বেলুয়া নদীর ভাসমান হাট, নদীকেন্দ্রিক জনপদের অর্থনীতির চালিকা

ভোরের আলো যখন বেলুয়া নদীর শান্ত জলে ছড়িয়ে পড়ে, তখনই নীরবতা ভেঙে ভেসে আসে শতাধিক নৌকার ডাক। কেউ আনছে শাকসবজি, কেউ চালডাল, কেউবা মাছ, হাঁস-মুরগি। নদীর বুকে যেন বেজে ওঠে এক অপূর্ব সংগীত। মাঝির বৈঠার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ, ট্রলারের ইঞ্জিনের চিৎকার, ক্রেতা-বিক্রেতার হাঁকডাক আর ঢেউয়ের তালে জেগে ওঠে জনপদ।
পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর উপজেলার বেলুয়া নদীর বৈঠাকাটা ভাসমান হাটের স্বাভাবিক চিত্র এমন। বৈঠাকাটাকে বিবেচনা করা হয় দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় নদীভিত্তিক হাট।
সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে এই অঞ্চলের মানুষের অর্থনীতি, কর্মসংস্থান আর বাজার ব্যবস্থায় প্রধান মাধ্যম এই হাট। ফলে বেলুয়া নদী শুধু নৌকা বয়ে আনছে না, নিয়ে আসছে নানান মানুষের জীবনের গল্প। চাষি, ব্যবসায়ী, মাঝি, খেটে খাওয়া মানুষের সংস্থান নির্ভর করে এই বহমান স্রোতেই। প্রতি শনিবার ও মঙ্গলবার সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে এই নদী বদলে যায় এক প্রাণচঞ্চল বাজারে। হাটবারে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় বেচাকেনা। বর্ষায় সকাল সাড়ে ৮টা পর্যন্ত, আর শীতে বেলা ১০টা পর্যন্ত চলে লেনদেন।
পিরোজপুর সদর থেকে প্রায় ৪৩ কিলোমিটার উত্তরে এবং নাজিরপুর উপজেলা থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বৈঠাকাটা হাটে পৌঁছাতে হয় নৌকায়। কারণ, নাজিরপুরের এ অঞ্চলটি মূলত বিলাঞ্চল, সড়কপথের চেয়ে নৌপথই এখানে বেশি সহজলভ্য।

ভাসমান হাটে স্থানীয় প্রয়োজনীয় প্রায় সবকিছুই পাওয়া যায়। শাকসবজি, চালডাল, মাছ-মাংস, গাছের চারা, শ্যাওলা, হাঁস-মুরগি থেকে শুরু করে ভাসমান নৌকায় নাশতার দোকান পর্যন্ত। পিরোজপুর ছাড়াও বরিশাল, ঝালকাঠি, গোপালগঞ্জ, বাগেরহাট ও শরীয়তপুর জেলা থেকেও ব্যবসায়ীরা এখানে আসেন।
গোপালগঞ্জ থেকে আসা পাইকার ব্যবসায়ী আজিজুল হক বলেন, আমার বাবা এই হাটের চালের পাইকার ছিলেন। এখন আমি সেই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছি। এখানে পাইকারি মাল ভালো পাওয়া যায়, খুচরাও বিক্রি হয়। এখান থেকে কিনে সরাসরি নৌকায় করে অন্য বাজারে যাই, এতে বাড়তি খরচ হয় না।
বৈঠাকাটা ভাসমান হাটকে ঘিরে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কয়েক লাখ মানুষ জীবিকা নির্বাহ করেন। কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ফসল সরাসরি এনে বিক্রি করেন, ফলে মধ্যস্বত্বভোগীর সংখ্যা কম এবং কৃষক পান ন্যায্য দাম। প্রতিদিন কোটি টাকার লেনদেন হয় এই হাটে।
আরও পড়ুন
ষাটোর্ধ্ব কৃষক আব্দুল মজিদ বলেন, কৃষক, আড়তদার, নৌকার মাঝি, দিনমজুর সবাই এই হাটের সঙ্গে যুক্ত। আমি যেমন বিক্রি করতে আসি, অনেকে কিনতেও আসে। প্রতিদিন কোটি টাকার লেনদেন হয়।
দুই বছর আগেও বৈঠাকাটায় ঢাকা থেকে লঞ্চ সার্ভিস চালু ছিল বলে জানা গেছে। পদ্মা সেতু চালুর পর যাত্রী সংকটে তা বন্ধ হয়ে যায়। এতে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের ব্যয় বেড়েছে। ব্যবসায়ী শাহ আলম মুন্সী বলেন, লঞ্চ সার্ভিস চালু থাকলে আমাদের পণ্য সহজে ঢাকায় পাঠানো যেত। এখন তা বন্ধ, ফলে ব্যবসা ব্যাহত হচ্ছে। এ ছাড়া, নৌ ফায়ার স্টেশনের অভাবও বড় সমস্যা।
ব্যবসায়ী আব্দুর রব বলেন, অগ্নিকাণ্ড বা দুর্ঘটনা হলে উদ্ধার কাজ কঠিন হয়। তাই একটি নদী ফায়ার স্টেশন স্থাপন খুবই জরুরি।
নাজিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাজিয়া শাজনাজ তমা বলেন, বৈঠাকাটা ভাসমান হাটটি এ অঞ্চলের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর উন্নয়নে আমরা বেশ কিছু পরিকল্পনা নিয়েছি, ধীরে ধীরে তা বাস্তবায়ন করা হবে।
বৈঠাকাটা ভাসমান হাট শুধু একটি বাজার নয়, এটি নদীভিত্তিক দক্ষিণাঞ্চলের জীবনযাত্রা ও অর্থনীতির প্রতিচ্ছবি। নৌকাভিত্তিক এই হাট গ্রামীণ অর্থনীতিকে সচল রাখার পাশাপাশি স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যেরও ধারক।
এএমকে