ঠাকুরগাঁওয়ে এক ব্যক্তি নিজের পরিবার ছাড়া কারও সঙ্গে কথা বলতে পারবেন না

পরকীয়ার ঘটনায় ঠাকুরগাঁওয়ে চল্লিশ বছর বয়সী মতিয়ার রহমান নামে এক ব্যক্তিকে গ্রাম্য সালিশের মাধ্যমে এক ঘরে রাখার অভিযোগ উঠেছে। ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায়। এ নিয়ে নেটিজনরা আলোচনা-সমালোচনার ঝড় তোলেন।
মঙ্গলবার (৭ অক্টোবর) দুপুরের সদর উপজেলা ভুল্লী থানাধীন বালিয়া ইউনিয়নের সিঙ্গিয়া এলাকার হাজীপাড়া গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। ভুক্তভোগী মতিয়ার রহমান ওই এলাকার বাসিন্দা। তিনি পেশায় একজন কৃষক বলে জানা গেছে।
এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, গত ২৫ সেপ্টেম্বর ওই ইউনিয়নের সিঙ্গিয়া এলাকার হাজীপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মতিয়ার রহমানের সঙ্গে প্রতিবেশী এক নারীর পরকীয়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় ওই নারীর স্বামী মতিয়ার রহমানকে আটক করে স্থানীয় বাসিন্দাদের খবর দেন। পরে তারা মতিয়ারকে গণধোলাই দিয়ে ছেড়ে দেন।
ঘটনার ১৩ দিন পর মঙ্গলবার দুপুরে স্থানীয় বাসিন্দারা মতিয়ার রহমানের পরকীয়ার ঘটনাটি নিয়ে গ্রাম্য সালিশে বসেন। মাতব্বররা মতিয়ারকে সমাজ থেকে প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা দেন এবং এলাকার কোনো মানুষ তার সঙ্গে সামাজিক সম্পর্ক ও যোগাযোগ রাখতে পারবে না বলে জানিয়ে দেন।
আরও পড়ুন
ঘটনার বিবরণ দিয়ে ওই ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য মো. তৈয়বর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, কিছু দিন আগে একটা ঘটনা ঘটে আমাদের এলাকায়। মতিয়ারের স্ত্রী-সন্তান রয়েছে। পাশের বাড়ির ভাতিজ বউমার সঙ্গে কিছুদিন ধরে পরকীয়ায় জড়িত ছিলেন। ওই নারীর স্বামী বিষয়টি সন্দেহ করে তাদের ধরে ফেলেন। পরে ওই নারী তার বাবার বাড়িতে চলে যায় আর তার স্বামী মতিয়ারকে মারধর করেন। পরবর্তীতে সালিশি বৈঠকে মতিয়ার যে ওই নারীকে বিয়ে করেছেন তার কাগজ দেখান।
তিনি আরও বলেন, সালিশি বৈঠকে মতিয়ারকে একঘরে করে রাখার কথা বলা হয়েছে। সমাজের লোকজনের সঙ্গে তিনি কথা বলতে পারবেন না। শুধু পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন। এই বিচার করেছে এলাকার লোকজন। তবে কিছু দিন পর সব ঠিক হয়ে যাবে।
এ ঘটনায় নেটিজনরা মন্তব্য করে লেখেন, বিচারের নামে প্রহসন। যারা এই সালিশি বৈঠকে রায় দিয়েছেন তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হোক। কেউ অপরাধ করলে তার জন্য আইন-আদালত আছে। গ্রাম্য সালিশের মাধ্যমে একজনকে ঘরবন্ধি করা বেআইনি। যারা এই জঘন্য কাজটা করেছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রশাসনকে অনুরোধ জানান তারা।
ঠাকুরগাঁও কেন্দ্রীয় মসজিদের ইমাম মাওলানা খলিলুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের দেশে ইসলামিক আইন ও দেশের আইন দুইটার একটাও মানা হয় না। তবে কেউ যদি অন্যায় করে তাহলে সামাজিকভাবে বসে সমস্যার সমাধান করতে হবে। না হলে দেশের প্রচলিত আইনে তাকে শাস্তির আওয়াতায় আনতে হবে। তবে কোনো ব্যক্তিকে শাস্তি দেওয়ার বিধান আমাদের নেই। যে যত বড় অপরাধই করুক না কেন তার জন্য আইন-আদালত রয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন রয়েছে, জনপ্রতিনিধি রয়েছে। কিন্তু কাউকে এক ঘরে করে রাখা বা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) ঠাকুরগাঁওয়ের সাধারণ সম্পাদক মো. আব্দুল লতিফ ঢাকা পোস্টকে বলেন, মতিয়ার রহমানের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ, সেটা তদন্ত করবে প্রশাসন। তবে সমাজের কয়েকজন ব্যক্তি তার বিরুদ্ধে যে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে, অর্থাৎ তাকে যে এক ঘরে করেছে—এটা সম্পূর্ণ আইন পরিপন্থি।
তিন আরও বলেন, এটাও একটা ফৌজদারি অপরাধ। সে অপরাধ করলে আইন তাকে শাস্তি দেবে কিন্তু এক ঘরে করা জঘন্য নিয়ম। এটা মেনে নেওয়া যায় না। আমার মতে যারা তাকে এক ঘরে করার ঘোষণা দিয়েছেন তাদেরকেও আইনের আওয়াতায় আনার দরকার।
এ বিষয়ে বালিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জুলফিকার আলী ভুট্টো ঢাকা পোস্টকে বলেন, সম্পর্কে ভাতিজার স্ত্রীর সঙ্গে মতিয়ার পরকীয়া করেছেন এবং ওই নারী তার স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে মতিয়ারকে বিয়েও করেছে। আমি যতটুকু জানি আজ একটা বৈঠিকে তাকে সমাজের লোকজনের সঙ্গে না চলার জন্য বলা হয়েছে। তাকে তার বাড়িতেই থাকতে বলা হয়েছে। যেহেতু সে একটা ঘৃণিত কাজ করেছে।
এ ব্যাপারে ঠাকুরগাঁও জেলা ও দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মো. শফিকুল ইসলাম শিশমুল ঢাকা পোস্টকে বলেন, এক ব্যক্তিকে এক ঘরে করে রাখা এটা সম্পূর্ণ অবৈধ। ওখানে কোনো সমস্যা হলে পারিবারিক আদালত রয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রয়েছে। তিনি সেটা মীমাংসা করার ব্যবস্থা করবেন। আর চেয়ারম্যানও যদি সেটা মিমাংসা করতে না পারে সে জন্য সিনিয়র সহকারী জজ পদমর্যাদার লিগাল এইড অফিসার রয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, গ্রাম্য সালিশে কেউ কাউকে এক ঘরে করে রাখার অধিকার রাখে না। এটা অমানবিক ও আইনের চোখে অপরাধ। আর যারা এটা করছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারবে ভুক্তভোগীরা।
এ বিষয়ে ভুল্লী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাইফুল ইসলাম সরকার ঢাকা পোস্টকে জানান, এ বিষয়টি তিনি জানেন না। কেউ থানায় অভিযোগ দিলে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।
তবে ঠাকুরগাঁও পুলিশ সুপার শেখ জাহিদুল ইসলাম ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) আলী মোহাম্মদ আব্দুল্লাহের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এ ব্যাপারে ঠাকুরগাঁও জেলা লিগাল এইড অফিসার ও সিনিয়র সহকারী জজ মো. মজনু মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, ওই ব্যক্তি যদি পরকীয়া করে থাকেন তাহলে তার জন্য আইন-আদালত রয়েছে। কিন্তু এক ঘরে করে রাখার কোনো সুযোগ নাই। আর যারা সালিশের মাধ্যমে বিচার করে এক ঘরে করে রাখে বা নির্যাতন করে এগুলোকে আইন কোনোভাবেই সাপোর্ট করে না।
তিনি আরও বলেন, বিষয়টি সংশ্লিষ্ট থানাকে অবগত করে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
রেদওয়ান মিলন/এএমকে