ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে ক্লাস নেওয়া শিক্ষক পাননি ভাতা, ভুগছেন অর্থসংকটে

বরগুনা সদর উপজেলার রায়েরতবক জেলখানা সোনাতলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন প্রধান শিক্ষক আলতাফ হোসেন অবসরে গেছেন তিন বছর আগে। শারীরিক অসুস্থতাজনিত কারণে এক প্রকার বাধ্য হয়ে নির্ধারিত সময়ের আগেই অবসরে যেতে হয়েছে তাকে। তবে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে অবসরকালীন প্রাপ্য ভাতা এখনও না পেয়ে সুচিকিৎসার অভাবেই দিন পার করছেন তিনি।
প্রতিদিন প্রায় ৩০০ টাকার ওষুধ এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা খরচ চালিয়ে পরিবারের ভরণপোষণ চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে একমাত্র ছেলে আল-আমীনের। আয়ের কোনো মাধ্যম না থাকায় বাধ্য হয়ে ছেলের ওপরই ভরসা করতে হচ্ছে নিবেদিত প্রাণ এই শিক্ষককে।
বরগুনা সদর উপজেলার বাঁশ বুনিয়া নামক এলাকার বাসিন্দা আলতাফ হোসেন ১৯৯৩ সালে প্রধান শিক্ষক হিসেবে রায়েরতবক জেলখানা সোনাতলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালে তিনি এমপিওভুক্ত হয়ে বিদ্যালয়ে নিয়মিত কর্মরত ছিলেন। এরপর শারীরিক অসুস্থতার কারণে ২০২২ সালে মে মাসের দিকে আলতাফ হোসেন স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন।
শিক্ষক আলতাফ হোসেন পারকিনসন্স রোগে আক্রান্ত হয়ে শারীরিক অসুস্থতার কারণে বর্তমানে স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারছেন না। এ ছাড়াও প্রায় সময় আবোলতাবোল কথা বলায় তার ছেলে মো. আল-আমীন বলেন, শারীরিক অসুস্থতার কারণে সেচ্ছায় অবসরের পর ২০২২ সালের শেষের দিকে অবসরকালীন ভাতা প্রায় ৩৫ লাখ টাকা প্রাপ্তির জন্য আবেদন করা হয়। নিয়ম অনুযায়ী শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট এবং বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ডে এ আবেদন করা হয়।

পরিবার, সহকর্মী ও শিক্ষার্থীদের কথা অনুযায়ী সুদীর্ঘ সময়ে তিনি শুধু বিদ্যালয়ের উন্নয়ন আর শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভেবেছেন। স্কুলের সব সহকর্মী-শিক্ষকদের প্রতিও ছিল তার সহযোগিতাপূর্ণ আচরণ। তবে দীর্ঘ বছর শিক্ষক পেশায় থেকে শিক্ষার্থীদের জীবন গড়তে এবং স্কুলের উন্নয়নে ভূমিকা রাখলেও নিজের জীবন ও পরিবারে জন্য তেমন কিছুই করতে পারেননি আলতাফ হোসেন। বর্তমানে শারীরিক অসুস্থতার কারণে তার অধিকাংশ সময় কাটছে বিছানায়।
আলতাফ হোসেনের সুদীর্ঘ শিক্ষক জীবন সম্পর্কে জানতে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা হয় রায়েরতবক জেলখানা সোনাতলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। তাদের দাবি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিজের স্বার্থ না ভেবে বিদ্যালয়ের অগ্রগতি নিয়েই কাজ করেছেন সাবেক প্রধান শিক্ষক আলতাফ হোসেন। আর এ কারণেই তারা আদর্শ শিক্ষক হিসেবে শ্রদ্ধাভরে এখনো স্মরণ করেন আলতাফ হোসেনকে।
রায়েরতবক জেলখানা সোনাতলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী সালমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি ২০১৪ সালে এসএসসি পাস করেছি। আলতাফ স্যার আমাদের প্রধান শিক্ষক এবং হিসাব বিজ্ঞানের ক্লাস নিতেন। আমরা যখন লেখাপড়া করেছি তখন দেখেছি আলতাফ স্যার কিছুটা অসুস্থ ছিলেন। এখনো আমার মনে পরে ঝড়, বৃষ্টি এবং শীত যাই হোক—শত অসুস্থতার মাঝেও তিনি নিয়মিত স্কুলে এসে ক্লাস নিতেন। তিনি কখনোই ক্লাস নেওয়া বন্ধ রাখেননি। একইসঙ্গে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করায় তিনি স্কুলের সব শিক্ষকদেরও সঠিকভাবে খোঁজখবর রাখতেন। স্যার এখন খুবই অসুস্থ। আমি শুধু বলতে চাই, যে শিক্ষকরা আমাদের দেশ ও মানুষ গড়ার কারিগর তারা যাতে কোনোভাবে অবহেলিত না থাকেন।

মো. হাফিজুল ইসলাম নামে আরেক সাবেক শিক্ষার্থী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা অষ্টম শ্রেণি থেকে আলতাফ স্যারের ক্লাস পেয়েছি। তিনি আমাদের যেমনি খোঁজ রাখতেন ঠিক তেমনি স্কুলের অন্য শিক্ষদের বিষয়েও নজর রাখতেন। তবে স্যার চাকরি থাকাকালীন সময়েই অসুস্থতার কারণে অবসরে যান। এখন তিনি খুবই অসুস্থ হয়ে বাড়িতেই আছেন। আমরা চাই আলতাফ স্যারসহ সব শিক্ষকদেরকেই সরকারিভাবে সঠিক মূল্যায়ন করা হোক।
সরেজমিনে আলতাফ হোসেনের বর্তমান অবস্থা জানতে বাঁশ বুনিয়া এলাকায় তার নিজ বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, টিনের তৈরি জীর্ণশীর্ণ একটি বাড়িতে স্ত্রী-সন্তান ও নাতিদের নিয়ে একত্রে বসবাস করছেন শিক্ষক আলতাফ হোসেন। একদিকে বয়সের ভার, অপরদিকে শারীরিক অসুস্থতায় এখন আর একা হেঁটে চলার শক্তি নেই তার। অধিকাংশ সময় পার হচ্ছে বিছানায় শুয়ে। এমনকি স্মৃতি শক্তিও কমতে শুরু করেছে তার, স্বাভাবিকভাবে কথাও বলতে পারছেন না। পারকিনসন্স আক্রান্ত হওয়ার প্রভাবে প্রায় সময়ই এখন আবোলতাবোল কথা বলেন তিনি। অন্যের সহযোগিতায় হাঁটতে চাইলেও অনবরত তার হাত-পা কাঁপছে। আয়ের কোনো মাধ্যম না থাকায় প্রতিদিন প্রায় ৩শ টাকার ওষুধ কিনতে একমাত্র ছেলের ওপরেই এখন ভরসা আলতাফ হোসেনের। অপরদিকে পরিবারের সব খরচ এবং বাবার সঙ্গে মায়েরও চিকিৎসা চালাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন ছেলে আল-আমীন।
সাবেক প্রধান শিক্ষক আলতাফ হোসেনের ছেলে মো. আল-আমীন বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে কর্মরত। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার বাবা রায়েরতবক জেলখানা সোনাতলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠাকালীন প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তার সময়ে কুঁড়েঘরের মতো স্কুল থাকলেও বাবা এবং অন্য শিক্ষকদের প্রচেষ্টায় এখন বহুতল ভবন হয়েছে। বাবা সবসময়ই আমাদের তুলনার তার স্কুলকেই পরিবার মনে করতেন। এমন অনেক সময় গেছে স্কুল বন্ধ, কিন্তু তারপরও তিনি স্কুলে গিয়ে কাজ করেছেন। এককথায় তার ধ্যানজ্ঞানই ছিল স্কুলটিকে কিভাবে উন্নয়ন করে এগিয়ে নেওয়া যায়। বাবার এমন কঠোর পরিশ্রমের কারণেই একসময় চাকরি চলাকালীন অবস্থাতেই তিনি আস্তে আস্তে অসুস্থ হতে শুরু করেন।
আরও পড়ুন
তিনি আরও বলেন, বাবার ইচ্ছা অনুযায়ী এখন ওই স্কুলে বহুতল ভবন নির্মাণ হয়েছে। কিন্তু আমাদের বাসাবাড়ির কোনো উন্নতি হয়নি। তার চাকরি জীবনে তিনি স্কুলের বাইরে বাড়তি আয়ের জন্যও কখনো কোনো চিন্তা করেননি। এককথায় স্কুল নিয়েই ছিল তার সমস্ত ধ্যানজ্ঞান। যিনি স্কুল এবং স্কুলের শিক্ষার্থীদের নিয়ে ভেবেছেন তিনি জীবদ্দশায় প্রাপ্য অবসরকালীন ভাতা পেয়েছেন তা দেখে যেতে পারবেন কিনা তা নিয়েই এখন আমাদের সন্দেহ তৈরি হয়েছে।
আলতাফ হোসেনের বর্তমান অবস্থার বিষয়ে তিনি বলেন, গত প্রায় পাঁচ বছর ধরে বাবা পারকিনসন্স রোগে আক্রান্ত। বর্তমানে তার শারীরিক অবস্থা মোটেও ভালো নেই। প্রতিমাসে চিকিৎসকের খরচ ছাড়ই শুধু ওষুধ খরচই হয় সাত থেকে আট হাজার টাকা। এখন তার শারীরিক অবস্থার যেভাবে অবনতি হচ্ছে তাতে কখন কি হয় তা বলা যায় না। তবে তিনি যদি তার প্রাপ্য অবসরকালীন ভাতাটাও একটু দ্রুত পায়, তাহলে অন্তত এই মুমূর্ষু সময়ে তার জীবন নির্বাহ এবং চিকিৎসার ব্যয় মিটাতে আমাদের পক্ষে অনেকটা সহজ হতো।
প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে নিজের স্বার্থ না ভেবে বিদ্যালয়ের অগ্রগতি নিয়েই কাজ করেছেন আলতাফ হোসেন। সহকর্মীরাও এখনো শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন আলতাফ হোসেনকে। এমনকি তাকে আদর্শ হিসেবেও মানেন অনেক সহকর্মীরা। ২০০০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১৮ বছর আলতাফ হোসেনের অধীনে একই স্কুলে শিক্ষাকতা করেছেন এফ এ জেড মামুন। বর্তমানে তিনি বরগুনা আদর্শ বালিকা উচ্চ বিদ্যালেয়র প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছেন।
সাবেক প্রধান শিক্ষক আলতাফ হোসেন প্রসঙ্গে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, একই স্কুলে চাকরির সুবাদে দীর্ঘ ১৮ বছর আলতাফ হোসেনকে আমি খুব কাছে থেকে দেখেছি। তার মতো দ্বিতীয় আরেকজন সৎ প্রধান শিক্ষক বরগুনায় আছেন বলে আমার মনে হয় না। আমি তার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তার মতো করেই চলার চেষ্টা করেছি। একটি নতুন স্কুলকে তৈরি করতে যে ধরনের অপরিসীম মেধা শ্রম এবং বিচক্ষণতার প্রয়োজন হয়, তা দিয়েই তিনি স্কুলটিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। এ ছাড়া, তিনি স্কুলের শিক্ষকদেরকে ভাইয়ের মতো মনে করে সবসময়ই বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করতেন। আমাদের যে কোনো সমস্যা তাকে জানালে তিনি তা সুন্দরভাবে সমাধানের চেষ্টা করেছেন। দুর্ভাগ্যজনিত কারণে আরও কিছুদিন চাকরির বয়স থাকলেও তিনি অসুস্থ হয়ে অবসরে চলে যান। কিন্তু তার অবসরের পর তাকে আমরা তেমনভাবে কোনো মূল্যয়ন করতে পারিনি। বর্তমানে আলতাফ হোসেন স্যার গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় বাড়িতেই আছেন।
তিনি আরও বলেন, আমাদের মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষকদের সব থেকে বড় সমস্যা হচ্ছে যখন কেউ অবসরে যায় তখন তিনি সঠিক সময়ে তার প্রাপ্য অবসর ভাতা পান না। একজন শিক্ষক অবসরে গেলে যখন তার মাসিক আয় বন্ধ হয়ে যায় তখন ওই শিক্ষক এমনিতেই বিমর্ষ হয়ে পড়েন। কিন্তু দেখা যায়, সাত থেকে আট বছরেরও বেশি সময় লেগে যায় অবসর ভাতা পেতে। এ ছাড়া, নিজেদের কল্যাণ তহবিলে জমানো টাকা পেতেও প্রায় দুই-তিন বছর সময় লেগে যায়। বেশির ভাগ শিক্ষকরাই বৃদ্ধ বয়সে অবসরে যান এবং বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পরেন। বর্তমানে আলতাফ হোসেন স্যারের শারীরিক যে অবস্থা তাতে তার সুচিকিৎসার জন্য অবসরকালী ভাতা পাওয়া খুবই জরুরি হয়ে পরেছে বলে জানান তিনি।
এএমকে