সুগন্ধা নদীতে পৌর বর্জ্য, হুমকির মুখে জীববৈচিত্র্য ও জনস্বাস্থ্য

ঝালকাঠি পৌরসভার ডাম্পিং স্টেশন না থাকায় শহরের ময়লা-আবর্জনা প্রতিদিন সরাসরি ফেলা হচ্ছে জেলার প্রধান নদী সুগন্ধায়। ফলে নদী পড়েছে ভয়াবহ দূষণের কবলে, বিলীন হচ্ছে জীববৈচিত্র্য, হুমকিতে পড়েছে মানুষের স্বাস্থ্য ও নদীনির্ভর জীবিকা। নদীর পানিতে মিশে যাচ্ছে রোগজীবাণু, ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ, আর মাছসহ জলজ প্রাণী হারাচ্ছে তাদের প্রাকৃতিক আবাসস্থল।
ঝালকাঠি শহরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ঐতিহ্যবাহী সুগন্ধা নদী। শতাধিক বছর আগে এই নদীর তীরেই গড়ে ওঠে ঝালকাঠি শহর। পরে ১৮৭৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় পৌরসভা। অথচ দেড় শতাব্দী পেরিয়েও এখানকার বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কোনো স্থায়ী নীতিমালা তৈরি হয়নি।
যুগের পর যুগ এ নদীর তীরে গড়ে উঠেছে ঝালকাঠির জীবনযাত্রা ও ব্যবসাবাণিজ্য। কিন্তু এখন এ নদী শহরের ময়লা-আবর্জনা ফেলার স্থানে পরিণত হয়েছে। পৌরসভার পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা প্রতিদিন শহরের বিভিন্ন পাড়া-মহল্লা থেকে ময়লা সংগ্রহ করে গাড়িতে করে সরাসরি নদীতে ফেলছেন। এতে নদীর পানিতে মিশে যাচ্ছে প্লাস্টিক, পলিথিন, বাসাবাড়ির আবর্জনা ও মেডিকেল বর্জ্য। দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা এই অনিয়ন্ত্রিত বর্জ্য ফেলার কারণে নদীর পানি এখন আশপাশের মানুষের ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে।
স্থানীয়রা জানান, পৌরসভার খেয়াঘাট সংলগ্ন এলাকা নদীতে ময়লা ফেলার প্রধান স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগৃহীত আবর্জনা এনে নদীর পাড়ে ফেলা হয়, যা বৃষ্টির পানি ও জোয়ারের সঙ্গে নদীতে মিশে যাচ্ছে। ফলে মাছের পেটে জমছে মাইক্রোপ্লাস্টিক, কমে যাচ্ছে ইলিশ ও দেশীয় মাছের সংখ্যা।
স্থানীয় জেলে ও পরিবেশকর্মীরা জানান, নদীতে ছড়িয়ে পড়া প্লাস্টিক এখন মাছের শরীরে প্রবেশ করছে। এসব মাছ খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ায় সেই প্লাস্টিক ও বিষাক্ত পদার্থ মানুষের শরীরেও প্রবেশ করছে।

উন্নয়নকর্মী আজমীর হোসেন বলেন, নদীতে ছড়িয়ে পড়া প্লাস্টিক মাছ খাচ্ছে, আর সেই মাছের মাধ্যমে বিষক্রিয়া মানুষের শরীরে ঢুকছে। আগের মতো সুগন্ধার মাছের স্বাদও আর নেই। আগে এখানে নানা প্রজাতির দেশীয় মাছ পাওয়া যেত, এখন বেশিরভাগই হারিয়ে গেছে।
পরিবেশবিদদের মতে, একসময় সুগন্ধা নদী ছিল ইলিশের প্রজনন কেন্দ্র। নদীর স্বচ্ছ পানি ও পর্যাপ্ত অক্সিজেন ইলিশসহ দেশীয় মাছের প্রজননের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছিল। কিন্তু এখন পানির গুণগত মান নষ্ট হয়ে যাওয়ায় মাছের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে।
ঝালকাঠির নদী-খাল রক্ষা কমিটির সদস্য প্রশান্ত দাস হরি বলেন, একটা প্রথম শ্রেণির পৌরসভায় ডাম্পিং স্টেশন না থাকা অগ্রহণযোগ্য। খোদ পৌরসভাই নদী দূষণের জন্য দায়ী। নদী রক্ষার কথা বলে প্রচারণা চালানো হলেও প্রতিদিন পৌরসভার গাড়িতেই ময়লা গিয়ে পড়ছে নদীতে। তিনি আরও বলেন, নদীর পানি ব্যবহার করে কৃষিকাজ, রান্না বা গোসল করলে নানা রোগের ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। শিশুদের ত্বক ও শ্বাসজনিত সমস্যাও বাড়ছে।
নদীর তীরের পৌর খেয়াঘাট এলাকার মাঝি নয়ন বলেন, যেখানে ময়লা ফেলা হয়, তার পাশেই আমাদের ঘাট। সকালে ঘাটে নামলেই দুর্গন্ধে থাকা যায় না। গন্ধে ট্রলার চালানোও কষ্টকর হয়ে পড়েছে। পৌরসভার লোকজন প্রতিদিন গাড়ি ভর্তি করে এখানে ময়লা ফেলে রেখে যায়। তিনি অভিযোগ করেন, নদীতে ময়লা ফেলার কারণে শুধু পানি নয়, আশপাশের বাতাসও দুর্গন্ধে ভরে যাচ্ছে। খেয়াঘাটের পাশে থাকা পরিবারগুলো নানা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছে।
ময়লা ফেলার স্থানের পাশে বসবাসকারী স্থানীয় বাসিন্দা শাকিল হাওলাদার রনি বলেন, আমাদের বাড়ির পাশেই পৌরসভার বর্জ্য ফেলার জায়গা। দিন-রাত দুর্গন্ধে থাকা যায় না। মশা-মাছি বেড়ে গেছে, শিশুরা অসুস্থ হচ্ছে। আমরা বহুবার পৌরসভায় অভিযোগ দিয়েছি, কিন্তু কোনো সমাধান হয়নি।
ঝালকাঠি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক আফজাল হোসেন বলেন, শিক্ষার্থীদের নিয়ে আমরা প্রায়ই পরিবেশবিষয়ক কর্মসূচি করি। কিন্তু শহরেই যদি নদীতে ময়লা ফেলা হয়, তাহলে শিক্ষার্থীদের কীভাবে শেখাব আমরা পরিবেশ রক্ষার গুরুত্ব? এই অবস্থা চলতে থাকলে পরিবেশ মারাত্মকভাবে বিপন্ন হবে।
ঝালকাঠি পৌরসভার প্রকৌশলী নাজমুল হাসান বলেন, আমরা জানি নদীতে ময়লা ফেলার কারণে দূষণ হচ্ছে। ডাম্পিং স্টেশন নির্মাণের জন্য শহরের বিকনা এলাকায় জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। বরাদ্দ পেলেই কাজ শুরু করব। আপাতত বিকল্প জায়গা না থাকায় কিছুদিন নদীর তীরে ময়লা রাখা হচ্ছে। দ্রুতই স্থায়ী সমাধান করা হবে।
ঝালকাঠি পৌরসভার প্রশাসক মো. কাওছার হোসেন বলেন, ডাম্পিং স্টেশন স্থাপনের জন্য ইতোমধ্যে জমি চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রকল্প অনুমোদনের প্রক্রিয়া শেষ হলেই নির্মাণকাজ শুরু হবে। আশা করছি, এ সমস্যার সমাধান অচিরেই হবে। তিনি আরও বলেন, আমরা চাই শহর পরিষ্কার থাকুক, কিন্তু তার জন্য পরিবেশ ধ্বংস করা ঠিক নয়। টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে কাজ চলছে।
উল্লেখ্য, ব্রিটিশ আমলে ১৮৭৫ সালে যাত্রা শুরু হয় ঝালকাঠি পৌরসভার। প্রায় দেড় শতাব্দী পুরনো ১৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই প্রথম শ্রেণির পৌরসভায় বর্তমানে প্রায় এক লাখ মানুষের বসবাস। অথচ এখনো আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুগন্ধা নদী বাঁচানো মানেই ঝালকাঠির অস্তিত্ব রক্ষা করা। দ্রুত ডাম্পিং স্টেশন স্থাপন ও আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না হলে এই নদী ধ্বংস হয়ে যাবে, যা আগামী প্রজন্মের জন্য ভয়াবহ হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।
শাহীন আলম/এআরবি