ক্ষেতলালে ইউনিয়ন পরিষদের সুবিধাভোগীর তালিকায় লাখপতিরা

স্বপ্না খাতুনের ইটের বাড়ি, স্বামী চালান ইজিবাইক, গোয়ালে লাখ টাকারও বেশি দামের গরু আছে। মাঠে জমিও আছে, নিজের জমিতে চাষ করা ধানের ভাত খান। সব মিলিয়ে স্বপ্না খাতুনের সংসার বেশ স্বচ্ছল। সংসারে অভাব নেই, তবুও মাসে মাসে সরকারি চাল তোলেন তিনি। কারণ, তার নাম উঠেছে ভিডব্লিউবি (ভালনারেবল উইমেন বেনিফিট) সুবিধাভোগীর তালিকায়।
অন্যদিকে, স্বপ্নার বাড়ি থেকে মাত্র কয়েক গজ দূরে ভাঙাচোরা মাটির ঘরে থাকেন হালিমা খাতুন। স্বামী জাহিদুল ইসলাম দিনমজুর। সহায়-সম্পদ বলতে তাদের কিছুই নেই। তিন বেলা খাবার জোটাতে কষ্ট হয় তাদের। অথচ সরকারি এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত তিনি।
শুধু স্বপ্না খাতুন একা নন তার মতো অনেকেই স্বচ্ছল পরিবার হলেও ভিডব্লিউবি সুবিধাভোগীর তালিকায় রয়েছে তাদের নাম। আর তারা বিনামূল্যে প্রতি মাসে ৩০ কেজি চাল পাচ্ছেন। স্বচ্ছল পরিবারের যারা সুবিধাভোগী তারা সবাই ইউপি সদস্যের আত্মীয়-স্বজন।
এমন ঘটনা ঘটেছে জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলার বড়তারা ইউনিয়ন পরিষদের পাঁচ নম্বর ওর্য়াডে বড়তারা গ্রামে। অভিযোগ আছে, বড়তারা ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান ও সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের সদস্যদের স্বজনপ্রীতির পাশাপাশি ঘুষ নিয়ে স্বচ্ছল নারীদের সুবিধাভোগীর তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এতে প্রকৃত দুস্থ নারীরা বাদ পড়েছেন। উপজেলা প্রশাসন ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রকাশ্যে যাচাই-বাছাই করে ভিডব্লিউবির উপকারভোগী নির্বাচন করেছিল। এখন এ তালিকায় স্বচ্ছল ব্যক্তি ও ইউপি সদস্যের স্বজনদের নাম থাকায় প্রশাসনের প্রকাশ্যে যাচাই-বাছাই ব্যতিক্রমী উদ্যোগ প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয় ও বড়তারা ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, উপজেলার বড়তারা ইউনিয়নে ২০২৫-২৬ অর্থ বছরে ভিডব্লিউবি কর্মসূচির আওতায় ইউনিয়নের প্রায় ১০২৭ জন নারী আবেদন করেছিলেন। উপজেলা প্রশাসন থেকে এখানে তিন কর্মকর্তাকে সুবিধাভোগী যাচাই-বাছাইয়ের জন্য নিয়োগ করা হয়। তারা ইউনিয়ন পরিষদে প্রকাশ্যে যাচাই-বাছাই শেষে ৪৪০ জন সুবিধাভোগীকে নির্বাচন করেন। এরমধ্যে পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডে ৫৩ জন নারী সুবিধাভোগীর তালিকায় আছেন। প্রতিমাসেই ৩০ কেজি করে বিনামূল্যের চাল পাচ্ছেন তারা। গত ২৯ সেপ্টেম্বর সুবিধাভোগীদের চাল বিতরণ করা হয়। এরপর সুবিধাভোগীর তালিকায় স্বচ্ছল পরিবারের সদস্য ও ইউপি সদস্য শফিকুল ইসলামের আত্বীয় স্বজনের নাম থাকার বিষয়টি জানাজানি হয়। এ ঘটনাটি মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার দপ্তর তদন্ত করছে। ইতিমধ্যে মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয় ঘটনার সত্যতাও পেয়েছে।
ওই ওয়ার্ডের সুবিধাভোগীর তালিকার ১৯১ নম্বরে নাম আছে রাজিয়া সুলতানা, ২০৬ নম্বরে হাবিবা খাতুন, ২০৯ নম্বরে স্বপ্না খাতুন, ২১০ নম্বরে খোতেজা বিবি, ২১৬ নম্বরে আলেয়া বেগম, ২১৭ নম্বরে আমেনা বিবি, ২২৪ নম্বরে মোছা. ফারহানা আক্তার, ২৩০ নম্বরে মোছা. সেলিনা বেগমের। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের সুবিধাভোগীদের বেশিরভাগ স্বচ্ছল পরিবার। তারা ওই ওয়ার্ডের মেম্বার শফিকুল ইসলামের আত্নীয় স্বজন ও প্রতিবেশী। রাজিয়া সুলতানা মেম্বার শফিকুল ইসলামের চাচাতো ভাই মোস্তাফিজুর রহমানের স্ত্রী। হাবিবা খাতুনের ফ্ল্যাট বাড়ি আছে। তার স্বামী রায়হান কবির মৎস্যচাষী, মোটরসাইকেল, ধান মাড়াইয়ের যন্ত্র, ভটভটি আছে। জমাজমিও আছে, স্বচ্ছল পরিবার। সর্ম্পকে ইউপি সদস্যের আত্নীয় হন। স্বপ্না খাতুনের ইটের বাড়ি আছে। তার স্বামী আব্দুল মতিন ইজিবাইক চালান। গোয়াল ঘরে আছে লাখ টাকাও বেশি দামের গরু। স্বচ্ছল পরিবার। ইউপি সদস্যের আত্নীয়। খোতেজা বিবির স্বামী হেলাল ইলেকট্রনিক্সের দোকান ও অটোভ্যানের ব্যবসা আছে। তিনিও ইউপি সদস্যের আত্নীয়। আলেয়া বেগমের ইটের বাড়ি আছে। তার স্বামী ইদ্রীস আলী কাঠমিস্ত্রি। ফসলি জমি আবাদ করেন। তিনি ইউপি সদস্য শফিকুলের আপন চাচী। আমেনা বিবি। তার স্বামী নাসির উদ্দিন কৃষক। নিজস্ব জমিজমা আছে। তিনি ইউপি সদস্য শফিকুল ইসলামের চাচী। সেলিনা খাতুনের পাকা বাড়ি আছে। তারা স্বচ্ছল পরিবার। তিনি ইউপি সদস্য শফিকুলের ভাইয়ের স্ত্রী।
আরও পড়ুন
ওই গ্রামের সুবিধাবঞ্চিত কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইউপি সদস্য শফিকুল ইসলাম তার আত্বীয় স্বজন ও স্বচ্ছল পরিবারের সদস্যদের সুবিধাভোগীর তালিকায় নাম দিয়েছেন। এছাড়া যারা টাকা দিতে পেরেছেন তাদের নাম দিয়েছেন। এ কাজে প্যানেল চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম ও মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজোশ রয়েছে। পুরো ইউনিয়নেই ভিডব্লিউবি সুবিধাভোগী নির্বাচনে টাকার খেলা হয়েছে। অথচ উপজেলা প্রশাসন লোক দেখানো প্রকাশ্যে যাচাই-বাছাইয়ের আয়োজন করেছিল।
বড়তারা মধ্যপাড়া গ্রামের বাসিন্দা হালিমা খাতুন বলেন, বড় লোকেরা ৩০ কেজি চাউলের কার্ড প্যাচে। মোর কিছু নাই, মোক কার্ড দ্যাইনি। লাইনত দাঁড়াওচিনু। মোক বাদ দিচে। সকিমা বিবি বলেন, গরীব মানুষের টাকাও নাই, কার্ডও নাই।
বড়তারা ইউপির পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য শফিকুল ইসলাম বলেন, এবার অনলাইনে আবেদন পড়েছিল। যাচাই-বাছাইয়ের জন্য একদিন সবাইকে ডাকা হয়েছিল। সেখানে উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয়ের লোকজন, ট্যাগ অফিসাররা যাচাই-বাছাই করে তালিকা করেছে। যাচাই-বাছাইয়ে কিছু ভুল থাকতে পারে। এখানে আমার কোন কোনো হাত নেই। আর টাকা-পয়সা লেনদেনের বিষয়টি আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ।
এ ব্যাপারে জানতে মঙ্গলবার (৭ অক্টোবর) বিকেল ৩টায় বড়তারা ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকা এক নম্বর প্যানেল চেয়ারম্যান নুরুল ইসলামকে পাওয়া যায়নি। পরে মুঠোফোনে কল করলে তিনি রিসিভ করেননি। এমনকি ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েও কোন উত্তর পাওয়া যায়নি।
উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা লায়লা নাসরিন জাহান বলেন, ইউপি সদস্য শফিকুল ইসলাম মিথ্যা তথ্য দিয়ে তার কয়েকজন স্বাবলম্বী আত্মীয়র নাম অন্তর্ভুক্ত করেছেন। আমরা ইতিমধ্যে তদন্ত করে ঘটনার সত্যতা পেয়েছি। সেই নামগুলো উপজেলা কমিটিতে উপস্থাপন করা হবে। উপজেলা কমিটি এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। আরও কয়েকটি ইউনিয়নেরও একই রকম অভিযোগ লোকজন বিভিন্ন দপ্তরে দিয়েছে।
ক্ষেতলাল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আসিফ আল জিনাত ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা শতভাগ স্বচ্ছ করার চেষ্টা করেছি। তবে কিছু ভুল আছে। আমরা এ বিষয়ে তদন্ত করে নীতিমালা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবো।
চম্পক কুমার/এআরবি