একটি ইউনিয়নে জেলা পরিষদ থেকে ৩৫ লাখ টাকা বরাদ্দ, তদন্তে দুদক

ময়মনসিংহ জেলা পরিষদ থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের রাজস্ব বাজেটের ঐচ্ছিক কার্যাবলীর আওতায় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নামে গৃহীত প্রকল্পে সরকারি বরাদ্দের অর্থ নয়ছয় করার ঘটনা ঘটেছে। সম্প্রতি ঘটনাটি ফাঁস হওয়ায় উত্থাপিত অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখতে তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের ভেতরে-বাইরে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে।
সূত্র জানায়, ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে রাজস্ব বাজেটের ঐচ্ছিক কার্যাবলীর ‘জনস্বাস্থ্য’ উপখাতে ৪৭টি প্রকল্পে ৮৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ হয়। এতে জেলার ১৩টি উপজেলার মধ্যে শুধুমাত্র সদর উপজেলার ভাবখালী ইউনিয়নেই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, এতিমখানা ও কবরস্থানের নেওয়া হয় ৩৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ১৭টি প্রকল্প। এছাড়া ‘সমাজকল্যাণ’ উপখাতে নেওয়া ৫টি প্রকল্পে ৩ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়।
প্রশ্ন উঠেছে, একটি ইউনিয়নে জেলা পরিষদ থেকে এতো বরাদ্দ কীভাবে গেল। এ প্রশ্নের নেপথ্যে রয়েছে মো. আইনুল হক। তিনি নিজেই দুটি মাদরাসার নামে এবং একটি পারিবারিক কবরস্থানের নামে ৭ লাখ টাকা বরাদ্দ নিয়েছেন। আইনুল হক জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকার দাবি করেন এবং নিজেকে রুকন প্রার্থী হিসেবেও দাবি করেন। এর সত্যতা মিলেছে জামায়াতের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিজের উপস্থিতির ভিডিও আইনুল হকের ফেসবুকে শেয়ারে। তিনি ভাবখালী গ্রামের প্রয়াত আবদুল আজিজের ছেলে।
তবে আইনুল হক জামায়াতে ইসলামীর কর্মীও নন, বলে জানিয়েছেন দলটির সুতিয়াখালী সাংগঠনিক থানার সেক্রেটারি আনিসুর রহমান। তিনি বলেন, আইনুল হকের বড় ভাই জামায়াতের রুকন। আইনুল জামায়াতের পরিচয় দিয়ে সরকারি বরাদ্দ নেওয়ার বিষয়টি আমরা জেনেছি। সে (আইনুল) যে আমাদের কেউ নয় সেটি যেখানে যেখানে বলা দরকার, আমরা সেখানে বলে দিয়েছি।
প্রকল্প সূত্র জানায়, জেলা পরিষদের বরাদ্দ তালিকার ২৩ নম্বর অনুযায়ী জামিয়া আবদুল আজিজ নূরে জান্নাত মহিলা মাদরাসা ও এতিমখানা উন্নয়ন প্রকল্পের নামে ৩ লাখ, ৫৭ নম্বর প্রকল্পে মাদরাসাতুল আজিজ নূরানীয়া হাফিজিয়া কওমিয়্যাহ মাদরাসার উন্নয়নের নামে ২ লাখ এবং ২৯ নম্বর প্রকল্পে মরহুম আবদুল আজিজ মন্ডল সাহেবের বাড়ি সংলগ্ন সামাজিক গোরস্থান উন্নয়নের নামে ২ লাখ টাকা বরাদ্দ পেয়েছেন আইনুল হক।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়- বাড়ির আঙিনায় আধাপাকা একটি টিনসেট ঘরে আবদুল আজিজ নূরে জান্নাত মহিলা মাদরাসা পরিচালিত হয়, তবে সেখানে বর্তমানে সংস্কার কাজ চলছে। আর বাড়ির পাশে যে কবরস্থানটিকে সামাজিক কবরস্থান দেখানো হয়েছে, সেখানে মূলত আইনুল হকের বাবা এবং পরিবারের এক নারী সদস্যের কবর রয়েছে। যা তাদের পারিবারিক কবরস্থান।
অভিযোগ উঠেছে, বরাদ্দপত্রের ৪৫ নম্বরে থাকা ভাবখালী জামিয়া হাজেরা মহিলা মাদরাসা নামে ২ লাখ টাকা বরাদ্দ হয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের পরিচালক সোলাইমান হুসাইন জানান, তিনি বরাদ্দের জন্য কোনো আবেদন করেননি। কিন্তু বরাদ্দের প্রথম কিস্তি উঠে গেছে। আর এই বরাদ্দ নিয়ে গেছে, একই ইউনিয়নের চুরখাই বাজার সংলগ্ন জামিয়া হাজেরা কওমী মহিলা মাদরাসা। এই মাদরাসাটি পরিচালনা করেন নজরুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি। তার ওই মাদরাসার দেয়ালে রং দিয়ে জামিয়া হাজেরা কওমী মহিলা মাদরাসা লেখা থাকলেও ছাদের ওপরে প্যানায় নতুন করে একটি বোর্ড সাঁটানো হয়, যেখানে নাম দেওয়া হয় জামিয়া হাজেরা মহিলা মাদরাসা। এ ঘটনায় জামিয়া হাজেরা মহিলা মাদরাসার সভাপতি মো. ইসমাইল হুসেন গত ১৪ আগস্ট জেলা পরিষদের প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন।
সূত্র জানায়, জামিয়া হাজেরা কওমী মহিলা মাদরাসা পরিচালক নজরুল ইসলামের পরিচালনায় জামিয়া হাজী শমসের আলী মহিলা মাদরাসা নামে আরও একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। জেলা পরিষদের বরাদ্দপত্রে থাকা ৪৪ নম্বরের মাদরাসা এটি। এতেও ২ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আমি নিজেই দুটি আবেদন করে বরাদ্দ পেয়েছি। এতে কোনো অনিয়ম নেই। কারণ সব মাদরাসাই কওমী, এটা লেখার কিছু নেই।
ভাবখালী গ্রামের সমর বেপারী বাড়ি এলাকায় রাবেয়া বসরী মহিলা কওমী মাদরাসা ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এতে শিশু থেকে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের নিয়মিত পড়ানো হয়। তবে জেলা পরিষদের বরাদ্দের ৪৩ নম্বরে এই মাদরাসার নাম থেকে ‘কওমী’ বাদ দিয়ে ২ লাখ টাকা বরাদ্দ নেওয়া হয়। বাস্তবে এই নামে কোনো মাদরাসা ভাবখালী ইউনিয়নে নেই। মূলত রাবেয়া বসরী মহিলা কওমী মাদরাসাকেই রাবেয়া বসরী মহিলা মাদরাসা দেখিয়ে বরাদ্দ নেওয়া হয়, তবে বিষয়টি জানতেন না পরিচালক মাওলানা এনামুল হক।
তিনি বলেন, বরাদ্দের বিষয়ে আমি জানতাম না, আইনুল হক আমাকে জানিয়েছে মাদরাসার নামে বরাদ্দ এসেছে। পরে আইনুল হক আমাকে জানায় খরচ বাদে আমি ৯০ হাজার টাকা পাব। ওই অবস্থায় অফিসে (জেলা পরিষদ) গিয়ে জানতে পারি ২ লাখ টাকা বরাদ্দ হয়েছে। পরে আমরা নিজেরাই আবেদন করে এসেছি, তবে এখনও টাকা পাইনি।
একই অবস্থা বরাদ্দপত্রে থাকা ৬০ নম্বরে সায়্যিদাতুন নিসা ফাতেমা রা. মহিলা মাদরাসা, ৫৬ নম্বরে ভাবখালী ইউনিয়নের চুরখাই মধ্যপাড়ায় জামিয়া ইসলামিয়া মহিলা কওমী মহিলা মাদরাসার। এসব প্রতিষ্ঠানের নামেও ২ লাখ করে টাকা বরাদ্দ হয়েছে। এর মধ্যে সায়্যিদাতুন নিসা ফাতেমা রা. মহিলা মাদরাসা পরিচালক মাওলানা আবদুল বলেন, মাদরাসার নামে বরাদ্দের কথা জানতে পেরে জেলা পরিষদে গিয়ে আমরা আবেদন করে এসেছি। বরাদ্দের জন্য আগে কে আবেদন করেছিল তা জানিনা।
তবে জামিয়া ইসলামিয়া মহিলা কওমী মহিলা মাদরাসার পরিচালক মুফতী এনামুল হাসান বলেন, আইনুল ভাই আমার কাছে এসে জানায় অনুদান এসেছে। এর কিছুদিন পর জানতে পারি আমার মাদরাসার নামে বরাদ্দ হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রথম কিস্তির ৮৫ হাজার ৫০০ টাকা আমি ব্যাংক হিসাবে পেয়েছি।
ভাবখালী ইউনিয়নের চুরখাই তিনরাস্তার মোড় এলাকায় আহছানুল উলূম নূরানী ও হাফিজিয়া মাদরাসায় ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে ৩ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয় জেলা পরিষদ। ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের বরাদ্দপত্রের ৪২ নম্বরে একই প্রতিষ্ঠান আবারও ২ লাখ টাকা বরাদ্দ পেয়েছে। কিন্তু বরাদ্দের জন্য তারা কোনো আবেদন করেননি।
মাদরাসার পরিচালক মাওলানা আশরাফুল আনোয়ার বলেন, লোকজনের মাধ্যমে খবর পাই আমাদের মাদরাসার নামেও বরাদ্দ হয়েছে। এরপর জানতে পারি আমাদের মাদরাসার পক্ষ হয়ে আবেদন করেছিলেন আইনুল হক। তিনি বলেছেন আমরা বরাদ্দের এক তৃতীয়াংশ টাকা পাব না। এটি অফিস বাবদ খরচ হবে।
তবে এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আইনুল হক বলেন, মূলত কিছু মাজারপূজারী আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করেছে। তারা আমার নামে ট্যাগ লাগানোর জন্য অপপ্রচার করছে। আর আমার নিজের মাদরাসায় ছেলেদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় একটি পৃথক শাখার কাজ চলছে। মূলত ওই শাখার জন্য সরকারি বরাদ্দের আবেদন করে বরাদ্দ পেয়েছি। এতে কোনো অনিয়ম নেই।
জানতে চাইলে ময়মনসিংহ জেলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কবির হোসেন সরদার বলেন, বিভিন্ন উপজেলা থেকে আসা আবেদন থেকে প্রকল্পগুলো নেওয়া হয়। এতে ইউএনওসহ অনেকের সুপারিশ থাকে। তবে এবারের বরাদ্দে কিছু গড়মিল দেখা গেছে, সেটি আমরা তদন্ত করবো। যদি অনিয়ম পাওয়া যায় তাহলে প্রকল্প বন্ধ করে দেওয়া হবে। সেই সঙ্গে এ ধরনের ভুল যেন আর না হয়, সেটি দেখবো। আর আইনুল হকের সঙ্গে আমার কোনো সখ্যতা নেই, তবে একদিন আইনুল হকের সঙ্গে গাড়িতে তার মাদরাসা পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। এখন সেটি ভিন্নভাবে প্রচারের চেষ্টা হচ্ছে।
তবে অভিযোগগুলো তদন্ত করে দেখার আশ্বাস দিয়েছেন জেলা পরিষদের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রশাসক ও অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার তাহমিনা আক্তার। তিনি বলেন, অভিযোগগুলো আমাদের নজরে এসেছে, লিখিত অভিযোগও পাওয়া গেছে। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হবে।
এদিকে জেলা পরিষদের এসব প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগ তদন্তে ইতোমধ্যে অভিযান চালিয়েছে দুদকের ময়মনসিংহ জেলা কার্যালয়ের চার সদস্যের একটি দল। এ সময় তারা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছ থেকে প্রকল্পের বিভিন্ন নথি সংগ্রহ ও যাচাই-বাছাই করে তদন্ত দল।
এ বিষয়ে দুদক ময়মনসিংহ জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক বুলু মিয়া বলেন, নথিপত্র যাচাই-বাছাই ও সরেজমিন তদন্ত করে কমিশনে প্রতিবেদন পাঠানোর কাজ প্রক্রিয়াধীন। এরপর কমিশনের সিদ্ধান্তে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তবে ইতোমধ্যে অভিযোগগুলোর প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে।
আমান উল্লাহ আকন্দ/এমএএস