলার নামে র্যাফেল ড্র বন্ধে স্থানীয় বাসিন্দারা বদরগঞ্জে দিনব্যাপী সড়ক অবরোধ, বিক্ষোভ ও জেলা প্রশাসনকে চিঠি দিলেও কোনো উদ্যোগই বাস্তবায়ন হয়নি। তাই র্যাফেল ড্র বন্ধে সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতনের সরাসরি হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা।

জানা গেছে, রংপুরের বদরগঞ্জ ও দিনাজপুরের পার্বতীপুরের মধ্যবর্তী এলাকা হাসিনানগরে গত ১৮ আগস্ট এই মেলার উদ্বোধন করা হয়। মেলায় প্রবেশ মূল্যের নামে ২০ টাকা দরে টিকেট বিক্রি হচ্ছে। প্রতিদিন রংপুর-দিনাজপুরের বিভিন্ন উপজেলায় টিকেট নিয়ে সবাই বের হয় অটোরিকশা ও রিকশায়। প্রতিটিতে রিকশা-অটোরিকশায় ২০টি বান্ডিলে পাঁচ কালারের ২ হাজার টিকেট থাকে। প্রতি টিকেটের দাম ২০ টাকা হারে ২ হাজার টিকেট বিক্রি হচ্ছে ৪০ হাজার টাকা। সে হিসেবে তিনশ রিকশা ও অটোরিকশায় ১ কোটি ১২ লাখ টাকা বিক্রি হয়। এ ছাড়া, মেলা মাঠের ভেতর ও মেলা গেট এবং হাসিনা নগরে অন্তত একশ কর্মী এই টিকেট বিক্রি করছেন।
এদিকে, মধ্যরাতে মেলা কর্তৃপক্ষ কমপক্ষে দামি পাঁচটি মোটরসাইকেল, আট-দশ ভরি স্বর্ণালঙ্কারসহ প্রায় ২০ লাখ টাকার বিভিন্ন ধরণের আকর্ষণীয় পুরস্কার দিয়ে প্রতিদিন ড্র করছেন। যা স্থানীয় ডিস লাইন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, বদরগঞ্জ উপজেলার হাসিনা নগরে চলা এই মেলার পূর্ব পাশে রয়েছে অন্তত ১৫টি খাবার দোকান ও ম্যাজিক শো, উত্তরে সার্কাসের নামে উদ্যাম নৃত্য ও মোটরসাইকেল খেলার নামে ‘মৃত্যুকূপ’, পশ্চিমে র্যাফেল ড্রর স্টেজ, মাঠের দক্ষিণ-পশ্চিমে রয়েছে নিন্মমানের কিছু সংখ্যাক দোকানপাট। মাঝ মাঠে রয়েছে শিশুদের জন্য কয়েকটি বিনোদনের ব্যবস্থা আর র্যাফেল ড্রর টিকেট বিক্রির ব্যবস্থা।
মেলায় যাওয়া দর্শনার্থীরা জানান, মেলায় যেসব পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে তা অত্যন্ত নিম্মমানের। কিন্তু দাম নেওয়া হচ্ছে অনেক বেশি। এখানে কাস্টমস ও ভোক্তা অধিকারের অভিযান চালানো উচিত।

প্রতিদিন সন্ধ্যা হতে না হতেই মানুষজন ছোটেন মেলা মাঠের দিকে। বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা হাজার হাজার মোটরসাইকেল রাখার জন্য করা হয়েছে গ্যারেজ। দীর্ঘদিন ধরে মেলার নামে এমন র্যাফেল ড্রর কার্যক্রমে ক্ষুব্ধ সচেতন নাগরিক সমাজ।
বদরগঞ্জের হোটেল ব্যবসায়ী আহমেদুল বলেন, মেলা শুরুর পর থেকে বদরগঞ্জের ব্যবসায়ীরা ভালো ব্যবসা করতে পারছেন না। বিভিন্ন গ্রামে ছোট ছোট চুরির ঘটনাও ঘটছে।
বদরগঞ্জ মডেল মসজিদের ইমাম মহিউদ্দিন তৌহিদ বলেন, আমরা ওলামায়ে কেরামের পক্ষে আন্দোলন করেছি, প্রশাসনের পক্ষ থেকে অশ্বস্থ করা হয়েছে, মেলায় এসব চলবে না। তারাও কথা রাখেনি। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দও কথা রাখেনি। অনেককে হুমকি দেওয়া হয়েছে। সে কারণে আর এটা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।

বদরগঞ্জ পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট গোলাম রসুল বকুল বলেন, এটি নিঃসন্দেহে সামাজিক অবক্ষয়। মেলার নামে র্যাফেল ড্র বন্ধে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে উকিল নোটিশ পাঠানো হয়েছে। এরপরেও যদি বন্ধ না হয় তবে, আরও আন্দোলন করা হবে।
মেলার পরিচালক বেলাল হোসেন বলেন, আমাদেরকে মেলার অনুমোদন দিয়েছে সেনাবাহিনী। মেলায় যা যা দেখছেন সব কিছুর অনুমোদন আছে।
আরও পড়ুন
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন রংপুর মহানগর কমিটির সভাপতি খন্দকার ফখরুল আনাম বেঞ্জু বলেন, কোনো ধরনের ঝুঁকি না থাকলে জেলা প্রশাসন পুলিশ ক্লিয়ারেন্সের মাধ্যমে মেলার অনুমোদন দিয়ে থাকে স্থানীয় উদ্যোক্তা ও ব্যবসা বাণিজ্যের সম্প্রসারণের জন্য। কিন্তু শিল্প ও বাণিজ্যের কথা বলে চরিত্র হননের মতো জুয়া ও অন্যান্য কার্যক্রম পরিচালিত হয় সেক্ষেত্রে একদিকে নৈতিক অবক্ষয়, সামাজিক অবক্ষয় ও ঝুঁকি বেড়ে যায়। এতে চুরি বেড়ে যাবে, ছিনতাই বেড়ে যাবে, যার প্রভাব পড়বে সমাজ ও পরিবারে। আমি মনে করি সেনাবাহিনীর ম্যাজিষ্ট্রেসি ক্ষমতা আছে, অভিযান চালিয়ে এসব বন্ধ করা।
রংপুর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রবিউল ফয়সাল বলেন, এই মেলার অনুমোদন আমরা দিইনি। সব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যেখানেই অবৈধ কার্যক্রম হবে সেখানেই ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে ব্যবস্থা নিতে। আমরা সেটাই করছি।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/রংপুর