বীমার টাকা না পেয়ে গ্রাহকদের সড়ক অবরোধ, কর্মকর্তারা অবরুদ্ধ

ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের রংপুর জোনাল অফিসে উত্তেজনা ও বিশৃঙ্খলার ঘটনা ঘটেছে। অভিযোগ উঠেছে, গ্রাহকদের কোটি কোটি টাকার বীমা দাবি পরিশোধ না করে অফিসের মালপত্র বিক্রি করে পালানোর চেষ্টা করছিলেন কর্মকর্তারা। খবর পেয়ে ক্ষুব্ধ গ্রাহকেরা দ্রুত অফিসে গিয়ে তাদের অবরুদ্ধ করে রাখেন। পরে তারা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন।
রোববার (২৬ অক্টোবর) বিকেল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ চলতে থাকে। এর আগে, শনিবার গভীর রাতে অফিসের মালামাল ট্রাকে করে পাচারের অভিযোগে উত্তেজিত গ্রাহকেরা অফিসের সামনে একটি ট্রাকসহ মালামাল আটক করেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শনিবার মধ্যরাতে অফিসের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী আসবাবপত্র ও দামি সরঞ্জাম বাইরে নিতে গেলে স্থানীয় গ্রাহকদের সন্দেহ হয়। তারা দ্রুত অফিসে গিয়ে মালামাল আটক করেন এবং কর্মকর্তাদের জবাবদিহির জন্য অবরুদ্ধ করে রাখেন। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে রোববার সকাল থেকেই অফিসের সামনে গ্রাহকদের ভিড় বাড়তে থাকে। দুপুর নাগাদ গ্র্যান্ড হোটেল জামাল মার্কেটের সামনে অফিসের নিচে নগরীর প্রধান সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন তারা।
সরেজমিনে দেখা যায়, গ্র্যান্ড হোটেল মোড়ে গ্রাহকেরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করছেন। এ সময় অফিসের লকার, চেয়ার-টেবিল, আসবাবপত্র ও একটি ট্রাক সেখানে রাখা ছিল। অফিস কক্ষের ভেতরে চারজনকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়।
অভিযোগ উঠেছে, রংপুর বিভাগের প্রায় ৩০ হাজার গ্রাহকের ১২১ কোটি টাকারও বেশি বীমা দাবি এখনো পরিশোধ করেনি ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি। দীর্ঘদিন ধরে টাকা না পেয়ে তারা হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েছেন।

রংপুর বিভাগীয় কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত রংপুর বিভাগের আট জেলায় ২৯ হাজার ৫৯৬ জন গ্রাহকের বীমার মেয়াদ শেষ হয়েছে। যার বিপরীতে ১২০ কোটি ৯৭ লাখ টাকার বেশি বকেয়া রয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী বীমার মেয়াদ পূর্ণ হলে ৯০ দিনের মধ্যে টাকা পরিশোধের বাধ্যবাধকতা থাকলেও গ্রাহকেরা বছরের পর বছর ধরে শুধু আশ্বাসই পাচ্ছেন।
অবস্থান নেওয়া গ্রাহক আকলিমা বেগম (চেকপোস্ট ভগিবালা এলাকা) বলেন, আমার স্বামী নাই। অনেক কষ্ট করে কিছু টাকা জমা করেছি। দুই বছর আগে বীমার মেয়াদ শেষ হলেও এখনো টাকা পাইনি। আমাদের মতো গরিব মানুষের টাকা নিয়ে এখন তারা পালানোর চেষ্টা করছে। আমরা আমাদের কষ্টের টাকা ফেরত চাই।
নগরীর কলেজ রোড নিউ আদর্শপাড়া এলাকার আজিজার রহমান বলেন, রিকশা চালিয়ে ১২ বছর ধরে কষ্ট করে টাকা জমিয়েছি। সেই টাকা না দিয়ে ফারইস্ট কোম্পানি অফিসের মালপত্র বিক্রি করে পালিয়ে যাচ্ছে। এই টাকা না পেলে আমার পরিবার পথে বসবে। আমার রক্ত-ঘামে উপার্জিত টাকা আমি ফেরত চাই।
হারাগাছ এলাকার সায়েম বাদশা বীমার কাগজপত্র হাতে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে রাস্তায় বসে পড়েন। তিনি বলেন, বুড়া বয়সে ভালোভাবে চলার আশায় টাকা জমা করনু। এখন শুনতাছি বীমা কোম্পানি টাকা না দিয়ে পালায় যাবার চেষ্টা করতাছে। কত কষ্টে ১০ হাজার টাকা জমা করনু, বিপদের সময় কাজে লাগবে ভেবেছিলাম। কিন্তু দুই বছর ধরি টাকা না দিয়া টালবাহানা করতাছে। সরকারের কাছে আমাদের একটাই দাবি আমাদের টাকা যেন ফেরত দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্সের এসভিপি আব্দুল কাদের বীর বলেন, আমরা পুরনো আসবাবপত্র বিক্রি করছিলাম নতুন অফিসে স্থানান্তরের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে। ভুল বোঝাবুঝির কারণেই গ্রাহকরা উত্তেজিত হয়েছেন। আমাদের পর্যাপ্ত সম্পদ রয়েছে, সেগুলো বিক্রি করেই গ্রাহকদের পাওনা পরিশোধ করা হবে।
তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আমাদের কোম্পানির অনেক সম্পদ দখল হয়ে গেছে। আমরা আইনি প্রক্রিয়ায় তা পুনরুদ্ধার করে গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেব।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে রংপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক রমিজ আলম বলেন, এই অফিসের আওতায় প্রায় ৭০ হাজার গ্রাহক আছেন, যাদের বকেয়া প্রায় ১৩৭ কোটি টাকা। দীর্ঘদিন ধরে তারা টাকা পাচ্ছেন না। আমরা কোম্পানির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছি এবং বীমা নিয়ন্ত্রক সংস্থার সাথেও যোগাযোগ করছি, যাতে দ্রুত গ্রাহকদের টাকা পরিশোধ করা যায়।
তিনি আরও বলেন, অফিস থেকে নামানো মালামাল আপাতত এখানেই থাকবে। আমরা নিশ্চিত করছি, তাদের জমি বা সম্পদ বিক্রির কোনো প্রক্রিয়া যেন না হয়। বিষয়টি দ্রুত ও শান্তিপূর্ণভাবে সমাধানের জন্য প্রশাসন সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে।
এ বিষয়ে মহানগর কোতোয়ালি থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আতাউর রহমান বলেন, আমরা ঘটনাস্থলে এসে গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলেছি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা চলছে।
সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, কর্মকর্তাদের আশ্বাসে গ্রাহকেরা সড়ক অবরোধ তুলে নিয়ে বীমা অফিসে অবস্থান করছেন। সেখানে তারা কর্মকর্তাদের অবরুদ্ধ করে রেখেছেন এবং দাবি জানিয়েছেন পাওনা টাকা না পাওয়া পর্যন্ত কেউই সেখান থেকে ফিরবেন না।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এআরবি