হাবিবুরদের জীবন অনিশ্চয়তায় ভরা

কাজ না করলে তো পেট চলে না। গাড়ি চালালে টাকা, না হলে নেই। সবসময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সড়কে চলতে হয়। যেকোনো মুহূর্তে ঘটতে পারে দুর্ঘটনা। এমনই একটি দুর্ঘটনায় পড়ে পঙ্গুত্ববরণ করেছি, হারিয়েছি একটি পা। তিন বছর বিছানায় ছিলাম। ওই সময়গুলো যে কী কষ্টে দিন পার করেছি তা বলার মতো নয়। পরিবারে তিন মেয়ে ও স্ত্রী। একসঙ্গে চিকিৎসা আর সংসার চালানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। সংসার চলতো ধার-দেনা, মেয়ের টিউশনি করার টাকা আর পরের বাড়িতে স্ত্রীর কাজ করা অর্থ দিয়ে। একটি পা থাকলেও সেটি আর চলে না। চলাচল করতে পারি না। তবুও পেটের দায়ে এখন অনেক কষ্টে একবেলা ইজিবাইক চালাতে হয়। ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদকে এভাবেই বলছিলেন খুলনা-সাতক্ষীরা রুটে দুর্ঘটনায় পা হারানো বাসচালক মো. হাবিবুর রহমান।
তিনি বলেন, মটর শ্রমিক ইউনিয়ন থেকে দুর্ঘটনায় সামান্য কিছু সহযোগিতা পেয়েছি, কিন্তু তা তেমন কিছুই না। এখনও সরকারি কোনো সহযোগিতা জোটেনি। এমন অনেক চালক এভাবে পঙ্গু অবস্থায় পড়ে আছে। নেই ভবিষ্যৎ জীবনের নিশ্চয়তা, আছে আর্থিক অনটন।
বাসচালক মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ১৯৯৬ সালে হেলপার হিসেবে কাজ শুরু করি। কিছুদিন পর কন্ট্রাক্টরের কাজ করি। তখন চিন্তা ছিল আগামীতে ড্রাইভার হবো। পরবর্তীতে আল্লাহ সেই আশা পূরণ করেছে। ২০০৬ সাল থেকে ড্রাইভিং করি। খুলনা-সাতক্ষীরা রোডে বাস চালানো শুরু করি।
যেভাবে দুর্ঘটনায় পড়েন হাবিবুর
দুর্ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ২০১৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর খুলনা থেকে সাতক্ষীরার উদ্দেশ্যে ট্রিপ (যাত্রী) নিয়ে যাচ্ছিলাম। সাতক্ষীরার মির্জাপুর স্টপেজ থেকে যাওয়ার পথে একটি ট্রাক আসছিল। আর ট্রাকের সামনে ছিল ইজিবাইক। ট্রাকটি বার বার হর্ন দিলেও সাইড দেয়নি। আমিও ক্রস করার সময় ট্রাকটি ব্রেক করে। এসময় ট্রাকের পেছনের সাইডের ডালাটি আড় হয়ে যায়। বাসটি ট্রাকের ডালায় ধাক্কা লাগে। এসময় গাড়ি সাইডে পড়ে গাড়ির সামনে আমার পা আটকে যায়। স্থানীয় জনগণ আমাকে উদ্ধার করে। তখন আমার পা ঝুলছিল। পায়ে হাড় ছিল না, সামান্য মাংস-চামড়া লাগানো ছিল। আমাকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়। সেখান থেকে ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে নেওয়া হয়। চিকিৎসক ও সকলের পরামর্শে বা পা কেটে ফেলা হয়। আর ডান পায়ের মাঝের দিকে একটি হাড় ভেঙে যায়। এজন্য আমি হাটা চলা করতে পারি না। তিন বছর আমি বিছানায় ছিলাম। তিন বছর পরে ডান পায়ে কিছুটা শক্তি পেয়েছি।
নিজের অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরে হাবিবুর বলেন, আমার পরিবারে তিন মেয়ে। দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে। ছোট মেয়েটি নিয়ে থাকি। সে প্রাইভেট পড়ায় আর স্ত্রী মানুষের বাড়িতে কাজ করে। আর আমি একবেলা অটোরিকশা চালাই। চলাফেরা তো করতে পারি না, সেই সঙ্গে বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারি না। জ্বরে পড়ে থাকলে মেয়েটা দৌড়ে দুইটা নাপা এনে দেয়। চার-পাঁচ দিন বিছানায় ছিলাম কোনো রকম কষ্টে চলেছি। বেশি দিন অসুস্থ থাকলে বিপাকে পড়ে যায়।
হাবিবুর বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্য করার মতো কোনো পুঁজি নেই। এজন্য ইজিবাইক চালানোটাকেই বেছে নিয়েছি। ভাড়ায় একবেলা অটো চালিয়ে মালিককে ৩০০ টাকা দেই। আর দুই-তিনশো টাকা আমি পাই। কিন্তু অন্য কিছু যে করবো সেই সামর্থ্য নেই, পয়সা নেই। কিছু করার ক্যাপাসিটিও নেই। রাস্তায় ঝুঁকি আছে জেনেও বাধ্য হয়ে পেট চালানোর জন্য, পরিবারের জন্য অটো চালাতে হচ্ছে। খুব কষ্টে দিন পার করতে হয়। আমার স্ত্রী যে কখনো বাইরে যায়নি, আর্থিক সমস্যার কারণে মানুষের বাড়িতে (গৃহ পরিচালিকা) কাজ করতে হচ্ছে। ছোট মেয়েটা এইচএসসি পাস করলেও দুর্ঘটনার পর আর্থিক সমস্যার কারণে ডিগ্রি পড়তে পারছে না। এখন সময়ও শেষ। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সুযোগ আছে ভর্তির, তবে অর্থের অভাবে ভর্তি করাতে পারছি না। মেয়েটার খুব শখ লেখাপড়া করার। দুটি টিউশনি করিয়ে যে টাকা পায় তা সংসারে দেয়। আমি দিন আনি দিন খাই। ১০-১৫ দিন বসে থাকলে চলার মতো সামর্থ্য নেই। এখন যদি সরকারি-বেসরকারিভাবে কিছু সহযোগিতা পাওয়া যেত তাহলে ছোট একটি দোকান করে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারতাম। মেয়ের লেখাপড়া এবং সংসারটা ভালোভাবে চালাতে পারতাম।

বাসচালক হাবিবুরের স্ত্রী নূর আরবী বেগম বলেন, ওর আব্বা যখন লোকের গাড়ি চালাত, তখন গাড়ি চালালে টাকা, না চালালে টাকা নেই। তখন আলহামদুলিল্লাহ, তিনি গাড়ি চালিয়ে টুকটাক করে ডাল-ভাত খেয়ে আমাদের সংসার চালাতেন। তিনটা বাচ্চা মানুষ করেছেন কষ্ট করে। তারপর একদিন ওর আব্বার এক্সিডেন্ট হলো। প্রায় ছয় মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত চিকিৎসা নিতে হলো। তখন আমাদের সংসারের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেল। ঠিকমতো ডাল-ভাত খেতেও পারতাম না। চিকিৎসার পর তিনি যখন শয্যাশায়ী হলেন, তখন আমার দুই মেয়ে টিউশনি করে যা সামান্য টাকা আনতো, তা দিয়ে সংসার চলতো না। ঘর-ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল সব মিলে কোনোভাবেই চলা সম্ভব ছিল না।
আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ওর আব্বা যখন সুস্থ ছিলেন তখন আমি মেয়েদের পড়াশোনা আর সংসার নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। জীবনে কখনো বাসায় কাজ করিনি। কিন্তু সেই সময়ে বাধ্য হয়ে লোকের বাসায় কাজ করতে শুরু করি। দুই মেয়ের টিউশনি আর আমার বাসার কাজের টাকায় কোনো মতে সংসার চলতো। আর টাকার অভাবে ছোট মেয়েটা ইন্টার পাস করে পড়া বন্ধ করে দিলো। ওকে আর পড়াতে পারিনি। ওর আব্বা এখন আবার গাড়ি চালাতে যায়। রিকশাওয়ালারা এসে ধরে নিয়ে যায়, আবার দিয়ে যায়। একবেলা কাজ করলেই অসুস্থ হয়ে পড়ে, ব্যথায় নড়াচড়া করতে পারে না। এইভাবেই চলছে আমাদের দিনকাল।
তিনি বলেন, যারা সরকারি চাকরি করে, তারা মাস শেষে নির্দিষ্ট একটা টাকা পায়- যা দিয়ে তাদের সংসার চলে। কিন্তু আমরা যারা মোটর শ্রমিক, আমাদের কোনো নির্দিষ্ট বেতন নেই। যদি আমাদেরও প্রতি মাসে একটা নির্দিষ্ট টাকা পেতাম, তাহলে আমাকে আর লোকের বাসায় কাজ করতে হতো না। স্বামী আর মেয়েদের নিয়ে ডাল-ভাত খেয়ে শান্তিতে দিন কাটাতে পারতাম।
বাস চালক মাহফুজুর রহমান বলেন, ভোর ৫-৬টার দিকে চালকের আসনে বসি। রাত ৯টা-১০টার পর নামি। কিন্তু এখানে যে আয় হয় তা দিয়ে পরিবার নিয়ে চলতে অনেক কষ্ট হয়। এটা কেউ বোঝে না আর আমরা বোঝাতেও পারি না। অনেকে মনে করে গাড়ি চালাই, অনেক আয়। আসলে এরকম না, চলতে অনেক কষ্ট হয়ে যায়। হরতাল অবরোধে গাড়ি বন্ধ থাকলে আমাদেরও বসে থাকতে হয়। শিখেছি বাস চালানোই, বিকল্প কিছু পারি না।
ভবিষ্যত অনিশ্চিত
অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ জীবনের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, শেষ বয়সে এসে আমাদের আর কিছু থাকে না, শুধু আমরাই। প্রতিদিনের আয়, প্রতিদিনই চলে যায়। আমাদের কোনো সঞ্চয় থাকে না। শেষ বয়সে কোনো নিশ্চয়তা আমাদের নেই। আল্লাহ ছাড়া আমাদের আর কোনো জায়গা নেই।
চাকা ঘুরলে টাকা, না ঘুরলে নেই
খুলনা-পাইকগাছা রুটের বাসচালক বাবলুর রহমান বলেন, গাড়ির চাকা ঘুরলে টাকা পাই, না ঘুরলে নেই। গাড়ির চাকা ঘুরলে মাসে ১০-১৫ হাজার টাকা বাড়িতে নিতে পারি।
তিনি বলেন, দুর্ঘটনার ঝুঁকি থাকলেও বাস নিয়ে নামতে হয়। এক পা কবরে, এক পা জেলে এই দুশ্চিন্তা নিয়ে নামতে হয়। দুর্ঘটনা ঘটলে দুই লাখ-আড়াই লাখ টাকা খরচ, হয়তো ২০-৩০ হাজার টাকা ইউনিয়ন সাহায্য করবে। কোনো পরিবেশ পরিস্থিতি নেই, আমাদের ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণ অন্ধকার।
বাসের কন্ট্রাক্টর মো. ফারুখ বলেন, কাজ হলে আয় হয়, না হলে হয় না। বাসস্ট্যান্ডে সকাল থেকে এসে বসে আছি, দুই-তিনশো খরচ। মোটর শ্রমিকরা খুব দুর্দশায় রয়েছে। খুব অসহায়। অনেক দিন বাড়ি থেকে নিজ খরচে এসে ট্রিপ না পেয়ে গাটির (নিজ) খরচে চলে যেতে হয়। মালিকরা কিছু দেয় না। সংসার খুব কষ্টে চলে, ধার দেনা করে নিয়ে চলতে হয়।
অবসরে-পঙ্গুত্ব হলে দায়িত্ব নেওয়ার কেউ নেই
খুলনা মটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক কাজী শহিদুল ইসলাম বলেন, মটর শ্রমিকদের খুব দূরাবস্থার মধ্যে দিন পার করতে হয়। শ্রমিকদের সন্তানদের লেখাপড়া হয় না। পরিবারে বড় আয়ের উৎস থাকলে ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া করাতে পারে। কিন্তু লেখাপড়া করানো, ছেলে- মেয়েদের ভালো একটা চাকরি দেব, আমি অবসরে গেলে বা পঙ্গুত্ববরণ করলে সেই ছেলে আমার দায়-দায়িত্ব নেবে সেই অবস্থাও আমাদের নেই। যদিও কোনো ছেলে-মেয়ে লেখাপড়া করে, পরে আর্থিক অনটনে পড়ে ছেড়ে দিতে হয়। কারও ছেলে থাকলে ইজিবাইক, ভ্যান, রিকশা বা সিএনজি, গাড়ির হেলপারির কাজে চলে আসে। ঘরের স্ত্রী পরের বাসায় কাজ করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। আমরা সামান্য কিছু চিকিৎসার খরচ দেই, কিন্তু সেটি পূরণ হয় না।
এই শ্রমিক নেতা বলেন, আমাদের পরিবহন সেক্টরের দিকে ভালো নজর কেউ দেয় না। যেহেতু আমি ড্রাইভার, আমার ছেলেও হয় ড্রাইভার, না হয় সুপারভাইজার। শ্রমিকদের কোনো চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই। শিক্ষার ব্যবস্থা নেই। বাসস্থানের ব্যবস্থা হয় না। এমনকি বছরে দুটি ঈদ উৎসব যায়, তাদের ঈদ বোনাসও নেই।
কাজী শহিদুল ইসলাম বলেন, শ্রমিকদের চাকরিতে কোনো নিশ্চয়তা নেই। যেকোনো মুহূর্তে চাকরি চলে যেতে পারে বিনা কৈফিয়তে। এ নিয়ে ফেডারেশন থেকে শুরু করে আমরাও অনেক সময় অনেক কথা বলেছি। এক সময় চালের কেজি ছিল ২০ টাকা। সেই সময়ে যে বেতন ছিল এখনও তা রয়ে গেছে। বিগত ১৭ বছরে ফ্যাসিস্টরা যা করে গেছে আমরা কোনো আন্দোলন-সংগ্রাম করতে পারিনি। এখন আন্দোলনে যেতে চাইছি না, তবুও কেন্দ্রের সঙ্গে কথা বলছি শ্রমিকদের কিছু করা যায় কিনা। শ্রমিকদের চাকরির নিশ্চয়তা প্রয়োজন। হুট করে বললো তোমার চাকরি নেই, চলে গেল। শ্রমিকদের নিয়োগ পত্রের ব্যবস্থা হলে ভালো হতো। অন্তত চাকরিটা কি কারণে গেল তা যেন জানতে পারি।
মটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক বলেন, অনেক সময় শ্রমিকদের রেস্ট নেওয়ার সুযোগ থাকে না। একটা ড্রাইভার খুলনা থেকে দূর-দুরান্তে যায়। যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কোম্পানির প্রতিনিধি ঘুরাতে বলে, যাত্রী দাঁড়িয়ে থাকে। খাওয়ার সময় পায় না, হাত-পা ধোয়ারও সুযোগ হয় না। আবার ঘুরিয়ে চলে আসে। ঈদের ছুটিতে চাপ থাকে। যাত্রীও বেশি থাকে, গাড়ি কম। ওই এক গাড়ি দিয়েই খাটায়। অনেক সময় ড্রাইভার পাওয়া যায় না, ওই ড্রাইভারই চলে। দিনরাত পরিশ্রম যদি একটা ড্রাইভার করে, তার ঘুম আসতেই পারে। সেকেন্ডের ভেতরে একটা বড় ধরনের দুর্ঘটনা হয়ে যেতে পারে। দুর্ঘটনার এটি মূল কারণ। সরকারি ব্যবস্থাপনায় বিশ্রামাগারও নেই। ড্রাইভার এক জায়গায় গেলে আধাঘণ্টা রেস্ট নেবে সেই ব্যবস্থা নেই। নিয়ম-কানুন ছাড়া পরিবহন সেক্টর ঠিক করা কষ্টকর। নিয়ম-শৃঙ্খলায় সবার উদ্যোগ নিতে হবে। আমরা সরকারি নিয়ম-কানুন মানবো। আর সরকারেরও উচিত এই অবহেলিত জনগোষ্ঠীর জন্য একটা ভালো দিক নেওয়া যায় কিনা। অনেক কোম্পানি আছে ম্যাট্রিক (এসএসসি) পাস না করলে সুপারভাইজার নেয় না। লেখাপড়া থাকলে তার ব্যবহার, কর্মকাণ্ডগুলোও ভদ্র হয়। আস্তে আস্তে এগুলো ঠিক হচ্ছে, কিন্ত সরকারি কোনো অনুদান বা উদ্যোগ আমরা পাচ্ছি না।
মালিকরা জামিন করাতে চায় না
গাড়ির কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে মালিকরা সাধারণত জামিন করাতে চায় না। অনেক ক্ষেত্রে আলোচনা ও চাপের মাধ্যমে গাড়ির টানের ড্রাইভারের জামিন করায়। ওই জামিন করানো পর্যন্তই শেষ। এরপরে আর তারা খোঁজ-খবর নেয় না। শ্রমিকদের এতো দুর্দশা দেখার কেউ নেই। এভাবেই শ্রমিকরা জীবন-যাপন করছে।
মৃত শ্রমিকের পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা দেয় শ্রমিক ইউনিয়ন
খুলনা মটর শ্রমিক ইউনিয়নে প্রায় ১০ হাজার শ্রমিক। মটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক বলেন, সরকার নির্ধারিত যে রাজস্ব আয়, এই আয়ে সংগঠন চালানোও সম্ভব না। তারপরও আমরা কিছুদিন আগে ৪৬ জন মৃত শ্রমিক পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা করে দিয়েছি। এর আগেও অনেকবার দিয়েছি। কিন্তু কি হয় এই টাকায়, কি বা করতে পারে ? একজন শ্রমিক বৃদ্ধাকালীন সময়ে চোখে দেখে না, এখন আর গায়ে শক্তি নেই, হাটা চলা করতে পারে না এমন অনেকে আসে। মালিকদের পক্ষ থেকে পেনশনও পায় না। শ্রমিক ইউনিয়ন থেকে ২০ হাজার টাকা দিয়ে থাকি। যদি একটা চায়ের দোকান দিয়ে কোনো রকম চলতে পারে।
যেসব রোগে আক্রান্ত হয় পরিবহন শ্রমিকরা
খুলনার ডেপুটি সিভিল সার্জন মো. মিজানুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, পরিবহনের চালক, হেলপার ও সুপারভাইজার বা শ্রমিকরা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। এরমধ্যে বায়ু ও শব্দ দূষণ এবং মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। এরমধ্যে ফুসফুসের অনেক রোগে ভূগতে পারে। যেমন যক্ষা, হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট ও এজমা রোগেও তাগে ভোগে। স্ট্রোক, কিডনির নানা জটিলতায় ভোগে। শব্দের কারণে মাথা যন্ত্রণা, কানের শ্রবণ শক্তি কমে যায়। দীর্ঘসময় বসে থাকায় পা ফোলা, পায়ে রস আসে, শিরাগুলো ফুলে যায়। অতিরিক্ত কাজের চাপে মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। নিদ্রাহীনতায় ভোগে। এই কারণে হৃদরোগে আক্রান্তও হয়।
সড়ক দুর্ঘটনার কারণ
হাইওয়ে পুলিশের খুলনা রিজিয়ন সুপার মোহাম্মদ জাকারিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, সড়ক দুর্ঘটনার জন্য ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন দায়ী। এছাড়া অনেক চালকের লাইসেন্স নেই, পেশাদার কোনো প্রশিক্ষণ নেই। অনেক বেশি সময় ধরে গাড়ি চালায়। ৮ ঘণ্টা গাড়ি চালানোর কথা থাকলেও ডাবল ট্রিপ মারে। ঘণ্টা ৮০ কিলোমিটার গতিতে চালানোর কথা থাকলেও অনেক সময় ১০০-১১০ কিলোমিটার বেগে গাড়ি চালায়। মহাসড়কে অনুমোদনহীন যানবাহন থাকে, ধীরগতির যানবাহন ও থ্রি হুইলার থাকে। এগুলো সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ।
তিনি বলেন, মটর শ্রমিকদের বেতন কাঠামো সকলেরই জানা। সংশ্লিষ্ট মালিক যে বেতন দেয় তাই। কাররই আর্থিক অবস্থা ভালো না। তাদের কোনো প্রফেশনাল ক্যারিয়ার নেই। যে কারণে নির্দিষ্ট কিছু চালক মাদক বহন করে। তবে বেশিরভাগ কক্সবাজার-চট্টগ্রাম-কুমিল্লা-ঢাকা রুটে মাদক বহন হয়। খুলনা রুটে এই সংখ্যাটা কম। খুব একটা পাই না।
তিনি আরও বলেন, হাইওয়ে পুলিশের সংখ্যা কম। হাজার হাজার যানবাহন চলাচল করে। সোনা এবং মাদক খুব ক্ষুদ্র জিনিস। এই ক্ষুদ্র জিনিস যদি বড় একটি ট্রাক বা বাসের নির্দিষ্ট জায়গায় লুকিয়ে রাখে তাহলে খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন হয়ে যায়।
খুলনা বিআরটিএ’র পরিচালক জিয়াউর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হচ্ছে অনিরাপদ সড়ক। একটি সড়কে নসিমন, করিমন, ভটভটি ও ইজিবাইক চলাচল করে। অতিদ্রুত গতিতে গাড়ি চালানো, ওভারলোডেড অবস্থায় গাড়ি চালানো, ট্রাফিক সিগনাল না মেনে গাড়ি চালানো, বৃষ্টি-কুয়াশার দিনে নিচের দিকে ঝুঁকে গাড়ি না চালানো ও চলন্ত অবস্থায় মোবাইল ফোন ব্যবহার। এসব কারণে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। এগুলো রোধ করার জন্য সরকার উদ্যোগ নিয়েছে। এক্সপ্রেসওয়ে-হাইওয়েতে যেন সাইড লাইন হয়। যাতে হাউ স্পিড গাড়ি একপাশে চলবে, ধীরগতির গাড়ি একপাশে চলবে। পাশাপাশি বিআরটিএ’র পক্ষ থেকে আমরা ড্রাইভারদের সচেতনতা বৃদ্ধি, যেন সঠিকভাবে গাড়ি চালায় এবং পাঁচ বছর পর পর যখন ড্রাইভিং লাইসেন্স নবায়ন করে আবার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। যাতে তারা আইন সম্পর্কে সঠিকভাবে যানে এবং গাড়ি সঠিকভাবে চালাতে পারে। এছাড়া ফিটনেসবিহীন গাড়ি যাতে রাস্তায় চলাচল করতে না পারে সেজন্য সরকার উদ্যোগ নিয়েছে। উদ্দেশ্য একটাই দুর্ঘটনা যাতে রোধ করা যায়। মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষা করা।
সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতদের ক্ষতিপূরণ দেয় সরকার
বিআরটিএ’র পরিচালক আরও বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় কেউ নিহত হলে তার পরিবারকে ৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। আহত হওয়ার ধরনের ভিত্তিতে ১ লাখ থেকে ৩ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। যাতে ভুক্তভোগী পরিবার একটু হলেও স্বাবলম্বী হয়।
এমএএস